Home / শিল্প-সাহিত্য / শিক্ষক সেই যিনি
শিক্ষক সেই যিনি

শিক্ষক সেই যিনি

“ যিনি জানেন,তিনি করেন, যিনি বোঝেন, তিনি পড়ান ” এ্যারিস্টোটল। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হলে শিক্ষকরা হলেন ¯স্য়ুনাতন্ত্র। যার ভিতর দিয়ে সব সময় প্রবাহিত হয় জ্ঞানের নতুন ধারা,নতুন সভ্যতা। সভ্যতার সুচারু কারিগড় হলেন শিক্ষক।
তিনি ছাত্রদের মাধ্যমে সমাজকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন স্বপ্নের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন,অন্ধকার কার দূর করে আলোর পথ দেখান, ছাত্রের ভেতরকে জাগিয়ে তোলেন। শিক্ষক সেই যিনি সমাজে সম্প্রীতির বন্ধন ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমম্পর্ক এবং পরিবেশ সৃষ্টিতে বা তৈরিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। যিনি প্রতিনিয়তই সংগ্রাম করেন সত্য এবং সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করতে।

যার কাছ থেকে ছাত্ররা সত্যকে সত্য বলতে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে শিখে, বলার সাহস সঞ্চয় করে। একজন শিক্ষকই সমাজে নৈতিকতা,মূল্যবোধ ও মনুষত্ব প্রতিষ্ঠা করতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যিনি শিক্ষক তিনি ছাত্রদের শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন না।

শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাশের জন্যই শিখানো শিক্ষকের কাজ নয়, তিনি শিখান জীবনকে জানার জন্য, জীবনকে বোঝার জন্য এবং জীবনকে পাশ করার জন্য। শিক্ষকের শিক্ষতার জন্যই সমাজ-সভ্যতা ও জাতীয় জীবনে গতিশীলতা আসে। শিক্ষকের সীমাহীন ত্যাগ,শ্রম ও মেধার কারণেই আমরা আজ সভ্যতার উন্নত শিখরে উন্নীত হয়েছি।

শিক্ষক শ্রমজীবী থেকে সকল শ্রেণির মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হন এবং তিনি নিজেও শ্রমজীবী মানুষকে শ্রদ্ধা করেন তেমনি ছাত্রদেরকে শিখান শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে লড়তে ও তাদেরকে শ্রদ্ধা করতে। কাল মার্কস বলেছিলেন , শ্রমিকের শ্রম ছাড়া সোনাও মাটি। শিক্ষকই তার শিক্ষার মাধ্যমে একজন ছাত্রকে পূর্ণাঙ্গতা দান করেন। শিক্ষকের আসন শুধু শ্রেণি কক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ছড়িয়ে থাকেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। শিক্ষক না থাকলে ব্যক্তি জীবন যেমন আলোকিত হয় না তেমনি সমাজ সভ্যতাও আলোকিত হয় না।

শিক্ষকের সংকটের কারণেই আজ তরুণ সমাজ,যুব সমাজ বিপথগামী। শিক্ষকের সংকটের কারণেই আমাদের সমাজ-সভ্যতা অর্থনীতি সংকটের মুখে,প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উৎপাদনে গতিশীলতা পাচ্ছে না। আজকের সমাজে নামধারী শিক্ষকের পরিমাণ অনেক থাকলেও শিক্ষকের পরিমাণ খুবই নগন্য। শিক্ষকের সংকট থাকলে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ খুব বেশি লাভবান হয়।
শিক্ষক হলেন সমাজের বাতিঘর। এ বাতিঘর যখন অযতœ আর অবহেলায় বেড়ে উঠতে থাকে থখন আমরা নিজেরাও পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে হারিয়ে ফেলি। আর এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির প্রভাব পড়ে আমাদের সমাজে এবং এর ভোক্তভোগী আমরাই। শিক্ষক শুধু রুটিরুজির জন্যই শিখাবেন না। তিনি শিখাবেন আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য,আলোর স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিতে,নিজের আত্মতৃপ্তি,সমৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য।

যে শিক্ষক নিজেকেই বিকশিত করতে পারেন না, তিনি অন্যকেও বিকশিত করতে পারে না। তার শিক্ষায় সমাজে বন্ধ্যাত্ব তৈরি হয়। তার জন্য শিক্ষকতা নয়, জীবিকার জন্য অন্যকোথাও চেষ্টা করা প্রয়োজন। তবে একথা সত্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও পৃষ্টপোষকতা ছাড়া শিক্ষক হওয়া যায় না। আজকের সমাজে যে সামাজিক ও মানবিক অবক্ষয় চলছে তার জন্য নামধারী শিক্ষকের শিক্ষকতা এবং শিক্ষাই দায়ী।

যেকোনো মূল্যে আমাদেরকে এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের প্রয়োজনেই। সংকট যত গভীর হয় শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা তত বৃদ্ধি পায়। সভ্যতার শুরু থেকে আমরা দেখি শিক্ষদের নিরলস প্রচেষ্টা কীভাবে শতপ্রতিকুলতা,বাঁধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শিক্ষক শিখান সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জীবন দিতে হয়,মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নয়। শুধুমাত্র শ্রেণিকক্ষে পড়ানোই শিক্ষকের কাজ নয়। ছাত্ররা যখন শিক্ষকের কাছ থেকে প্রাপ্য সময়টুকু এবং প্রত্যাশিত জ্ঞানটুকু না পান তখন শিক্ষক তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলেন এবং তার প্রতি ছাত্রদের অবহেলা ও অবজ্ঞা বৃদ্ধি পায়।

তবে আজকাল শিক্ষকদের মধ্যেও ফাঁকি দেওয়ার প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। আবার তাদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। একদল শিক্ষককে দেখা যাছে তার সমস্ত কিছু বিকিয়ে দিয়ে শুধুমাত্র টাকার পিছনে ছুটছেন। ফলে তার ব্যক্তিগত প্রাপ্তি ও সুখ যেমন বিনিষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে পারিবারিক অশান্তি ও কলহও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আর এভাবেই শুর হয় সামাজিক অধ:পতন ও অবক্ষয়। শিক্ষক ছাত্রদের মধ্যে চেতনার জায়গা এবং চেতনাবোধ গড়ে তুলবেন, জাগ্রত করবেন আর তা করতে না পারলে তিনি শিক্ষক হতে পারেন না। শিক্ষক এবং শিক্ষার যে সংকট চলছে তা থেকে বরিয়ে আসতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, শিক্ষকদের সহযোগিতা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন । ভালো কাজে হ্যাঁ বলুন ,খারাপ কাজকে না বলুন।

আমরা যদি আমাদের সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে চাই তবে শিক্ষকের পরিসর বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যেও শিক্ষার সংগ্রামকে অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা আশা করি শিক্ষকদের পরিসর বৃদ্ধি পাবে। তবেই আমরা আগামীর একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গঠন করতে পারবো,আলোকিত মানুষ পাবো বলে আমরা বিশ্বাস করি।

লেখক : সুধীর বরণ মাঝি, শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয় হাইমচর-চাঁদপুর। ৫ জানুয়ারি ২০১৯

Leave a Reply