Home / সারাদেশ / যেভাবে ফাঁদে ফেলতেন সুন্দরী তানিয়া
Tania

যেভাবে ফাঁদে ফেলতেন সুন্দরী তানিয়া

গাজীপুর নগরীর তালুটিয়া পূর্বপাড়ার মনিরুল ইসলামের বাড়িতে প্রতারণা করতে গিয়ে ধরা পড়ে রূপবতী প্রতারক তানিয়া (৩০)। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) পুবাইল থানার এসআই সাইফুল ইসলাম শুক্রবার রাত ৮টার দিকে প্রতারণার অভিযোগে তানিয়া ও তার দুই সহযোগীকে আটক করে।

অন্য দুই প্রতারকের নাম হালিমা আক্তার দুলালী ও আলমগীর হোসেন। মাদকাসক্ত তানিয়া জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ৫০ টির বেশি প্রতারণা করেছে সে। রূপ-যৌবনকে পুঁজি করে অভিনব কায়দায় বাসা বাড়ি হতে অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার হাতিয়ে নেয়াই ছিলো তার কাজ। তানিয়া কখনো লাকী, কখনো সাবিয়া সানি, ডালিয়া, সাদিয়া আক্তার, তানি, নদী, নওশীন কখনো সুমি। এছাড়াও নিজেকে কখনো ডাক্তার, আইনজীবী, মডেল, কখনো নায়িকা পরিচয় দেয়। প্রথম দেখায় যে কারোর চোখ আটকে যায় তাকে দেখে। (খবর মানবজমিন)

আর এই সুযোগকেই কাজে লাগায় গাজীপুরের মেয়ে তানিয়া। দেখতে, পোশাকে আধুনিকতা, পরনে ব্র্যান্ডের দামি ঘড়ি, অলঙ্কার, জুতা-স্যান্ডেল, চোখে চশমা, এর সঙ্গে রঙিন বেশে এক মোহনীয় উপস্থাপনা তার বেশভুষায়।

বেশ কয়েক বছর ধরেই এমন সুন্দরের আড়ালে চলছে তার চুরি ব্যবসা। গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার রাজেন্দ্রপুরের গজারিয়া গ্রামের হাসান শিকদারের মেয়ে তানিয়া শিকদার (৩০)। থাকে উত্তরায় বাসা ভাড়া নিয়ে। বছরকয়েক আগে তার স্বামীর মৃত্যু হয়। এরপর তানিয়া তার দেবর ওয়ালিদ রহমানকে বিয়ে করে। তার চলাফেরা দেখলে কেউ ভাবতে পারবে না সে এত ভয়ঙ্কর চোর। তানিয়ার বিরুদ্ধে রাজধানীর আদাবর, দারুস সালাম, তেজগাঁও, নিউ মার্কেট, দক্ষিণখান, মোহাম্মদপুর, বিমানবন্দর, উত্তরা, মিরপুর, কাফরুল, শাহজাহানপুরসহ বিভিন্ন থানায় ২০টিরও বেশি প্রতারণার মামলা রয়েছে।

তানিয়া জানিয়েছে, সে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন সূত্রে বিত্তশালী লোকজনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতো। বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের স্বজনদের তথ্য সংগ্রহ করে। সুযোগ বুঝে তাদের কাছের লোক কিংবা স্বজন পরিচয় দিয়ে বাসায় যায়। ডলার ভাঙানো বা জমা রাখার ফাঁদ পেতে পানি খাওয়ার বাহানা, কখনো অন্য কোনো বাহানায় অর্থকড়ি নিয়ে সটকে পড়ে। সে চুরি করে নিয়ে যাওয়া স্বর্ণালঙ্কার প্রতারণা চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে বিভিন্ন জুয়েলার্সে বিক্রি করে। গাজীপুর মহানগরীর তালুটিয়া পূর্বপাড়ায় মনিরুল ইসলামের বাড়ির দরজায় শুক্রবার ২টার দিকে কড়া নাড়ে তানিয়া। মনিরুলের স্ত্রী কোহিনূর বেগম দরজা খুলতেই ওই নারী নিজের নাম লাকী জানিয়ে ঘরে ঢোকে। এরপর তানিয়া জানায়, সে কোহিনূরের ছোট বোন নাজমার স্বামী মামুনের সঙ্গে দুবাইতে থাকতো। ছুটিতে দেশে এসেছে। মামুন চকলেট, বোরকা ও চিপসসহ নানা সামগ্রী তার কাছে দিয়েছে পৌঁছে দিতে।

সে নাজমাকে বাড়িতে না পেয়ে ঠিকানা নিয়ে কোহিনূরের বাড়িতে আসে এসব মালামাল পৌঁছে দিতে। প্রতারক তানিয়া কোহিনূরকে জানায়, তার কাছে কিছু ডলার আছে। বিশ্বাস করে সে এসব কোহিনূরের কাছে রাখতে চায়। তখন কোহিনূরের স্বামী মনিরুল ইসলাম ব্যবসার কাজে বাইরে ছিলেন। ডলার রাখার কথা বলেই একটি রুমাল বের করে তানিয়া। বার বার সেটি কোহিনূরের মুখের কাছে নেয়।

একপর্যায়ে প্রতারক তানিয়া বলতে থাকে তার স্বামী ও দুই বাচ্চা বাইরে গাড়িতে বসে আছে। তারাও ঘরে আসবে। এজন্য ঘরের কক্ষগুলো গোছাতে বলে। তখন ফোনে কাউকে ১০ কেজি মিষ্টি, ১০ কেজি দই ও চিপস আনতে বলছিল তানিয়া। ফোন কেটে কোহিনূর ও তার মেয়ে মীমকে সোনার গহনা পরে সাজতে বলে। তারা বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য সেজেই আছে জানালে তানিয়া বলে, প্রথমবার আপনাদের বাড়িতে এসেছি, দুবাই থাকতে মামুন বলেছে আপনার অনেক সোনা-গহনা আছে, এসব পরেন। মেয়ে মীমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তোমার বিয়ে হয়েছে। গলায়, কানে কোনো সোনা-গয়না নেই কেন? দ্রুত মা-মেয়েকে সোনার গহনা পরতে বলে তানিয়া। এরপর ভেতরের কক্ষে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে তানিয়া কোহিনূরকে বলে- গাড়ি থেকে তার স্বামী ও বাচ্চাকে এগিয়ে আনতে। কথামতো তিনিও নিচে চলে যান। গিয়ে দেখেন রাস্তার পাশে একটি প্রাইভেট কার। সামনের গ্লাস নামিয়ে এক ব্যক্তি ইশারা করে ডাকছে। কিছু সময় পর কোহিনূরের স্বামী মনিরুল ও বাড়িতে ফেরেন। ঘরে ঢুকেই

তিনি তানিয়ার পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানতে চান। মনিরুল তানিয়াকে সন্দেহ করে উচ্চস্বরে বলতে থাকেন তুই ডাকাত। মনিরুল বাসার লোকদের তানিয়াকে আটকাতে বলতেই ছদ্মবেশী ওই নারী মনিরুলকে ধাক্কা দেয়। তখন তানিয়ার ব্যাগ চেক করে কিছু জাল ডলার পাওয়া যায়। হইচই শুনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসে। কোহিনূর যখন তানিয়ার স্বামীকে আনতে নিচে নামে তখনই আলমারীতে থাকা ১ লাখ টাকা, ২ ভরি ওজনের এক জোড়া বালা, এক ভরি ওজনের হাতের চিকন চুরি এক জোড়া, দুইভরি ওজনের আল্লাহু লেখা লকেটসহ একটি চেইন, ডায়মন্ডের একটি আংটি কৌশলে নিয়ে নেয় তানিয়া।

শুধু মনিরুলের বাড়িতেই নয়, একই এলাকার ইতালি প্রবাসী মেহেদী হাসানের স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার সুমির স্বামীর সঙ্গে বিদেশে থাকার ছলনায় গত ১৫ই ডিসেম্বর ঘরে ঢুকে সোনার চেইন, কানের দুল, কিছু রুপার গহনা ও নগদ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে যান তানিয়া। গত ২৫শে অক্টোবর রাত ৮টার দিকে গাজীপুর নগরীর সাহাপাড়া এলাকার মিজানুর রহমান খানের বাসা থেকে অভিনব পন্থায় ৬ ভরি ওজনের এক জোড়া সোনার রুলি, এক জোড়া বালা, দু’টি সোনার চেইন লুটে নেন। তানিয়া জানায়, গত ২৬শে মে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর সে পাঁচমাস কারাগারে ছিলো। মাসখানেক আগে জামিনে মুক্তি পেয়ে গাজীপুরে প্রতারণা শুরু করে। পূবাইল থানার ওসি নাজমুল হক ভূঁইয়া জানান, চুরি করা তানিয়ার নেশা ও পেশা। আটকের সময় তানিয়ার কাছ থেকে ৭৫ পিছ ইয়াবা সহ একটি সাদা রঙের প্রাইভেট কার যার নম্বর (ঢাকা মেট্রো-গ-২৩-০০২৪) উদ্ধার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করেছে। আর মনিরুলের বাড়ি থেকে তাকে আটক করার সুবাদে বাড়ির মালিক আলাদা মামলা করেন।

এছাড়া তানিয়াকে থানায় আনার পর অনেক ভুক্তভোগী থানায় এসে তার কথা জানিয়েছে। তিনি আরো জানান, পুলিশের কাছে সংরক্ষিত অপরাধের তালিকা খুঁজে তানিয়ার বিরুদ্ধে ২০টির অধিক মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। প্রক্রিয়া শেষে তানিয়া ও তার দুই সঙ্গীকে আদালতে তুলে রিমান্ড আবেদন করা হবে। রিমান্ড মঞ্জুর হলে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদে আরো তথ্য পাওয়া যেতে পারে। সঙ্গে থাকা আটককৃত আলমগীর (৩৮) গাজীপুর জেলার টঙ্গী থানার পূর্ব আরিচপুর এলাকার মৃত ইয়াকুব আলীর ছেলে অপর আরেকজন হালিমা আক্তার দুলালী (২৭) গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর থানার গজারিয়া এলাকার মৃত জালাল উদ্দিন এর মেয়ে। চুরির পথ বেছে নেয়ার কারণ প্রসঙ্গে তানিয়া সিকদার বলেছে, ‘ইচ্ছা ছিল নায়িকা হওয়ার। কিন্তু সেটা হতে এসে বিভিন্নজনের কাছে প্রতারিত হয়েছে। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে চুরিকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। তানিয়ার গ্রেপ্তার হওয়া বা জেল খাটা এবারই প্রথম নয়। এর আগে তিন দফায় প্রথমে পাঁচ মাস, পরে তিন মাস এবং সবশেষে পাঁচ মাস জেল খেটেছে। পুলিশ জানিয়েছে, এর আগে আরো ৮ বার জেল খেটেছে এ নারী।