Home / ফিচার / ‘তৃতীয় মেয়াদের সরকার’ স্বপ্ন নাকি বাস্তব?
‘তৃতীয় মেয়াদের সরকার’ স্বপ্ন নাকি বাস্তব?

‘তৃতীয় মেয়াদের সরকার’ স্বপ্ন নাকি বাস্তব?

দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এখন এমন একটি জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখান থেকে অন্য কোনো কিছুই অনুমান করা যাচ্ছে না, কেবল একটি বিষয় ছাড়া। জ্ঞানী-গুণী, ধনী-দরিদ্র, সাহেব-বিবি-গোলাম থেকে শুরু করে মুচি-চামার-ধোপা প্রমুখ খেটে খাওয়া মানুষকে যদি আপনি দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন তবে সবাই একবাক্যে বলে দেবেন যে, আগামীতে আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় আসবে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষবৃন্দ অবশ্য বিষয়টি স্বীকার করেন, তবে একটু ভিন্নভাবে। তারা বলেন, সরকার অতীতের মতো একটি নীলনকশার নির্বাচন জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়ে অভিনব কায়দায় ক্ষমতায় টিকে থাকার পাঁয়তারা করছে। আমরা জনগণকে নিয়ে তুমুল আন্দোলনের মাধ্যমে সব নীলনকশা ও চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেব।

সরকারবিরোধীদের মধ্যে যারা একটু চুপচাপ থাকতে পছন্দ করেন এবং নিয়তিতে বিশ্বাস করেন তারা খুবই সংক্ষেপে নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, এভাবে চলতে পারে না, আল্লাহ সহ্য করবেন না। আবার যদি জনগণের অধিকার হরণ করা হয় তবে আসমান থেকে গজব নাজিল হবে। সরকারবিরোধী লোকজনের নানামুখী বক্তব্য ও আচরণে আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযোগী রাজনৈতিক বান্ধববৃন্দ আপাতদৃষ্টিতে চিন্তিত বা বিচলিত নন। তারা টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আরোহণ করে কী কী কর্ম করে অমরত্ব লাভ করবেন তা মোটামুটি চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। দল ও সরকারের ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ তাদের বক্তৃতা ও বিবৃতিতে দৃঢ়তা, প্রবল আস্থা ও আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করলেও পর্দার পেছনের নানান পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি ইত্যাদি সূত্রমতে যেমন হিসাব কষে চলেছেন তেমন ইতিহাস, অর্থনীতি, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন শাস্ত্রের নানান প্রতিষ্ঠিত সমীকরণের আলোকে পরিস্থিতির চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইদানীংকালের বক্তৃতা-বিবৃতি, নানান মন্তব্য এবং নিজ দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে প্রদত্ত আদেশ-উপদেশ পর্যালোচনা করে আমার মনে হয়েছে আগামীর সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে তিনি ভিন্নতর চিন্তা করেন। তিনি দেশের সাধারণ মানুষের মতো সরল সমীকরণে যেমন বিশ্বাসী নন তেমন তার দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের কথাবার্তার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেন না। তিনি সরকারবিরোধীদের গতানুগতিক সমালোচনাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে একটি প্রশ্নবোধক নির্বাচনের ফলভোগী হতে যেমন সম্মানবোধ বা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না তেমন অভিসম্পাতকারীদের খুশি করার জন্য নিজেকে এবং দলকে যে কোনো আজাব ও গজবের লক্ষ্যবস্তুও করতে চান না। তিনি বরং রাজনীতির চিরায়ত কূটনীতি, মেধা, প্রজ্ঞা ও কৌশলের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম এবং আন্তরিকতার সংযোগে একাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদের জন্য সরকার গঠন করতে চান। আজকের দিনে দেশীয় রাজনীতির চরম বাস্তবতা হলো— বিএনপি নামক দলটি সাংগঠনিকভাবে বিধ্বস্ত। দলটির প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, কারও কারও বিরুদ্ধে সরকারের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ এবং বেশির ভাগ নেতা মামলা-মোকদ্দমা, পুলিশি হয়রানি ও সরকারি দলের পেশিশক্তির হুমকি দ্বারা নানাভাবে নাজেহাল হতে হতে হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। দলের চেয়ারপারসন জেলখানায়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রবাসে। তার পরও বিএনপির জনসমর্থন কমে গেছে কিংবা বিএনপির ভোটাররা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেন এমন সম্ভাবনার কথা বদ্ধ উন্মাদরাও বলবেন না। বরং নির্বাচনের সময় পপুলার ভোট, নারী ভোটের একাংশ এবং সহানুভূতির ভোট যে বিএনপির দিকে যাবে না এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। ফলে তাদের প্রায় বেশির ভাগ ভোটের সঙ্গে অন্যান্য ভ্রাম্যমাণ ভোটের সংযোগ ঘটলে কী ফলাফল হতে পারে তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুব ভালো করেই জানেন।

বিএনপির প্রধান সহযোগী জামায়াত সম্পর্কে আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতৃত্বই বেখবর। তারা মনে করেন, জামায়াতের অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে এবং বাংলাদেশের জামায়াত আগামী দিনগুলোয় মাথা তুলে দাঁড়ানো দূরের কথা, মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে না। জামায়াত সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের চিন্তাভাবনা যে কতটা ভয়ঙ্কর রকম ভুল ও ভ্রান্তির দ্বারা আক্রান্ত তা বোঝা যায় দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের প্রতিবেদন মূল্যায়ন করলে। তাদের তথ্যমতে, জামায়াত একটি ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন। আওয়ামী লীগ যেসব প্রতিষ্ঠানকে জামায়াতের অর্থনৈতিক ভিত্তির উৎস মনে করছে সেগুলো আসলে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের মালিকানাধীন ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান। জামায়াত মূলত পরিচালিত হয় কর্মীদের দেওয়া মাসিক ও বার্ষিক চাঁদার ভিত্তিতে।

জামায়াত সম্পর্কে সাম্প্রতিক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে যে, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে তারা অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে শক্তিমত্তা অর্জন করেছে এবং তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন এবং প্রতিপক্ষকে আঘাত করার জন্য চুপটি করে ঘাপটি মেরে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছে। ছাত্রশিবির, ছাত্রী সংস্থার কর্মী সংখ্যা তারা জ্যামিতিক হারে বাড়িয়েছে। মূল দলের কর্মী সংখ্যা কতটা বাড়িয়েছে তা অনুমান করা যায় সাম্প্রতিককালে তাদের পরিসংখ্যান মূল্যায়ন করলে। জামায়াতের সাংগঠনিক ভিত্তির চালিকাশক্তির ঘূর্ণায়মান কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসের নাম রুকন। দলটির রুকন পদমর্যাদার কর্মীরাই হলো দলের প্রাণ। তারা আল্লাহর নামে শপথ গ্রহণ করে রুকন হিসেবে অভিষিক্ত হন। জামায়াতের সব কর্মী-সমর্থক কিংবা শিবিরে যোগদান করা সমর্থক ও কর্মীরা সারা জীবন ধরে স্বপ্ন দেখেন রুকনরূপে অভিষিক্ত হয়ে দলের জন্য নিজের জীবন, পরিবার ও সহায়-সম্পত্তি বিসর্জন দিয়ে গাজীরূপে বেঁচে থাকতে নতুবা মরে গিয়ে শহীদি মর্যাদায় জান্নাতলাভের জন্য।

জামায়াতের একজন কর্মী যেদিন রুকন পদে অভিষিক্ত হন সেদিন থেকে তিনি তার মাসিক অথবা বার্ষিক আয়ের শতকরা দশ ভাগ থেকে শুরু করে ২৫ ভাগ পর্যন্ত অর্থ সংগঠনকে দান করেন। তারা দলের জন্য যে কোনো ঝুঁকি গ্রহণ, জীবন বিসর্জন অথবা দলকে সেবা করার মানস নিয়ে সর্বদা নিজেকে প্রস্তুত রাখেন। জামায়াতের প্রয়াত আমির গোলাম আযম যেদিন মারা গিয়েছিলেন সেদিন সারা দেশে রুকনের সংখ্যা ছিল ৫৫ হাজার যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ হাজারে। আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতা-কর্মীরা হয়তো তথ্য জানেন না অথবা যারা জানেন তারা হয়তো ৭০ হাজার রুকনকে নিজেদের ৭০ হাজার নেতা-কর্মীর মতো মনে করেন। কিন্তু আওযামী লীগ সভানেত্রী অবশ্যই তা মনে করেন না। কারণ তার কাছে হালনাগাদ সব গোয়েন্দা রিপোর্ট এবং প্রতিটি রিপোর্টের ত্রিমাত্রিক নিরাপত্তা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়। ফলে তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতিকে রাজনৈতিকভাবে, কূটনৈতিকভাবে অথবা প্রশাসনিকভাবে মোকাবিলার জন্য এমন কতগুলো সিদ্ধান্ত নেন, যা সাধারণ মন-মস্তিষ্ক আন্দাজ করতে পারে না।

বিএনপি-জামায়াত ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক দল যথা জাতীয় পার্টি, সিপিবি, গণফোরাম, বিকল্পধারা, নাগরিক ঐক্য, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামকে কোনো সহজ সমীকরণে ফেলে সরকার এ মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না। এ ছাড়া আ স ম আবদুর রবের জাসদ, বাসদ, জাকের পার্টি প্রভৃতি দলকে রাজনৈতিক ঐক্যের বাইরে রাখা এবার আদৌ সম্ভব হবে না। ফলে একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্যের যে ঝড় শুরু হবে তা সামাল দিতে না পারলে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল।

আমাদের দেশের রাজনীতিতে বহির্বিশ্বের চাপ বলতে একসময় বিশ্বব্যাংক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাদাগিরিকে বোঝাত। পশ্চিমা দুনিয়ার ইংল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব ও রাশিয়ার পাশাপাশি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর নাক গলানোর কথা শোনা যেত। অন্যদিকে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সর্বাত্মক প্রভাব তো ছিলই। অতীতকালের সেসব বিদেশি প্রভাব আজ একই বৃন্তে ফুলাকারে প্রস্ফুটিত হয়েছে ভারতবৃক্ষের ওপর ভর করে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের প্রায় সব নাগরিক মনে করেন, ভারতকে চটিয়ে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না কিংবা একই কর্ম করে কেউ ক্ষমতায় টিকতে পারবে না। জনগণের এই সাধারণ বিশ্বাসের সামনে ও পেছনে যে আরও অনেক কাহিনী আছে তা কেবল নির্বাচন বিশেষজ্ঞরাই জানেন। আর তা হলো— কোনো জাতীয় নির্বাচনে কোনো বিদেশি শক্তি কোনো রাজনৈতিক দলকে মদদ দিলে বা কারও বিরুদ্ধে বিদেশি মদদপুষ্ট হওয়ার অভিযোগ উঠলে গণরায় সব সময় তাদের বিরুদ্ধে যায়। ফলে নির্বাচনে জয়লাভের ক্ষেত্রে সব সময়ই ট্রাম্প, মোদি, পুতিন, এরদোগান প্রমুখের মতো কট্টর জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের উগ্র বক্তৃতা-বিবৃতি বিশেষ করে বিদেশি শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে এক ধরনের মহৌষধের মতো কাজ করে।

তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেন এমন বুদ্ধিজীবীদের মতে বিশ্বের সর্বত্র দরিদ্র, হতদরিদ্র কিংবা উন্নয়নশীল দেশের ক্ষমতার মসনদে যিনি বা যারাই বসুন না কেন তিনি বা তাদের অবশ্যই প্রভাবশালী বিদেশি শক্তির তাঁবেদারি করতে হবে। অন্যথায় ক্ষমতাচ্যুতি অথবা রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার ঝুঁকি মোকাবিলার পাশাপাশি সেনা বিদ্রোহের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে বিনিদ্র রজনী কাটাতে হবে। তাদের তাঁবেদারির বদনামি মাথায় নিয়ে জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও বিরক্তি মোকাবিলা করতে হবে। অথচ নির্বাচনের সময় তারা প্রকৃতপক্ষে কোনো সাহায্যই করতে পারবে না, কেবল দূর থেকে হুমকি-ধমকি প্রদান ছাড়া। এ কঠোর ও নির্মম বাস্তবতার জন্যই ওইসব দেশে পরপর দুবার কোনো রাজনৈতিক দল গণরায়ে নির্বাচিত হয় না। কেউ যদি গণরায় উপেক্ষা করে বিকল্প পদ্ধতিতে ক্ষমতায় থেকে যায় তবে অনাগত দিনে চতুর্মুখী বিপদ তাকে অক্টোপাসের মতো চেপে ধরে তার সব সুখ-শান্তি-আরাম-আয়েশ এবং সুনাম-সুখ্যাতি হারাম করে দেয়। উপরোক্ত প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সার্বিক অবস্থা থেকেই অনুমান করতে পারবেন। তারা অন্তহীন রাজনৈতিক সমস্যাকে প্রথাগতভাবে সমাধান না করে যে কায়দায় শাসন পরিচালনা করছেন তাতে চারদিকে কেবল শক্তি প্রয়োগের জয়জয়কার ও প্রয়োগকারীদের দাম্ভিকতা ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষমতার প্রকৃত ছড়ি যারা ঘোরাচ্ছেন তারা লোক দেখানোর জন্য সরকারবিরোধীদের দৌড়ের ওপর রাখছেন এবং নিজেদের মেজাজ-মর্জি, অভিরুচি, হালুয়া-রুটির বিনিময়ে সরকারের শত্রুদের জন্য দেশে এবং দেশের বাইরে নিরাপদ জায়গা করে দিয়েছেন। বিরোধী দলসমূহের কুখ্যাত বিতর্কিত ও দুর্নীতিবাজরা গত ১০ বছরে সরকারি নির্যাতনে বা জুলুমে ব্যবসাহারা, বাস্তুহারা অথবা সম্পদহারা হয়েছেন এমন একটি উদাহরণও নেই। অধিকন্তু দেশের বিভিন্ন সেক্টরের কৌশলগত পদ-পদবি ও অবস্থানগুলোয় সুচতুর সরকারবিরোধীদের এমনভাবে বসানো হয়েছে যারা আম-দুধের মতো রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে মিশে গিয়ে উল্টো সরকারি দলের নিরীহ নেতা-কর্মী, সমর্থক ও শুভার্থীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য, জুলুম-নির্যাতন এবং বঞ্চনার চাবুকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছেন।

আলোচনার এ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কিছু বলা যাক। এ কথা কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না যে, গত ১০ বছর যারা ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে বৈধ কিংবা অবৈধভাবে অর্থবিত্তের মালিক হয়ে পড়েছেন তারা সবাই প্রকৃতির নিয়মে দল, রাজনীতি এমনকি রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজনকে বাদ দিয়ে উপার্জিত অথবা লুটপাটকৃত অর্থের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন। নিজেদের বিত্তবৈভব নিয়ে কোন দেশে কিংবা কোন বনে গিয়ে প্রেমকুঞ্জ বানাবেন সেই চিন্তায় সদাসর্বদা এতটাই বিভোর থাকেন যে, দলের জীবন-মরণ সমস্যার সকরুণ আর্তি তাদের কর্ণকুহর অথবা হৃদয়বেদিতে ঢুকতে পারে না। এই শ্রেণিটি ছাড়াও আরেক শ্রেণি পয়দা হয়েছে গত ১০ বছরে যারা সরকারি ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় থেকে কারণে-অকারণে দল-বদলের লোকদের অত্যাচার-জুলুম ও নির্যাতনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই শ্রেণিটির বিবেক-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে এবং পৃথিবীর তাবৎ অত্যাচারীর মতো তারাও স্বভাবে ভীরু ও কাপুরুষে পরিণত হয়েছে। ফলে কোনোকালে দুর্ঘটনাক্রমে তাদের প্রতিপক্ষ যদি সামান্যতম রুখে দাঁড়ানোর সাহস দেখায় তবে তারা তাদের নির্যাতনের হাতিয়ার হাতুড়ি, চাপাতি, রামদা, তলোয়ার, পিস্তল, বোমা ইত্যাদি ফেলে সবার আগে পালিয়ে যাবে।

বিগত প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে যারা মেম্বার, চেয়ারম্যান, মেয়র বা এমপি হয়েছেন তার মধ্যে বিরাটসংখ্যক লোক নিজেদের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা হারানোর পাশাপাশি জনগণের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন, প্রতিপক্ষকে সামাল দেওয়া, জনগণের কাছে বিনয়ী হয়ে ভোট প্রার্থনা এবং সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে নিজের পক্ষে ব্যালট পেপারে ভোটারদের স্বীকৃতি আদায়ের মতো কঠিন কাজের জন্য যে গুণাবলি দরকার তা তারা ইতিমধ্যে হারিয়ে ফেলেছেন। তারা সরকার এবং প্রশাসনের দয়া, আনুকূল্য ও হুন্ডা-গুন্ডার মাধ্যমে জাল-জালিয়াতির নির্বাচনে জয়ী হয়ে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার বাইরে অন্য চেষ্টা-তদবির করার কথা কল্পনা করতে পারছেন না। অন্যদিকে, বিগত দিনে এমপি-মন্ত্রীরা প্রশাসনের যে সম্মান ও সমীহ পেতেন তা বর্তমানে এসে ঠিক ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে উল্টে গেছে। রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেভাবে প্রকাশ্যে জনপ্রতিনিধিদের মূল্যায়ন করছেন তাতে মনে হয় তাদের করুণা ছাড়া ভোটের মাঠে কেউ দাঁড়াতেই পারবেন না।

আমরা আজকের আলোচনার একদম প্রান্তসীমায় চলে এসেছি। এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে দু-চারটি কথা বলে নিবন্ধের ইতি টানব। আমার মতে আওয়ামী লীগ যদি পুরো পরিস্থিতি সতর্কভাবে মূল্যায়ন করে এবং কারও কথা, উসকানি বা সমালোচনা গ্রাহ্য না করে নিজেদের সুবিধামতো নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে তবে তারা বিনা বাধায় তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে পারবে। অন্যদিকে, রূঢ় বাস্তবতা, দেশীয় রাজনীতির ঐতিহ্য অনুসরণ এবং সব মহলকে খুশি করার নীতি নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রশংসা লাভের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার ফাঁদে পড়ে তবে তৃতীয় মেয়াদ তাদের কাছে দুঃস্বপ্নের বিষয়ে পরিণত হবে। লিপিস্টিক উন্নয়নের ফরমুলা অনুসরণ করে সর্বজনপরিচিত, সম্মানিত ও জনপ্রিয় লোকদের নিজেদের দলের অথবা কৌশলে বিরোধী দলের প্রার্থী বানিয়ে একটি আকর্ষণীয় সংসদ উপহার এবং বিগত দিনের চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে যে দৃশ্যমান জনজোয়ার সৃষ্টি হবে তাতে অনেক দুর্নাম-বদনাম, অনিয়মের অভিযোগ ভেসে যাবে।

লেখক : গোলাম মাওলা রনি; সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।

Leave a Reply