Home / জাতীয় / আদালতে মায়ের আর্তনাদ ও মমতাময়ী বিচারপতির ভূমিকা
মোবাইল ফোনে মামলা পরিচালনার কথা চিন্তা করছে হাইকোর্ট
ছবি : হাইকোর্ট

আদালতে মায়ের আর্তনাদ ও মমতাময়ী বিচারপতির ভূমিকা

‘রাজায় চেনে ধন, শিশু চেনে মন’—খনার বচনটি আবারও সত্য প্রমাণ হলো মমতাময়ী এক বিচারপতির ভূমিকায়। কান্না থামাতে ১৮ মাসের এক শিশুকে কোলে তুলে নিলেন বিচারপতি। প্রকাশ্য আদালতে এজলাসে নিজের চেয়ারের সামনে ডায়াসে বসিয়ে চকোলেট দিলেন শিশুটিকে। থেমে গেল শিশুটির কান্না। এ ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের হাইকোর্টে। গতকাল সোমবার সকালে টাঙ্গাইলের শিশু অংশুমানকে কোলে নিয়ে আদর করলেন বিচারপতি নাইমা হায়দার। আর আদেশ দিলেন—শিশুটি আপাতত খালার হেফাজতেই থাকবে। তবে মাঝেমধ্যে মাকে দেখতে দিতে হবে।

বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ৬ মে দিন ধার্য করেছেন। এদিন পর্যন্ত শিশুটি খালার কাছেই থাকবে। এ ছাড়া নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ায় টাঙ্গাইলের ‘ক’ অঞ্চলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নুর-ই আলম সিদ্দিকীকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত।

গতকাল আদালতে মায়ের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম ও অ্যাডভোকেট শামীমা ইসলাম মৌ। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. অজিউল্লাহ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। খালা শোভা রানী গুহের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট সুব্রত সাহা।

নিজের ১৮ মাসের সন্তান অংশুমানকে ফেরত পেতে মা জেবা রানী দের করা এক আবেদনে শিশুটিকে আদালতে হাজির করতে গত ৩ এপ্রিল আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ওই নির্দেশে গতকাল শিশুটিসহ তার খালা শোভা রানী গুহ ও খালু বিপ্লব গুহকে হাইকোর্টে হাজির করা হয়। এ ছাড়া শিশুটির নানি, মামা ও বাবা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

শিশুটিকে খালার হেফাজতে রাখার আদেশ প্রদানকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নুর-ই আলম সিদ্দিকী আদালতে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আবেদন করেন। আদালত তাঁকে সতর্ক করে দিয়ে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতির আদেশ দেন। এরপর শিশুটি কার কাছে থাকবে তা নিয়ে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আপাতত খালার হেফাজতে রাখার আদেশ দেন আদালত।

এর পরই পাল্টে যায় আদালতের পরিবেশ। শিশুটির মা কাঁদতে কাঁদতে তার ছেলেকে কোলে নেওয়ার জন্য আকুতি জানাতে থাকেন। আদালতে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আদালত মায়ের কোলে দেওয়ার আদেশ দিলে শিশুটিকে কোলে নেন মা। কিন্তু মায়ের কোলে যেতেই কান্না জুড়ে দেয় শিশুটি। এ অবস্থায় বিচারপতি নাইমা হায়দার শিশুটির কান্না থামাতে নিজেই শিশুটিকে কোলে তুলে নেন। বিচারপতির নির্দেশে মায়ের কাছ থেকে শিশুটিকে আদালতের এক কর্মচারী এজলাসে তুলে দেন। এরপর বিচারপতি তাঁর চেয়ারের সামনে নিজের দিকে মুখ করে ডায়াসে বসিয়ে একটি ললিপপ ধরিয়ে দেন। শিশুটিকে আদর করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর শিশুটিকে তার খালার কাছে দেওয়া হয়।

এর আগে শুনানিকালে আদালত শিশুটির নানি ও মামার বক্তব্য জানতে চান। তার নানি আদালতকে বলেন, ‘আমার মেয়ে জেবার দুটি কন্যাসন্তান রয়েছে। আরেক মেয়ে শোভা নিঃসন্তান। জেবা তৃতীয় দফায় গর্ভবতী হলে শোভা এসে তার কাছে দত্তক হিসেবে একটি সন্তান চায়। তখন কথা হয়, ছেলে হোক আর মেয়েই হোক সেটা শোভা নিয়ে যাবে। সে অনুযায়ী শিশুটিকে জন্মের কিছুদিন পর নিয়ে বড় করছে শোভা।’

আদালত মা জেবা রানীর বক্তব্য জানতে চাইলে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমি আর কিছু চাই না। আমার সন্তান ফেরত চাই।’ এ সময় আদালত বলেন, ‘আপনার মা তো বলেছেন যে আপনি জন্মের পরই সন্তানকে বোনের কাছে দত্তক দিয়েছেন।’ জবাবে জেবা রানী বলেন, ‘না, আমি দেইনি। আমার মা ও ভাই মিথ্যা কথা বলছে। আমি আমার বাচ্চা ফেরত চাই। সন্তান ছাড়া আমি বাঁচব না।’ এ সময় আদালত বলেন, ‘মা, আপনি কাঁদবেন না। মামলা তো এখনই শেষ হয়ে যাচ্ছে না।’

টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার চান্দশী গ্রামের বিপুল দে ও জেবা রানী দম্পত্তির সংসারে অংশুমানের জন্ম হয় ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর। সে এখন খালার হেফাজতে। এ অবস্থায় সন্তান ফেরত চেয়ে হাইকোর্টে জেবা রানীর করা আবেদনে বলা হয়, শিশুটির বয়স যখন এক বছর তখন ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর তার মাসি ও মেসো তাকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যান। শিশুটির মা-বাবা সন্তান ফেরত চাইলেও খালা-খালু দিতে অস্বীকার করেন। এ অবস্থায় সন্তান ফেরত পেতে গত ১৬ জানুয়ারি টাঙ্গাইল ক-অঞ্চলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করেন শিশুটির মা। ১৮ জানুয়ারি শিশুটিকে আদালতে হাজির করা হলে তার মায়ের কাছে ফেরত দেওয়া হয়। এরপর ২১ মার্চ উভয় পক্ষের শুনানি শেষে শিশুটিকে আবার তার খালার হেফাজতে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের এই আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ও সন্তান ফেরত চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন শিশুটির মা।