দেশের ৭০ ভাগ মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকির সম্মুখীন

কয়েক বছর আগে নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড.জিনি পেসোলা তার দলবল নিয়ে আর্সেনিকে আক্রান্ত বাংলাদেশের ১২ হাজার মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তাতে তারা উল্লেখ করেছেন, আর্সেনিকের কারণে অধূমপায়ীরাও শ্বাসকষ্টে ভুগছেন,যা এর আগে জানা যায়নি।

গবেষক ড.জিনি পেসোলা স্পষ্ট করে বলেন,‘শ্বাসকষ্টের অন্যতম কারণ ধূমপান। কিন্তু অধূমপায়ীরা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান।’

এছাড়া আমরা জানতে পেরেছি, আর্সেনিকে আক্রান্তের কারণে ক্যানসার সৃষ্টির পাশাপাশি শরীরের অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও নিস্তেজ হয়ে যায়। আক্রান্তদের বেশির ভাগেরই হাতে-পায়ে ফোস্কা এবং আঙুলের মাথায় পচন ধরে। এছাড়া অনেকেরই বুকে-পিঠে কিংবা জিহ্বা ও মাড়িতে ঘাঁয়ের সৃষ্টি হচ্ছে,যা পরে মারাত্মক ক্যানসারে রূপ নেয়। অনেকের আবার কিডনি, যকৃৎ বিকল হয়ে পড়ে। সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিকযুক্ত পানি পানে এটি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

শুধু যে নলকূপের পানি পান করে মানুষ আর্সেনিকের বিষে আক্রান্ত হচ্ছে তা কিন্তু নয়। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের ৪৩টি জেলার মানুষ বোরো ধানের চালের ভাত খেয়েও মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এই ধানের ভাত খাচ্ছে সমগ্র দেশের মানুষই, ফলে নীরবে-নিভৃতে ঘাতক ব্যাধির প্রসার ঘটছে। যেহেতু বোরো ধান চাষে প্রচুর ভূগর্ভস্থ পানির সেচ দেওয়া হয়, সেহেতু ঐ ফসল আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আক্রান্ত হয়।

বিজ্ঞান বলে, আর্সেনিক একধরনের ধূসর ধাতব পদার্থ। একে সহজে ভেঙে গুঁড়া করা যায়। প্রকৃতিতে সাধারণত দু’প্রকার আর্সেনিক বিদ্যমান—জৈব ও অজৈব আর্সেনিক। জৈব অপেক্ষা অজৈব আর্সেনিক বেশি ক্ষতিকর। পানিতে প্রধানত অজৈব আর্সেনিক বেশি পাওয়া যায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ মাইক্রোগ্রাম। অথচ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন সীমান্ত এলাকার জেলাগুলোতে নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা পেয়েছে ২ থেকে ২ দশমিক ৫ পিপিএম, যা জনস্বাস্থের জন্য মারাত্মক হুমকি। ইতিমধ্যে এর প্রতিফলনও ঘটেছে ব্যাপক হারে। বিশেষ করে উৎতরাঞ্চলের জেলাগুলোতে রীতিমতো দুর্যোগ আকার ধারণ করেছে।

যদিও দেশের ৬১ জেলায় আর্সেনিকের মাত্রাতিরিক্তের খবর পাওয়া গেছে, তথাপি উৎতরাঞ্চলের তুলনায় অন্য সব জেলা কিছুটা কম ঝুঁকিতে রয়েছে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশের ৭০ % মানুষ এখন আর্সেনিক ঝুঁকির সম্মুখীন। তার মধ্যে ২৬৪ উপজেলার মানুষ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। বলে রাখা ভালো, ২৬৪ উপজেলায় আর্সেনিক এক দিনেই আক্রান্ত হয়নি, এটি ধীরে ধীরে মাটির নিচ দিয়ে ছড়িয়েছে।

১৯৮৮ সালে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দ্য স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ’প্রথম একটি গবেষণা চালায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায়। সেই গবেষণায় আর্সেনিকের অবস্থান নির্ণয় হয় পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত গঙ্গা-ভাগীরথী নদীর পূর্ব প্রান্েত ৭০ থেকে ২০০ ফুট মাটির নিচে। প্রায় ৩৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃতিও ধরা পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘গ্রীষ্মকালীন ফসলের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক ব্যবহারের কারণে মাটির কম্পোজিশনে পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের দূষণ ঘটে।’

আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকেই এখনো জানেন না আর্সেনিক আসলে কী? তারা আর্সেনিকের বিষে আক্রান্ত হয়ে বিশেষ করে হাতের তালু, পায়ের তালু কিংবা শরীরে কালচে বাদামি রঙের দাগ নিয়ে কবিরাজ বা হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে মামুলি চর্মরোগ হয়েছে বলে জেনে আসেন।

এতে করে ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তারা যে মৃতু্যর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ এই আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে যে তাদের প্রস্রাবে ১০০ থেকে ১৮০ শতাংশ বেশি আর্সেনিক রয়েছে, যার ফলে মৃতু্য অবধারিত। এ থেকে বাঁচার কোনো পথ নেই বলেও দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা আরো একটি ভয়ানক তথ্য জানিয়েছেন,‘আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা নেই বললেই চলে।’ তবে তারা সামান্য আশার আলো দেখিয়েছেন,আক্রান্ত ব্যক্তিকে দীর্ঘদিন বিশুদ্ধ পানি ও পুষ্টিকর খাবার খেতে দিলে সেই রোগী স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ফিরে পেতে পারেন, যা দেশের দরিদ্র জনসাধারণের জন্য মোটেও সম্ভব নয়। এই হতাশাজনক সংবাদটি শোনার পর আমাদের করার কিছু নেই মনে করে চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। এ মহামারি থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে।

জনগণকে নিরাপদ পানি পানে উৎসাহিত করতে হবে। বিশেষ করে উৎসাহিত করতে হবে বৃষ্টির পানি পানে। তার সঙ্গে জানাতে হবে সহজ উপায়ে বৃষ্টির পানি ধারণ ও সংরক্ষণের অত্যাধুনিক কৌশল। জানাতে হবে ভূগর্ভস্থ পানি কম ব্যবহার করে মাটির উপরিভাগের পানি বেশি ব্যবহার করতে হবে। তার সঙ্গে আরো জানাতে হবে, পানযোগ্য পানির উৎসের আশপাশে টয়লেট স্থাপন করা যাবে না।

কারণ টয়লেটের বর্জে্য মাটির কম্পোজিশন ঘটে, যাতে পানি দূষণ ঘটায় দ্রুত। এর জন্য অবশ্য ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে। এ ব্যাপারে এনজিও,পরিবেশবাদী সংগঠন ও আমাদের প্রচারমাধ্যমগুলোর বলিষ্ঠ ভূমিকা একান্ত প্রয়োজন, তাহলে আক্রান্েতর সংখ্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

লেখক : আলম শাইন, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট ,
৮ জানুয়ারি ২০২২

এজি

Share