শিশুর পুষ্টি,জীবন ধারণ এবং শারিরীক বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত শিশু খাদ্য অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। মহান সৃষ্টিকর্তা মানব দেহ থেকে সন্তানের জন্য শুধুমাত্র একটি খাদ্য আহরণের ব্যবস্থা রেখেছেন,আর সেটি হচ্ছে মায়ের বুকের দুধ।
শিশুর সুস্বাস্থ্য,পুষ্টি ও বেঁচে থাকার জন্য তিনটি নির্ধারক আছে। এগুলো হলো,নিরাপত্তা, যতœ ও রোগ নিয়ন্ত্রণ। এ তিনটির সমন্বয়ের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো মায়ের বুকের দুধ। মানব সন্তান পৃথিবীতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহ তাআলার রহমতে প্রতিটি মায়ের বুকে তার অনাগত সন্তানের জন্য খাদ্য প্রস্তুত হতে থাকে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে বুকে দিলেই শিশু তার ক্ষুধা,তৃষ্ণা মিটানোর সুধা পেয়ে যায়।
প্রথমত তিন চারদিন শিশু তার মায়ের বুকের যে দুধ পায় তা শালদুধ। শালদুধ পরিমানে কম। কিন্তু জন্মের পরপর শিশুর অপরিপক্ক পাকস্থলির সীমিত ধারন ক্ষমতার জন্য তা যথেষ্ট। এ শালদুধ শুধু যে শিশুর ক্ষুধা ও তৃষ্ণা মিটায় তা নয়, শিশুকে সুস্থ রাখার জন্য বিভিন্ন উপাদান সরবরাহ করে। যে কারণে,শালদুধকে বলা হয় জীবনের প্রথম টিকা।
মায়ের দুধ পানে শুধুমাত্র শিশুরাই উপকৃত হয় না বরং মায়েরা,তাদের পরিবার এবং সামগ্রীকভাবে সমাজও উপকৃত হয়। মায়ের দুধ শিশুর জীবন ধারনের প্রথম ছয়মাসে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় পুষ্টিই সরবরাহ করে না বরং পাচঁটি বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধক হিসেবেও কাজ করে। শৈশবে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার ফলে পরবর্তী জীবনে সে শিশু বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্ত থাকে।
শিশুর শারীরিক গঠন ও শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় মায়ের বুকের দুধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করলে শিশুরা পায় সঠিক পুষ্টি,পায় সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার শক্তি আর মগজের বিকাশের জন্য সব ধরণের পুষ্টি উপকরণ। শিশুরা পায় শ্রেষ্ঠ সুরক্ষা।
শ্বাসনালি সংক্রমণ, ডায়রিয়া ও অন্যান্য জীবনঘাতী রোগ থেকে রক্ষা পায়। শিশুরা সুরক্ষা পায় স্থুলতা থেকে,অসংক্রামক রোগ, যেমন,হাপানি ও ডায়াবেটিস থেকেও। মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য প্রতিষেধক।
এছাড়া এতে শিশুর বুদ্ধিদীপ্ততা ও চোখের তীক্ষèতা বাড়ায়। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে ঐ মায়ের অল্প সময়ের মধ্যে গর্ভধারণ ঝুকি কম থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো আরম্ভ করতে হবে। কারণ,অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে শিশুদের ডায়রিয়া,শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ, নিউমোনিয়া, কান পাকা,মেনিনজাইটিস ইত্যাদি রোগ থেকে মায়ের দুধ শিশুকে সুরক্ষা করে।
বুকের দুধ পান করানোর মাধ্যমে শুধু শিশুই নয় বরং একজন মা নিজেও উপকৃত হতে পারেন।
আমাদের দেশের মায়েরা নবজাতক শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ান। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এ প্রবণতায় কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে মায়েদের বুকের দুধ খাওয়ানোর উপর ব্যাপক প্রচারণার ফলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত ৫ বছরে ৬ মাস বয়সী শিশুদের শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার ৪৭ % থেকে বেড়ে বর্তমানে ৬৪ শতাংশ দাড়িয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী জন্ম থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত পৃথিবীর সকল শিশুকে শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানো হলে বছরে ১৫ লাখেরও বেশি শিশুর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের এক জরিপ প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে শিশুর মাতৃদুগ্ধ পানের হারে বাংলাদেশের আরও এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা ফর্মুলা দুধের আগ্রাসী বিপণন। বাংলাদেশ ছাড়াও চীন,মেক্সিকো,মরক্কো,নাইজেরিয়া,দক্ষিণ আফ্রিকা,যুক্তরাজ্য ও ভিয়েতনামে এ জরিপ হয়।
জরিপে এসব দেশের সাড়ে ৮ হাজার মা-বাবা ও অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং ৩শ স্বাস্থ্যকর্মী অংশ নেন। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী এসকল দেশের মধ্যে বাংলাদেশেই শিশুদের মাতৃদুগ্ধ পানের হার সবচেয়ে বেশি।
এ হার চীনে ২১,ভিয়েতনামে ২৪,মেক্সিকো ও নাইজেরিয়ায় ২৯,দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩২ এবং মরক্কোয় ৩৫ শতাংশ। জরিপে অংশগ্রহণকারী মা-বাবা ও অন্তঃস্বত্ত্বা নারীদের ৫১ % বলেছেন,তারা ফর্মুলা দুধ বিপণনকারী কোম্পানীগুলোর ‘লক্ষ্যনির্দিষ্ট’ বিপণন কার্যক্রমের শিকার হয়েছেন।
যুক্তরাজ্যে জরিপে অংশ নেয়া ৮৪ % নারী ফর্মুলা দুধের বিপণন ব্যবস্থার শিকার হওয়ার দারি করেছেন। তার কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগই শিশুদের খাওয়ানোর রীতির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদন্ড লঙ্ঘন করেছে। তবে, অন্য দেশের নারীদের তুলনায় বাংলাদেশের নারীরা ফর্মুলা দুধের প্রথাগত বিপণনের শিকার কম হন।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকারকে মায়ের দুধ ও সম্পুরক খাদ্যের বিষয়ে জোর প্রচারনায় নামতে হবে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে মায়ের দুধে ২০০টি পুষ্টি উপদান রয়েছে। পৃথিবীর আর কোন একক খাদ্যে এতো পুষ্টি নেই।
পুষ্টি বিজ্ঞানীরা আরো বলেন, জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের দুধ দেয়া শুরু করলে অন্ততঃ ৩৭ হাজার নবজাতকের প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব। অন্যদিকে গুড়ো দুধ বা অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত শিশুখাদ্য শিশু মৃত্যুর হার ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়।
শিশুর জন্য খাদ্য হিসেবে মায়ের দুধ সোনার মানদন্ড স্বরুপ। সকল গর্ভবতী মাকে শিশু ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর বুকের দুধ দেওয়ার আগ্রহ বাড়াতে হবে। মা ও শিশুর অপুস্টি, সুস্থ জাতি গঠনের অন্যতম প্রধান অন্তরায়।
তাই প্রসব পরবর্তী মায়ের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য সুনিশ্চিত করতে হবে, যেন তার শিশু পর্যাপ্ত পরিমানে বুকের দুধ পায়। আমাদের সকলের উচিৎ সব মাকে এ মর্মে সচেতন করা যে,একজন মা একটু ধৈর্য সহকারে চেষ্টা করলেই তার সন্তানকে সফলভাবে বুকের দুধ পান করাতে সক্ষম।
পবিত্র কোরআনে নবজাতককে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর সময়সীমা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে -’যে স্তন্যপানকাল পূর্ণ করতে চায়,তাঁর জন্য জননীরা তাঁদের সন্তানদের পূর্ণ দু’বছর দুগ্ধপান করাবেন। জনকের কর্তব্য যথাবিধি তাঁদের ভরণপোষন করা’ (সুরা আল বাকারা, আয়াত-২৩৩)।
২ মার্চ ২০২২
এজি