Home / চাঁদপুর / শনিবারের শনির দশা : চাঁদপুর বড়স্টেশন মোলহেডের স্পেশাল ফুচকা
Hai rommo

শনিবারের শনির দশা : চাঁদপুর বড়স্টেশন মোলহেডের স্পেশাল ফুচকা

শনিবারের শনির দশা উপ-শিরোনামে সহনীয় মাত্রার অসহনীয় যন্ত্রণা নামে একটি রম্য রচনা লিখেছেন উপ-সচিব মোহাম্মদ আবদুল হাই। এ পর্বে বিষয় হলো চাঁদপুর বড়স্টেশন মোলহেডের স্পেশাল ফুচকার ইতিকথা। চাঁদপুর টাইমস পাঠকদের জন্যে তা তুলে ধরা হলো।

তেতুল দেখলে কারো জিহবায় পানি আসুক বা না আসুক আমার জিহবায় কিন্তু আসবেই । এর কারণ আজো উদঘাটন করতে পারিনি । তবে ফুচকা-চটপটির দোকান দেখলেও জিহবা সিগনাল দেয় । কারণ টক ঝাল ! এ ফুচকা চটপটি ললনাদের অতীব প্রিয় ! এখনো অফিস হতে ফেরার পথে গিন্নি বলে চটপটি নিয়ে আসবা। এ চটপটি -ফুচকার কেরামতি টকঝালে নিহিত । আর চটপটি ফুচকার দোকান মানে জোড়ায় জোড়ায় আদম হাওয়া । ব্যতিক্রমও আছে । তবে এতে হাওয়ার দলের লাভ বেশি । তারা ফ্রি খায় ! যে আদম খুশি মনে বিল দেন তিনি হাওয়ার জ্ঞাতি ভাই, খালাত ভাই, তালতো ভাই , স্বামী , দেবর, ভাসুর কিংবা ডার্লিং !! অদ্যবদি জোড়ায় জোড়ায় যাদের ফুচকা খেতে দেখেছি, তাদের মধ্যে আদমই সর্বদা অত্যুৎসাহে বিল পরিশোধ করে সফল পুরুষের ঢেঁকুর তুলেছেন আর হাওয়াদের দেখেছি ” ভাই, আরেকটু টক দেন” ডায়ালগ বলতে ।

তো এ হাওয়ারা মাঝে মধ্যে আদম পরিবর্তন করে ফেলে । এর বহুবিধ কারণ থাকতে পারে যা হাওয়ার কাছে যৌক্তিক কিন্তু আদমের কাছে কলিজায় শেল মারার মতো ! ধার কর্জ করে যে আদম মাসের পর মাস এ পরম অখাদ্য ফুচকা হাওয়াকে খাওয়ালেন, হঠাৎ কাল বৈশাখী ঝড়ে সব বিলীন ! হাওয়া এখন অন্য আদমের হাওয়া মানে ফুচকা খায় ! খাওয়ার ঢং বা স্টাইল এমন যে সামনে বসা আদম ব্যতিত আর কারো ফুচকা আগে তিনি খাননি !! আদমের দিল মানে না ! সহ্য হয় না । তার ভালোবাসার চটপটিকে এখন অন্যজন ফুচকা খাওয়ায় !

আদম সরাসরি জিজ্ঞেস করে , “তুমি এখানে কি করছো ? ইনি কে ? ইদানীং আমার ফোন ধরছো না কেন?” হাওয়ার নির্লীপ্ত ভাবসহ জবাব ” সরি , আপনি ভুল করছেন , আপনি কে ভাই ? আমিতো আপনাকে চিনিনা! বলেই সামনে বসা নতুন আদমের প্রতি সদ্য ভ্রুপ্লাক করা হরিন চোখের ইশারা ।

আর সাথে সাথে ঐ আদমের কন্ঠে উক্তি,” হ্যালো ব্রাদার, সি ইজ মাই গার্লফ্রেন্ড ! ডোন্ট ডিস্ট্রাব আস, জাস্ট ভদ্রভাবে কেটে পড়েন ” বলেই হাঁটু ও গোড়ালিতে ছেড়া বিগত দুইমাস ধৌতবিহীন তিন বছর পূর্বে হুমকির বিনিময়ে গিফট পাওয়া জিন্স প্যান্টের বাম পকেটে হাত রেখে ডান হাত যা সিলভার চেইন ও ব্রোন্জের ব্রেসলেটে মোড়ানো সামনে বাড়িয়ে দাড়ালেন এবং কোমরের পিছনে রাখা জং ধরা পিস্তলের হাল্কা ঝলক প্রদর্শন করলেন!

আদম স্তম্ভিত হয়ে হার্টফেলের উপক্রম ! জান বাঁচলে বহু ডানাকাটা হাওয়া এবং ভালো পূণ্য করলে পরকালে কমপক্ষে ৭০ টি হুর নিশ্চিত ! সো জান বাঁচাও ! সরি বলে আদম ভাবলেশহীনভাবে বেরিয়ে গেলেন ।

এ অধম মানে আমি আদম তখন ওই জেলার এডিসি । যুব ও সুশীল সমাজকে নিয়ে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ করছি । আমরা গড়বো ডিজিটাল চাঁদপুর , ব্র্যান্ডিং চাঁদপুর , ক্লীন চাঁদপুর-গ্রীন চাঁদপুর, ই মিউটেশন, বাল্য বিয়ে, যৌতুক নিরোধ, ইভটিজিং, পাশের হার বৃদ্ধি, পর্যটনের বিকাশসহ আরো কত কী!

তবে চাঁদপুরের অন্যতম আকর্ষণ ত্রিমোহনা বা মোলহেড কেন্দ্রীক পর্যটনের বিকাশ ছিল চাঁদপুরবাসীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু । তিনদিকে তিন নদী (পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া) । নদীর গভীরে বা পেটের ভিতরে সদর্পে দাড়িয়ে থাকা এ মোলহেডে বিকেল হতে সৌখিন, রুচিশীল ও প্রেমিক প্রবরদের প্রকৃতি দর্শনে আগমন ঘটে ।

তবে শীত, বর্ষা, গ্রীষ্ম বা ভরা মৌসুমে পূর্ণিমা রাতে ওই স্থানের নির্মল হাওয়া যেকোন পাষাণ হৃদয়কে শীতল করে, ভাবুক মনকে কাব্যিক মনে কিংবা প্রেমিক জুটিকে স্বর্গীয় আলিঙ্গনে উজ্জীবিত করে ।

ওই স্থানে প্রবেশ পথসহ পাশেই বিভিন্ন অবৈধ টং ঘর ও কয়েকটি ফুচকার দোকান । ফুচকার দোকানগুলি সর্বদা সরগরম থাকে । বসার জায়গা পাওয়া অনেক সময় ভাগ্যের ব্যাপার । মাঝেমধ্যে দেখি লাইন ধরে অপেক্ষা চলে । আমিও হাওয়া খেতে মাঝে মধ্যে তথায় গমন করি । তবে এডিসি বলে সাধারণত ফুচকা খেতে যাইনা! পাবলিকের ভীড় দেখে একবার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম “ফুচকার দোকানে কপোত কপোতীর এতো ভীড় কেন? ” “এখানে স্পেশাল কেবিনে স্পেশাল ফুচকা বিক্রি হয়, লাইন পেতে অনেক সময় লাগে ” জবাব ড্রাইভারের । শুনে বেশ প্রীত হলাম এবং কোন এক সময় খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলাম । শুনে ড্রাইভার ইষৎ মুচকি হাসি দিলেন কিন্তু এর রহস্য বুঝতে পারিনি তখন ।

যাক এবার আসল কথায় আসি । কোন এক বিকেলে অফিসে নিজের রুমে বসে কাজ করছি । আমার সিএ বললেন , একজন যুবক আমার সাক্ষাৎপ্রার্থী । স্বাভাবিকভাবে যুবক শুনলে আমি সানুগ্রহে সুযোগ দেই । দুই মিনিটের তরে আগমন হলেও বত্রিশ মিনিট আগে তার প্রস্থানের সুযোগ নেই কারণ ত্রিশ মিনিট আমি বকবক করে বিভিন্ন হাতি ঘোড়া মারি!

তবে আগুন্তক ঠিকই তার বরাদ্দকৃত দুই মিনিট কথা বলতে পারেন । যুবক দেখতে নায়কের মতো । স্মার্ট , খোঁচা খোঁচা দাড়ি , বয়স ২২ বা ২৩ বছরের মতো , দেখে হিংসা হয়, আমি কেন তার মতো সুদর্শন না ।

যুবক বললো, “স্যার অভয় দিলে কিছু কথা বলতাম “। বলেন । স্যার, গোপন কথা, কেউ না আসলে ভালো হয়” । “ওকে, কেউ আসবেনা”। তারপর যুবক বললো,” স্যার, আপনেরা যে এতো উদ্যোগ নিয়ে মোলহেড সাজাচ্ছেন, তা মাটি হতে চলছে । ফুচকার দোকানগুলি দুই নম্বরী কাজ করছে । সামনে বসে ফুচকা খেলে চল্লিশ টাকা । কিন্তু ভিতরে স্পেশাল রুমে ফুচকা খেলে ঘন্টায় তিনশো টাকা । শুক্রবারে সকাল হতে রাত অবধি ফুচকার নামে ভিতরে আকাম কুকাম চলে বেশি। সাধারণ মানুষ অসন্তুষ্ট । একটা কিছু করেন স্যার”। আপনি কিভাবে জানেন ?

“স্যার, আমিও ঐখানে বহুবার স্পেশাল ফুচকা খাইছি”। “এখন খান না?” ” না স্যার”। ” কেন ? ” খাবার মানুষ আরেকজন নিয়ে গেছে “। বুঝলাম, চ্যাকা খায়ছে । আর চ্যাকা খাওয়া লোকের প্রতি আমার দরদ ও সহানুভূতির সীমা অপরিসীম (কারণ জিজ্ঞেস করে কলিজায় শেল মারবেন না)।

এখন বুঝলাম ড্রাইভারের মুচকি হাসির কারণ । যুবককে গোয়েন্দাগিরির দায়িত্ব দেয়া হল । আমাকে যখাসময়ে তাজা খবর দিবেন তিনি । তবে আমিও ভিন্ন আঙ্গিকে খোঁজ খবর নিয়ে স্পেশাল ফুচকা খাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হলাম। এনডিসিকে বলে রাখলাম, যে কোন দিন একটা ঝটিকা জুটি ধরার অপারেশন হবে ।

তরুণ এনডিসি ময়নুল এ সব বিষয় পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে । সে সদা প্রস্তুত মর্মে জানালো । অবশেষে যুবক মোক্ষম সময় জানালো । সন্ধ্যার একটু পরে এনডিসি অভিযানে নামলেন । স্পেশাল কক্ষ জুটিতে ভরপুর । বাইরে অপেক্ষমাণ নতুন জুটি ।

আজ এক ঘন্টার বেশি বুকিং বন্ধ । যত রাত হোক সব জুটি স্পেশাল ফুচকা খেয়ে বাড়ি যাবেন। এনডিসি জানালো কয় জন ধরবে বুঝতে পারছে না । কারণ সবাইতো স্পেশাল ফুচকা খাচ্ছে, বাইরে অপেক্ষমাণ তালিকাও বাড়ছে “। বললাম, “কয়েক জোড়া জুটি ধরে অফিসে নিয়ে আসো” । কয়েক জোড়া আনা হলো । তারা প্রেমিক প্রেমিকা। ছাত্রছাত্রী কিংবা পরোকিয়া জুটি । জেল না বিয়ে -শর্ত দিলো এনডিসি । সবাই কাঁদল , অনুতপ্ত । শেষবারের মতো সুযোগ চান কিন্তু এনডিসি নাছোড় বান্দা । হয় বিয়ে না হয় জেল !

ঘটনা মনিটরিং এ আমি আছি । অনেক পরে বললাম, যার যার অভিভাবক ডেকে আনতে। তারা আসলেন । পারিবারিক ও সামাজিক মানসম্মান ও ইজ্জতের বিষয়! মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হলো । নাম ঠিকানা বিহীন “মোলহেডে আপত্তিকর অবস্থায় কপোতকপোতি ধৃত” শিরোনামে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া হলো ।

আমজনতা ক্ষেপে গেল ! সবাই এর বিহীত চায়। স্পেশাল ফুচকার নির্মূল চায়। পাবলিক মনোভাব কাজে লাগানো হলো । পরের দিনই বিনা যুদ্ধে মোলহেড ফকফকা (উচ্ছেদ) !

আর এভাবেই স্পেশাল ফুচকা বিক্রি পর্ব সমাপ্ত হলো। শত শত জুটির স্পেশাল ফুচকা খাওয়ার আড়ত ভেঙ্গে দিয়ে যুবক হারানো প্রেমের প্রতিশোধ নিল ! সেই থেকেই মোলহেডে আর কেউ স্পেশাল ফুচকা খায়না- এখন সবাই নির্মল হাওয়া খায় !

লেখক- প্রাক্তন এডিসি ও ডিডিএলজি, চাঁদপুর।
বর্তমানে ডেপুটি প্রজেক্ট ডাইরেক্টর(স্মার্ট কার্ড),
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, ঢাকা

: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০১:০৩ পিএম, ৬ জানুয়ারি ২০১৮, শনিবার
ডিএইচ