একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে অতিরিক্ত মদপান করিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হন ফারজানা জামান নেহা ওরফে ডিজে নেহা। মৃত ছাত্রীর বাবার দায়ের করা মামলায় অন্যতম আসামি এই নেহা। গ্রেফতারের পর মামলা সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে ৫ দিনের পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
এদিকে গণমাধ্যমে ফাঁস হয়েছে ডিজে নেহার কুকর্মের বেশ কিছু ছবি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ থাকলেও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছে নেহা। তার বাবা একজন মাঝারি স্তরের ব্যবসায়ী। রাজধানীর আজিমপুরে বসবাস করেন। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুরান ঢাকায়। অন্যদিকে নেহার মা থাকেন মিরপুরে। দীর্ঘদিন ধরে তার বাবা-মায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। একরকম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে বেড়ে ওঠেন নেহা।
পড়াশোনাও বেশ দূর করতে পারেননি নেহা। মেধাবী হলেও স্কুলের গন্ডিতেই আটকে যায় পড়াশোনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নেহা বিপথে যাওয়ার নেপথ্যে তার বাবা-মায়ের দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব উল্লেখযোগ্য।
কয়েক বছর আগে কথিত লন্ডন প্রবাসী এক ব্যক্তির সঙ্গে নেহার বিয়ের কথাও শোনা যায়। সেই ব্যক্তি নেহাকে লন্ডনে নেওয়ার কথা বললেও বিভিন্ন অজুহাতে সেখানে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন নেহা। তবে, নেহার বিয়ের বিষয়ে পুলিশ সন্দিহান।
দিনে ঘুমে থাকলেও রাতে ডিজে ও মদের পার্টিতে অশ্লীল রকমের উদ্যাম নাচানাচিতে মেতে ওঠতেন নেহা। পরতেন ওয়েস্টার্ন পোশাক। পার্টিতে শিশার পাইপ দিয়ে স্লো মোশনে ধোঁয়া ছাড়াই ছিল তার নেশা। বেশ কিছু ছবিতে দেখা গেছে, দামি বিদেশি মদের বোতল নিয়ে চুমো দিতে।
নিজের কোনো আয় না থাকলেও নামি-দামি ব্রান্ডের গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এই নারী। টার্গেট ছিল ধনী পরিবারের তরুণ-তরুণীদের বাগে আনা। তাদের দিয়ে চালাত দেহ ব্যবসা। এক কথায় রূপের ঝলক দেখানো ডিজে নেহা নানান কুকর্ম ও অশ্লীলতার মধ্যেই ডুবে ছিলো।
নামি দামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাই ছিল নেহার শিকার। তাদের বশ করতে একাধিক তরুণ-তরুণী তার হয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতো। শিশা পার্টি, মদ পার্টি এবং অশ্লীল নাচের আয়োজনে দাওয়াত পেত সমাজের উচ্চ বিত্তের সন্তানরা। যারা নেহার হাত ধরেই বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে যেতেন।
সকল অপকর্মের হোতা ডিজে নেহার কপাল খুলতো শিশা লাউঞ্জ ও মদের পার্টিতে। এসব পার্টিতে আসা ধনী পরিবারের তরুণ-তরুণীরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হত। ভালো লাগা থেকে একান্তে মিলিত হতে চাইলে ডিজে নেহার সঙ্গেই যোগাযোগ করতে হতো। এখান থেকেই শিকারদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতেন মোট অংকের টাকা। তার এই অবৈধ অর্থকড়ির খোঁজে নেমেছে গোয়েন্দারা।
সূত্র জানায়, ভালো লাগা তরুণী-তরুণীদের একান্তে মিলিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ঢাকা ও ঢাকার বাইরের একাধিক আবাসিক হোটেল এবং রিসোর্টের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো নেহার। তাছাড়া নেহার এসব পার্টিতে মাদক সরবরাহ করত অবৈধ মাদক কারবারিরা।
গত মাসের শেষ দিকে মদ পানের পর অস্বাভাবিকভাবে মারা যায় ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মাধুরী ও তার বন্ধু আরাফাত। এ ঘটনায় মামলা হলে আলোচনায় চলে আসেন নেহা।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২৮ জানুয়ারি বিকাল ৪টার দিকে মর্তুজা রায়হান ওই শিক্ষার্থীকে নিয়ে মিরপুর থেকে স্কুটার করে লালমাটিয়ায় আরাফাতের বাসায় নিয়ে যান। পরে আরাফাত, ওই শিক্ষার্থী ও রায়হান একসঙ্গে উবারে করে উত্তরার তিন নম্বর সেক্টরের প্যারাডাইস টাওয়ারের ‘বাম্বুসুট রেস্টেুরেন্টে’ যান। সেখানে আসামি নেহা, শাফায়েত জামিলসহ (২২) আসামিরা মদ পান করেন এবং ভিকটিমকে মদ পান করান।
একপর্যায়ে ভিকটিম অসুস্থবোধ করলে রায়হান তাকে মোহাম্মদপুরে বান্ধবীর বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে নুহাতের বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে রায়হান ভিকটিমকে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের পর রাতে ভিকটিম অসুস্থ হয়ে বমি করলে রায়হান তার আরেক বন্ধু অসিম খানকে ফোন দেয়। অসিম পরদিন এসে ভিকটিমকে প্রথমে ইবনে সিনা ও পরে আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি করেন। দুইদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ভিকটিম মারা যান।
এ ছাড়া তার সঙ্গে থেকে মদপান করা আরও এক সহপাঠী আরাফাত রাজধানীর সিটি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
এ ঘটনায় মর্তুজা রায়হান চৌধুরী ও বান্ধবী নুহাত আলম তাফসীরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ছাড়া শাফায়াত নামে অপর আসামি আদালতে আত্মসর্ম্পণ করেন। তাকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। এই মামলার সর্বশেষ আসামি নেহাকে আজিমপুরের একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাকে গ্রেফতার করা হয়। নেহার অপরাধ নেটওয়ার্কিংয়ে মাধ্যমেই উল্লেখ্য ৫ জন একে অপরে বন্ধুতে রূপান্তরিত হয়ে বলে জানা গেছে।
নেহা সম্পর্কে তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশীদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, প্রতিদিন ওয়েস্টার্ন দামি দামি সব ড্রেস পড়ে বার ক্লাবে যেতো ডিজে নেহা। ব্যবহার করতো দামি ব্রান্ডের সব মেকআপ। আর এমন রূপের ঝলক দেখিয়ে আয়োজন করতেন ডিজে পার্টির। সেই পার্টিতে নিয়ে আসা হতো ধনী পরিবারের সন্তানদের। সেখান থেকে অনৈতিক কার্যকলাপ। এটাই ছিলো নেহার আয়ের উৎস।
গত শুক্রবার নেহাকে ৫ দিনের রিমান্ডে আনে পুলিশ। সে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছে। পরিবার ও স্বামীর সঙ্গ দূরত্বের কারণে সে এমন অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, রাজধানীতে যারা এধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে পুলিশ। সেই সঙ্গে এই বিষাক্ত মদ কোথা থেকে এসেছে। নেহার সঙ্গে আর কারা জড়িত তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
ঢাকা ব্যুরো চীফ,৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১