মানজিয়া নূর আমাদেরই মেয়ে। তবে বেড়ে উঠেছেন বিদেশে। এইচএসসি পাসের পরই তিনি ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে।
থাকতেন কুমিল্লার বরুড়ার গ্রামের বাড়িতে। দীর্ঘকাল বিদেশে থাকায় আরবি বা ইংরেজিতে স্বাচ্ছন্দ্য এই মেয়েটি অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন না। আঞ্চলিক ভাষা ভালোভাবে বুঝতেও অসুবিধা হতো খুব।
বাবা মোস্তফা খন্দকার কাতারের কমার্শিয়াল ব্যাংকের ম্যানেজার। সেই সূত্রে প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই মায়ের হাত ধরে চলে গেলেন কাতারে। তাঁর লেখাপড়ার শুরু এমইএস ইন্ডিয়ান স্কুলে। ওই স্কুল থেকেই তিনি ২০১২ সালে এসএসসি সমমানের পরীক্ষায় পাস করেন। দুই বছর পর আমাদের এইচএসসি। অত্যন্ত কৃতী এই ছাত্রীর এসএসসিতে স্কোর ছিল ১০ আর এইচএসসিতে তিনি ৯৬.৬ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন।
তবে মানজিয়া যতটা না তাঁর মেধার কথা বললেন, তার চেয়েও অনেক বেশি বললেন শিক্ষকদের অবদানের কথা—‘আমাদের স্কুলের পরিবেশ আসলেই খুব ভালো ছিল। এখনো সেটি আমি মিস করি। ক্লাসে শিক্ষকরা এত যত্ন করে ধরে ধরে পড়াতেন যে বাসায় এসে বই খুলে বসতে হতো না। কোনো দিন প্রাইভেট পড়িনি, কোচিংয়েও যাইনি। তাঁদের মধ্যে আমি বাঙালি, তাঁরা ভারতীয়—এই ভেদাভেদটুকুও ছিল না। ’
জীবনের প্রথম কোচিং সেন্টারে যাওয়া শুরু করলেন মেডিক্যালে ভর্তি হবেন বলে। চট্টগ্রামের একটি ইংলিশ মিডিয়াম কোচিংয়ে পড়েছেন মানজিয়া। তখন তিনি খালার বাসায় থাকতেন। ২০১৪-১৫ সেশনে পুরো বাংলাদেশের ১১০তম হয়ে তিনি ভর্তি হলেন রাজশাহী মেডিক্যালে।
তবে বাসা থেকে অনেক দূর আর হলে থাকতে চাইতেন না বলে পরে মাইগ্রেশন করে চলে এলেন কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজে। তবে তাঁর ভয় ছিল—কিভাবে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেবেন? ফলে একদিন বড় বোনের সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজ ঘুরে দেখলেন। ভালোই লাগল।
২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি জীবনের প্রথম মেডিক্যালের ক্লাসে গেলেন মানজিয়া। সেদিন তাঁদের নবীনবরণ হয়েছিল। অপরিচিত এই পরিবেশে এক কোণে বসে বসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করলেন। শিক্ষকদের নানা পরামর্শও শুনলেন।
প্রথম দিকে স্যাররা ক্লাসে কী পড়াচ্ছেন বুঝতে খুব অসুবিধা হতো, যেহেতু বাংলায় তিনি সড়গড় নন। তার পরও বন্ধুদের সাহায্যে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে লাগলেন। প্রথম মিড টার্মের ফলাফলে দেখলেন—শরীরতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব এবং জৈব রসায়নে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছেন তিনি। এর পর থেকে আরো ভালো করে লেখাপড়া শুরু করেন। পরের টার্মেও বিষয়গুলোতে সেরা হন তিনি।
তবে তৃতীয় টার্মে এসে রেজাল্ট খারাপ হয়ে গেল। দেহতত্ত্বে সপ্তম হলেন। বাকিগুলোতে সেরাদের আশপাশেও তাঁর নামটি নেই। তার পরও লেগে থাকলেন। কেন এমন হলো—এই প্রশ্নের জবাবে মানজিয়া নূর ফিরে গেলেন মেডিক্যালের প্রথম দিকের জীবনে, ‘শরীরস্থান পড়তে গিয়ে হাড়ের নামগুলো মুখস্থ করতে পারতাম না। মনে থাকত না। কোনো দিন তো মুখস্থ করিনি, ফলে মুখস্থবিদ্যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে অনেক ঝামেলা হলো। ’
এ বছরের ৮ মে চট্টগ্রাম মেডিক্যালের অধীনে ১৪টি সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যালের এমবিবিএস প্রথম পর্বের ফলাফল বেরিয়েছে। সেখানে সাত হাজার ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি সবার সেরা হয়েছেন। তবে এই দারুণ সাফল্যের পেছনে আগের মতোই শিক্ষকদের অবদানের কথা স্বীকার করলেন ছাত্রীটি—‘কোনো কিছু বুঝতে না পারা এই আমাকে তাঁরা যেভাবে গাইড করেছেন, এই ফল তার প্রমাণ। ’
মেধাবী এই ছাত্রী এখন বই নিয়ে দিন কাটান। আর পুরনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জীবনটিকে মিস করেন—“কাতারে থাকার সময় আমাদের স্কুলে খেলাধুলায় আমার অনেক সাফল্য ছিল। এ জন্য আমাকে সবাই চিনত।
বল নিক্ষেপ ও রিলে বল নামের দলগত খেলায় তৃতীয় পুরস্কার পেয়েছি। এইটে থাকতে আশপাশের আরব দেশ ও ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে ‘ন্যাশনাল ট্যালেন্ট সার্চ’ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। আর নাইনে থাকতে একই প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক পেয়েছি। ” তখন তিনি ব্যঙ্গ রচনা লিখতেন, অভিনয়ও করতেন। ২০১০ সালে ব্যঙ্গ রচনা লিখে স্কুলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন।
তার আগের বছর পোস্টার ডিজাইনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। সেই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল কাতার ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন। ক্লাস সিক্স থেকে এইট পর্যন্ত ক্লাস বুলেটিনে লিখে টানা চার বছর সবার সেরা হয়েছেন। সব শখ ছেড়ে দিলেন ডাক্তার হওয়ার জন্য? ভবিষ্যতে কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবেন—এই প্রশ্নের জবাবে মেধাবী মেয়েটি বললেন, ‘স্নায়ুতত্ত্ব নিয়ে লেখাপড়ার খুব শখ। ’ (ছবি : হুমায়ূন কবীর জীবন, উৎস- কালেরকণ্ঠ)
নিউজ ডেস্ক ।। আপডটে, বাংলাদশে সময় ০৯ : ৩০ এএম, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ শুক্রবার
ডিএইচ