Home / জাতীয় / ইলিশের উৎপাদন এবার ৬ লাখ টনে পৌঁছতে পারে
ELISH-
ফাইল ছবি

ইলিশের উৎপাদন এবার ৬ লাখ টনে পৌঁছতে পারে

ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে জাটকা আহরণ, বিপনন ও পরিবহনে ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল ১ জুলাই রাতের প্রথম প্রহর থেকে। ১ নভেম্বর থেকে ৮ মাসের এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নির্বিঘœ করতে আশি^নের পূর্ণিমার আগে পরে গত ৬ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ২৮ অক্টোবর রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত উপক’লের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারে প্রধান প্রজননস্থলে সব ধরনের মাছ আহরনে নিষেধাজ্ঞা ছিল।

একই সময়ে সারা দেশেই ইলিশ আহরন,পরিবহণ ও বিপনন বন্ধ ছিল। ১ নভেম্বর থেকে ইলিশ পোনা-জাটকা আহরণ নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সাগরে চলমান ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপক’লীয় এলাকায় ইলিশ সহ সব ধরনের মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট জানিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে দেশে ইলিশের সহনীয় আহরণ ছিল ৫.৬৭ লাখ টন। যার প্রায় ৭০ ভাগের অহরণ ছিল বরিশাল অঞ্চলে। সদ্য সমাপ্ত অর্থ বছরে ইলিশের উৎপাদন আরো বৃদ্ধির আশা করছে মৎস্য অধিদপ্তর।

মৎস্য গবেষণা ইনসস্টিটিউট-এর মহাপরিচালক ড.ইয়াহহিয়া মাহমুদ জানিয়েছেন, ইলিশের নির্বিঘœ প্রজনন নিশ্চিত করতে গত বছর অক্টোবরে ২২দিনের আহরন,পরিবহন ও বিপননে নিষেধাজ্ঞাকালে উপক’লের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার প্রজননস্থল সহ অভ্যন্তরীন নদ-নদীতে প্রায় ৮৪% মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। ফলে সদ্য সমাপ্ত অর্থ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৬ লাখ টনের কাছে পৌছতে পারে বলেও আশাবাদী মৎস্য বিজ্ঞানীগণ।

জাটকা আহরণ নির্ভরশীল জেলেদের গত ৮ মাসের আহরন নিষিদ্ধকালীন সময়ে খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যে উপকু’লীয় ২০টি জেলার ৯৭ উপজেলার ৩ লাখ ৬১ হাজার জেলে পরিবারের জন্য ৫৭ হাজার ৭৩৯ টন চাল বরাদ্ব ও বিতরন করেছে সরকার। চার মাসে ৪০ কেজি করে এসব চাল বিতরন করা হয়। যারমধ্যে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার ২ লাখ ৩০ হাজার ১৮৭ জেলে পরিবারকে ৩৬ হাজার ৮২৯ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।

জাটকা আহরন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে দক্ষিণাঞ্চল সহ উপকূলীয় এলাকায় এবারো জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং মৎস্য বিভাগের অভিযানে নৌ-বহিনী, কোষ্ট গার্ড, পুলিশ ও র‌্যাব সহ বিভিন্ন আইন-শৃংখলা বাহিনীর সার্বিক সহযোগীতায় ব্যাপক সাফল্য এসেছে। গত ৮ মাসে দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি অভায়াশ্রাম সহ অভ্যন্তীরন ও উপক’লীয় নদ-নদীতে সাড়ে ১১ হাজারেও বেশী অভিযান সহ প্রায় ২ হাজার ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি মিটার নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আইন অমান্য করায় এ সময়ে সাড়ে ১৩শ মামলা দায়ের ছাড়াও ৫০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় এবং ৫৮৪ জন জেলে ও মৎস্যজীবীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করা হয়।

এসব অভিযানকালে মৎস্য বিভাগ সহ আইন-শৃংখলা বাহিনী ৫৬৫ টন জাটকা আটক করে বিভিন্ন এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং-এ সরবারহ করে। জাটকা নিধন বিরোধী অভিযানকালে আটককৃত নৌকা ও মৎস্য আহরন সরঞ্জাম সমুহ নিলামে বিক্রী করে সরকারী কোষাগারে ৬৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকা জমা করা হয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।

এসব অভিযানের ফলে দেশে বিপুল পরিমান জাটকা অবৈধ নিধন থেকে রক্ষা পাওয়ায় ইলিশ সম্পদ আরো সমৃদ্ধ হবার আশা করছেন মৎস্য বিজ্ঞানীগণ।

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, জীবনচক্রে অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। একটি পূর্ণাঙ্গ ইলিশ প্রতিদিন শ্রোতের বিপরিতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলতে সক্ষম। উপক’লের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মূক্তভাবে ভাসমান ডিম ছাড়ার পরে তা থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমুহে বিচরন করে থাকে। এরা খাবার খেয়ে নার্সারী ক্ষেত্রসমুহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়িয়ে জাটকা হিসেব কিছুটা বড় হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পরিপক্কতা অর্জন করে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২Ñ১৮ মাস অবস্থানে প্রজননক্ষম হয়ে ইলিশ আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।

সমুদ্রে যাবার সময় পর্যন্ত যেসব এলাকায় জাটকা খাদ্য গ্রহন করে বেড়ে ওঠে, সেগুলোকে ‘গুরুত্বপূর্ণ নার্সারী ক্ষেত্র’ হিসেবে চিহিৃত করে ‘অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করা হয়েছে। মৎস্য বিজ্ঞানীগণের সুপারিশে বরিশালের হিজলা ও মেহদিগঞ্জের লতা, নয়া ভাঙ্গনী ও ধর্মগঞ্জ নদীর মিলনস্থল পর্যন্ত, ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালী চর রুস্তম পর্যন্ত তেতুুলিয়া নদীর ১শ কিলোমিটার, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার, মদনপুর থেকে ভোলার চর ইলিশা হয়ে চর পিয়াল পর্যন্ত মেঘনার শাহবাজপুর চ্যানেলের ৯০ কিলোমিটার, চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১শ কিলোমিটার, শরিয়তপুরের নড়িয়া থেকে ভেদরগঞ্জ নিম্ন পদ্মার ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত ৬টি অভয়াশ্রমে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে সব ধরনের আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করায়ও ইলিশ সহ সব মাছের উৎপাদন বাড়ছে।

তবে মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, দেশে এখনো নিষিদ্ধ ঘোষিত কারেন্ট জাল ও বেহুন্দি জাল সহ অন্যন্য ক্ষতিকর মৎস্য আহরন উপকরণের সাহায্যে যে পরিমাণ জাটকা আহরন হচ্ছে, তার এক-দশমাংশ রক্ষা করা গেলেও বছরে আরো অন্তত ১ লাখ টন ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেত। মৎস্য বিজ্ঞানীগণ দেশে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ও বেহুন্দি জাল সহ অন্যান্য ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ উপকরণের ব্যবহার বন্ধে আরো কঠোর নজরদারী সহ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহনের তাগিদ দিয়েছেন।

তবে আহরণ নিয়ন্ত্রণ সহ নজরদারী বৃদ্ধির ফলে দেশে জাটকা’র উৎপাদন ২০১৫ সালে ৩৯,২৬৮ কোটি থেকে ২০১৭ সালে ৪২,২৭৪ কোটিতে উন্নীত হয়। যা পরবর্তি বছরগুলোতেও আনুপাতিকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে ইলিশের উৎপাদনও গত দু দশকে প্রায় ৩গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। সারা বিশে^ উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৬৫Ñ৭০% এখন বাংলাদেশে উৎপাদন ও আহরিত হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান এখন ১%-এরও বেশী, আর মৎস্য খাতে প্রায় ১২%।

এদিকে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র ও মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘœ রাখা সহ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুত ও জীব বৈচিত্রকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে ২০১৯-এর ২৬জুন থেকে হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা’ বা ‘মেরিন রিজর্ভ এরিয়া’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। যা মূল প্রজনকাল সহ সারা বছরই সংরক্ষিত এলাকায় ইলিশের নির্বিঘœ প্রজনন নিশ্চিত করণে বড় ভ’মিকা রাখছে।

৪ জুলাই ২০২৩
এজি