বিনোদন

টাকা চাইতে আমার বরাবরই সংকোচ লাগে : মোশারফ করিম

নানা ভঙ্গিতে নাটকের অভিনয় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন মোশারফ করিম। সোস্যাল মিডিয়াতেও তাকে বেশ আলোচনার রয়েছে। বলতে গেলে সকলেই তার ভক্ত। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না ত্যার ক্যারিয়ার সম্পর্কে। একটি জাতীয় দৈনিকে এ সম্পর্কে তার একটি সাক্ষাতকার প্রকশিত হয়েছে। চাঁদপুর টাইমস পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরো হলো।

ছেলেবেলায় যাত্রা দিয়ে আপনার অভিনয়ের শুরু। পরে মঞ্চ, টেলিভিশন ও সিনেমা—সবগুলো মাধ্যমে অভিনয় করেছেন। অভিনেতা হিসেবে এই মাধ্যমগুলোর পার্থক্য কী?

মোশাররফ করিম: পার্থক্য বলার আগে মিলটি বলি: সবগুলোই আর্ট। আমার মনে হয়, অভিনয়ের একটা সুর আছে—সেই সুরটি যখন তৈরি হয় তখন চরিত্র, অভিনেতা ও দর্শক একাকার হয়ে, মিলেমিশে যান।

যাত্রাভিনয়ের একটা সুরেলা ধরন আছে, আবার মঞ্চাভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজনার ডিজাইন অনুযায়ী ঠিক করা হয়, কোন ধরনের অভিনয় হবে—বাস্তবধর্মী না অন্য কোনো রীতির। আসলে মঞ্চনাটক, টেলিভিশন নাটক বা সিনেমা—এগুলো তো কোনো নির্দিষ্ট ছক বা ফর্মে বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়। আমার মনে হয়, সেটি উচিতও নয়। অভিনয়ের ক্ষেত্রে আগে তো সুরটি তৈরি হতে হবে। তবেই না চরিত্র, অভিনেতা ও দর্শক হবেন একাকার। এ কারণে অভিনয়ে মাধ্যমের পার্থক্য নিয়ে বলা মুশকিল; বরং বলতে পারি, মঞ্চনাটকে অভিনয় করতে গিয়ে চরিত্রের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ বসবাসের সুযোগ পেয়েছি আমি। এর স্বাদই আলাদা। আর শেষ পর্যন্ত আমি অভিনেতাই, মাধ্যম অত বড় বিষয় না আমার কাছে।

চরিত্র, অভিনেতা ও দর্শকের একাকার হওয়ার যে বিষয়টি বললেন, এই সময়ের নাটকে তা কি পান?

মোশাররফ: সব নাটকে পাই না, তবে কখনো কখনো পাই। এ ক্ষেত্রে অনেক দিন ধরে যে অসুবিধাগুলো বোধ করছি, প্রথমে সেগুলো বলি: আমাদের নাটকে চমৎকার গল্পের অভাব নেই। কিন্তু খামতি হলো সংলাপের। সংলাপ নাটকের মূল অলংকার। সেখানেই ঘাটতি। মানসম্মত নাট্যকারেরা এখন নাটক লেখা ছেড়েছেন। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রাপ্য সম্মানী তাঁরা পান না। তো, কেন তাঁরা নাটক লিখবেন?

সমস্যা কি শুধু সংলাপ বা মানসম্মত নাট্যকারেরা নাটক না লেখায়?
মোশাররফ: না। শিল্প নির্দেশনা, ভালো মেকআপশিল্পী, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক—সব ক্ষেত্রে চলছে কম্প্রমাইজ। এমনও দেখা যায়, চিত্রগ্রাহক তাঁর মনমতো লাইট করতে পারছেন না। সবখানে তাড়াহুড়া—তাড়া তাড়া তাড়া।

এই তাড়াহুড়া কেন?
মোশাররফ: দ্রুত শুটিং শেষ করতে হবে। কেননা, সময় নেই, বাজেটও অপ্রতুল। আবার ধরুন, একটা দৃশ্যে অভিনয় করার জন্য অভিনেতার যে পরিমাণ মনঃসংযোগ ও প্রস্তুতির দরকার, অধিকাংশ সময়ে তাঁরা সেটা পান না। কেন? সময় নেই, বাজেট নেই।

বাজেটই তবে প্রধান অন্তরায়?
মোশাররফ: এটা অন্যতম সমস্যা। কিন্তু অন্তরায় আরও আছে—প্রি-প্রোডাকশন ও পোস্ট প্রোডাকশনে। সবাই নয়—কেউ কেউ প্রি-প্রোডাকশন কাকে বলে এটাই বোঝেন না। আর শিল্পনির্দেশনার ব্যাপারটি বাংলা নাটক থেকে এখন যেন উঠেই গেছে। এসবের প্রধান কারণও ওই বাজেটস্বল্পতা। সাধারণত একটি এক ঘণ্টার নাটকের বাজেট থাকে দুই লাখ টাকা। এত কমে আজকের যুগে ভালো মানের নাটক কি বানানো সম্ভব? যেসব উপকরণের কথা বললাম, এগুলো তো নাটকের কাঁচামাল। এর সুষম সমন্বয় ছাড়া ভালো কিছু হবে কীভাবে? তাই চরিত্র, অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যে যে রসায়ন ঘটার কথা, সেখানে ঘাটতি থাকছে। তার পরও এতসব সীমাবদ্ধতার মধ্যে আমাদের এখানে কিছু অসাধারণ নাটক-সিনেমা হচ্ছে।

কোন বাস্তবতা থেকে বলছেন ‘অসাধারণ’ নাটক-সিনেমা হচ্ছে?
মোশাররফ: বিপুলবিরুদ্ধ বাস্তবতা, মাথার ওপর এমন শিরঃপীড়া নিয়েও অনেক অসাধারণ গল্পের নাটক হচ্ছে। একজন অভিনেতা, পরিচালক, চিত্রগ্রাহক, মেকআপশিল্পী, প্রডাকশন কর্মী—প্রত্যেকের মনের জোরে, স্রোতের বিপরীতে হাল ঠেলে ঠেলে ভালো কিছু কাজ হচ্ছে। এগুলো তাঁদের প্রেমের ফসল। এমনও তো দৃষ্টান্ত আছে, ভালো একটি কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই শিডিউলের অতিরিক্ত সময় দিচ্ছেন, রাত জেগে কাজ করছেন, টাকাও নিচ্ছেন না অনেক ক্ষেত্রে। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, জীবনীশক্তি ক্ষয় করে আমরা এখন নাটক করে যাচ্ছি। এই পুরো ব্যাপারটা একসময় কিন্তু ক্লান্তিকরও লাগে। এভাবে হয় না।

অনেক পরিচালককে এখন কেবলমাত্র আপনার ভরসায় নাটক করতে দেখা যায়। তাঁদের ধারণা, যেহেতু নাটকে আপনি আছেন, আপনিই এগিয়ে নেবেন গোটা নাটক। কীভাবে দেখেন বিষয়টিকে?

মোশাররফ: লক্ষণটা সামগ্রিক নাট্যশিল্পের জন্য সুখকর নয়। তবে এখানে আমিই-বা কী করব? যখন দেখি গল্প অনুযায়ী সংলাপ মিলছে না, সে সময় হয়তো পরিচালকের সঙ্গে পরামর্শ করে সংলাপে খানিকটা পরিবর্তন আনি—মেরামত করি। তবে কী জানেন, তাৎক্ষণিকভাবে মেরামত করা যায়, অসাধারণ কিছু হয় না। তা ছাড়া এটা আমার কাজও নয়। অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমি নাটকের একটি অনুষঙ্গ—এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু কোনো শিল্পীর ওপর এককভাবে নির্ভর করাটা ভালো নয়। নাটক একটি সম্মিলিত কাজ। সবাই মিলে করলেই সেটি সবচেয়ে সুন্দর হয়।

আপনাকে কেন্দ্রে রেখে পরিচালকেরা যে নাটক বানাচ্ছেন, সংশ্লিষ্ট অনেকের অভিমত, এতে একটি নাটকের যে বাজেট তার বড় অংশ চলে যাচ্ছে আপনার সম্মানীর খাতে। ফলে অন্যান্য শিল্পী থেকে শুরু করে নাটকের বিভিন্ন নাটক নিয়েই কি এত ভাবনা?পর্যায়ে জোড়াতালি দিতে হচ্ছে। কী বলবেন?

মোশাররফ: সম্মানী মানে আপনি কি টাকার কথা বলছেন? যদি টাকার কথা বলেন, তবে আমার উত্তর দিতে সুবিধা হয়। সত্যি বলতে, আমার সম্মানীর পরিমাণ কত হবে, এটা আমি কখনো নির্ধারণ করিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনোই নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে চলি না—বলি না যে আমাকে এত টাকা দেওয়া লাগবে। আমার সম্মানী বাড়িয়েছেন পরিচালকেরা। তাঁদের কথা, ‘ভাই, ডেট দেন, এত টাকা দেব।’ টাকা চাইতে আমার বরাবরই সংকোচ লাগে। আমার একটা নীতি আছে, আগে থেকে কাউকে দেওয়া শিডিউল বাদ দিয়ে বেশি টাকার জন্য অন্য পরিচালকের নাটক করব—এমন মানুষ আমি নই। এই বাজার, মিডিয়া, চ্যানেল, স্পনসরের লোকজন—সবকিছু মিলে ঘটনাটি ঘটেছে। আমার কথা হলো, একজন অভিনেতা যে সম্মানী নেবেন, তাঁর অবস্থান বা বাজার না থাকলে তো তিনি সেটি নিতে পারবেন না। কিন্তু ওই অভিনেতাকে দিতে গিয়ে অন্য সব জায়গায় কম্প্রমাইজ করা হবে—এটা ব্যবসায়িক দুর্বলতা ও অসততা। এ কিন্তু পরিচালকের দোষ নয়। বাজেটের কথা বলছি তো এ কারণেই।

এক খণ্ডের নাটকের বাজেট কত হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

মোশাররফ: অন্তত পাঁচ লাখ। তা না হলে হাজার চিৎকার করলেও নাটক বাঁচবে না।

বাজারের কথা বললেন আপনি। বাজারের সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের ব্যাপারটিও চলে আসে। আপনি কি তবে পণ্য?

মোশাররফ: এখানে আমি পেশাদারী মনোভাব নিয়েই কাজ করতে এসেছি। তবে পণ্যই যদি হই, সেই পণ্যের কোয়ালিটি কী, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই অর্থে অমিতাভ বচ্চন বা শাহরুখ খানও তো পণ্য। ব্যবসায়ী দ্বারাই তো নিয়ন্ত্রিত সবকিছু। নাটক হবে, নাটক নিয়ে ব্যবসা হবে—এই তো স্বাভাবিক। তবে ব্যবসাটা যেন নাটককে বাঁচিয়ে হয়।

আপনি অনন্য অভিনেতা। কারও কারও অনুযোগ, আপনার অভিনয়-ক্ষমতার ব্যবহার হচ্ছে না ঠিকমতো…

মোশাররফ: দেখুন, আমার কাজের জায়গায় আমি তো সব সময় স্বাধীন না। পুরোপুরি পেশাদারি পদ্ধতি যেটা বলে—তার মধ্য দিয়ে তো আমি বা আমরা কেউই যেতে পারছি না। সেই অবকাঠামোই গড়ে ওঠেনি এখানে। তাই আমি আসলে কী করতে পারতাম, কত দূর যেতে পারতাম, তা আমার অজানা।

এ জন্যই কি ‘টাইপড অ্যাকটিং’ চলে এসেছে আপনার ভেতরে? বিভিন্ন নাটকে ঘুরেফিরে প্রায় একই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যাচ্ছে আপনাকে…

মোশাররফ: বিষয়টি নিয়ে এ বছর থেকে আমি যথেষ্ট সচেতন। এখানে আমারও কিছু সমস্যা ছিল—সবাই নই, কেউ কেউ এসে যখন আমাকে বারবার কাজ করার জন্য অনুরোধ করে, তখন তাৎক্ষণিকভাবে সেখান থেকে নিস্তার পেতে আমিও তাঁদের বলে ফেলি ‘দেখি দেখি’। এই যে দেখি বলে ফেললাম, এতে করে এসে গেল দায়বদ্ধতার প্রশ্ন। অগত্যা গিলতে হলো ঢেঁকি। তো, এভাবে গত দুই বছর আমি ঠিকভাবে নাটক বাছাই করতে পারিনি—এটা আমার সহজ স্বীকারোক্তি। তবে সামনে নতুনভাবে শুরু করতে চাই।

মোশাররফ করিম সম্পর্কে আপনার যা অজানা

* পুরো নাম মোশাররফ হোসেন, ডাকনাম শামীম।

* মাঝেমধ্যে কবিতা লেখেন

* প্রিয় কবি: জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ, আবুল হাসান ও নির্মলেন্দু গ‌ুণ।

* লিখেছেন গান ও মঞ্চনাটক—একলব্য আখ্যান, সীতায়ন, নমরুদের শকুন। নাটক তিনটি মঞ্চস্থও হয়েছে।

* ভালোবাসেন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে।

* প্রিয় বন্ধু—ইউসুফ হাসান অর্ক, ফজলুল কবির তুহিন, আওয়াল ও মিজু।

* লিও তলস্তয়ের বড় গল্প ‘ক্রয়েটজার সনাটা’, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস দিবারাত্রির কাব্য ​ও জীবনান্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ রূপসী বাংলা বদলে দিয়েছে তাঁর জীবন।

* প্রিয় সিনেমা—টুয়েন্টি ওয়ান গ্রামস, অরণ্যের দিনরাত্রি ও দ্য বয় ইন দ্য স্ট্রাইপড পাজামাস ।

* প্রিয় মঞ্চনাটক—তুঘলক, গ্যালিলিও ও হয়বদন। (প্রথম আলো)

নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১০:০০ এএম, ২২ অক্টোবর ২০১৬, শনিবার
ডিএইচ

Share