Home / ফিচার / সভ্যতার স্বার্থেই শিল্পী-সাহিত্যকর্মীদের বাঁচাতে পদক্ষেপ জরুরি
jahagir ...

সভ্যতার স্বার্থেই শিল্পী-সাহিত্যকর্মীদের বাঁচাতে পদক্ষেপ জরুরি

খুবই নিরানন্দ ও শঙ্কার মধ্যে কাটছে মানুষের জীবন। করোনা মানুষের জীবন যাপনের সর্বত্রই টুটি চেপে ধরেছে।মানুষের সাথে সকল জীব- জড়কেও পঙ্গু করে দিয়েছে।তাই সভ্যতা পিছুটানের উন্মত্ত জিঘাংসায় দুলে আছে।অশনির মেরুকরণে অসভ্যতাও যোগ দিয়ে থাকে এটাই স্বাভাবিক।

তাই মানুষের আপদ -বিপদ দেখে কতিপয় ব্যবসায়ী ও কথিত সেবকরাও সুবিধা লুটে নিচ্ছে। তারপরও মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।স্বস্তির সুধা মেটাতে এবড়ো-থেবড়ো চলছে সব।করোনা মহামারী ঠেকাতে না পারলেও জীবন বাঁচাতে মানুষ এটাকে নিয়ে আর ভাবতে চাচ্ছেনা।তাই সকল পেশাজীবী কমবেশি আলোরপথ দেখতে চেষ্টা করছে অন্ধকার ও কণ্টকাকীর্ণপথ জিইয়ে রেখে। কিন্তু সাহিত্য- সংস্কৃতির সাথে জড়িত শিল্পীগণ মুখ থুবরে আছে। তাই শিল্পীদের পক্ষে নতুন করে কোন কিছু নির্মান অসম্ভব হয়ে পড়েছে।সে কারনেই তারা প্রকট অর্থ সংকটে পতিত।

তাই তারা জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে।সময়ের সাথে সাথে এ মরণ দুর্গ আরও বড় হবে।সুবিধাবাদী মোটা ও চিকন ধনী লুটেরা স্বাস্হ্যবানরা সরকারের কাছে সুবিধা নিতে মরিয়া।’নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ এ নীতিতে হাঁটছেনা কেউ কেউ বরং দৌড়াচ্ছে। এ দৌঁড় খেলায় শিল্প সংস্কৃতিজনদের পক্ষে সম্ভব না, করা উচিতও না।শিল্পীরা অর্থসংকটে কারপও কাছে হাত পাততে পারেনা।

লাজুক এ শিল্পীরা এ জায়গায় দিশা খুঁজে না পাওয়ায় থমকে যাচ্ছে মেধা ও মননশীলতা।এ মুহুর্তে লেখক ও শিল্পীদের বাঁচিয়া রাখতে হবে জাতিকে সভ্য হয়ে রাখার নিমিত্তে।তাই করোনা মহামারিকালে তাদের জীবন জীবিকার ভার সরকার তথা জাতিকেই নিতে হবে।

সে কারণেই করোনা পরিস্হিতিতে আর্থিক দৈন্যতা মোকাবেলায় কোনমতে থাকা খাওয়া, চিকিৎসা ও পোষাক পরিচ্ছদের যোগান দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।যার কারনে সম্মানের সহিত শিল্পীপুলের ব্যবস্হা করে লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীদের প্রণোদনা একান্ত কর্তব্য বলে মনে করছি।যাতে করে এ মাধ্যমটি ধ্বংশ না হয়।শিল্প সংস্কৃতির ভবিষ্যত জীবনকে সামনে রেখে আমার এ নিবন্ধে কিছু বাসনা জুড়ে দিতে চাই সাদামাটাভাবে।

প্রতিটি পরিবারেই কম-বেশি বাজেট হয়ে থাকে। পরিবারের বাজেট প্রণয়নে কর্তার ইচ্ছায়ই কীর্তন হয়ে থাকে। তবে চৌকষ কর্ত্রীর ভূমিকাও কিছু পরিবারে থাকে। আবার অনেক সময় পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অভিলাষ কম গুরুত্ব পেয়ে পরিবারের অপরাপর সদস্যদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই প্রধান হয়ে যায়,এটা হয় ভবিষ্যতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে। পরিবারের সকলের চাহিদা মেটানোর জন্যে বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় পরিবারগুলোতে গণতন্ত্র, বাক্-স্বাধীনতা, অপার স্বাধীনতা, আগ্রহ-অনাগ্রহ উপাদানগুলো সমস্বরে বিদ্যমান। আর এদিকে দেশের আয়ের মূল সূত্র জনগণ।

সে ক্ষেত্রে তাদের মতো করে কিংবা জনগণের পক্ষে বাজেট প্রণয়ন না হওয়া দুঃখজনক ও ক্ষোভানলেরই বিষয়। ছোট রাষ্ট্র পরিবারে যদি সকলের প্রস্তাব অনুযায়ী আর্থিক ব্যয় নির্বাহের বিষয়টি মীমাংসা হয়ে থাকে তাহলে রাষ্ট্রতো আরও সুন্দর নিদর্শন দেখাতে পারে।

পরিস্থিতি ও গুরুত্ব বিবেচনায় এনে এবং বিশ্লেষণ করে বাজেট প্রণয়ন করা উচিত। এবারও বিনোদন- সংস্কৃতি খাত অবহেলিত। সাহিত্যকর্মের জন্য নির্দিষ্ট কোন কিছু নাই।অথচ যে শিল্পী নাটক কিংবা গান করেন,সেটা কিন্তু একজন লেখকই লিখেন।প্রথম লেখককেই লিখতে হয় তারপর হয় প্রদর্শন।

এসব শিল্পী নেপথ্যে থাকার কারণেই দর্শক স্রোতাদের কাছে পরিচিত কম।যেকোন মুহুর্তে কবি লেখকদের ভূমিকা না থাকলে ভাল কাজ সম্পন্ন হতে পারেনা।যেমন সংবাদকর্মী তথ্য সংগ্রহ না করলে কিংবা না করলে মানুষ তথ্য পাবে কোথায়? সেক্ষেত্রে কবি লেখক ও সাংবাদিকদের ভূমিকাই সংস্কৃতিকাজে সূচনালগ্নে।অথচ রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে তুলনামূলক কমই মনে রাখা হচ্ছে।সাহিত্যের সাথে সাথে সংস্কৃতির কোন বাদানুবাদ নেই বরং পরিপূরক।অর্থ্যাৎ সাহিত্যকর্মই সংস্কৃতি।সংস্কৃতির পাটাতনই সাহিত্য।

বর্তমান পরিস্হিতিতে বলবো,বিনোদন ও সংস্কৃতি খাতে ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ তুলনামূলক কমে গেছে। যদিও সাধারণ জনগণ এ নিয়ে গভীরে না ভাবলেও জনগণ ও সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী ও বোদ্ধাগণের কিন্তু চিন্তাভাবনার আবশ্যকতা থেকে যায়।

এ খাতকে গুরুত্বদিয়ে প্রসঙ্গক্রমে আসে যে,’সংস্কৃতির কথা’ প্রবন্ধে দার্শনিক মোতাহার হোসেন চৌধুরী বলেন-‘শিক্ষিতের ধর্ম হচ্ছে সংস্কৃতি অশিক্ষিতের সংস্কৃতি হচ্ছে ধর্ম।’ সংখ্যাগত দিক দিয়ে শিক্ষিতের হার দেশে বেড়েছে ঠিক কিন্তু মনোগত দিক থেকে সে অনুপাতে শিক্ষা সমৃদ্ধ নয়। আমরা জানি সংস্কৃতির উন্নতি মানেই শিক্ষার উন্নতি। তাই দেশকে উন্নতির দিকে ধাবিত করতে গেলে সংস্কৃতিতে পৃষ্ঠপোষকতা অনিবার্য। সে নিরিখে বলতে গেলে এবারে বাজেটে বিনোদন ও সংস্কৃতি ধর্ম খাতে মাত্র ০.১ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছে_যা খুবই অপ্রতুল।’

বিগত ২০১৯-২০ সালের বাজেট ৫২৩১৯০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের বর্তমান বাজেট ১৯৭২ সালের প্রথম বাজেট থেকে ৬৬০ গুণ বেশি। এবার মাথা পিছু আয় ১৯০৯ ডলার। প্রবৃদ্ধি ৮.২। মূল্যস্ফীতির এক ভয়ানক সড়ক। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে গতবারের মতোই।তুলনামূলক সংস্কৃতি বিনোদনখাতে বরাদ্দ কমেছে।এবার এ খাতে মোটা ধরনের বরাদ্দের প্রস্তাব করবোনা।

ভবিষ্যতের জন্য কিছু প্রস্তাব রাখা যেতে পারে।বিবেচনার মালিক সরকার। এ ক্রান্তিকালে সরকার এবার বরাদ্দ দিয়েছে ৫৭৯ কোটি টাকা।লেখক শিল্পীদের এ সময়ে আর্থিক সংকট মেটাতে অন্তত থোক বরাদ্দের জন্য প্রস্তাব তুলছি বাজেট প্রণয়ণ অধিবেশন যখন হয়।

আমি সাহিত্য-সংস্কৃতি কর্মী এবং জনগণের একজন হিসেবে অধিকার বিষয়ে রাষ্ট্রের কাছে আমার নিঃসংকোচ চাহিদা রয়েছে। এবারে সংস্কৃতি খাতে ৫৭৯ কোটি টাকা আপাত দৃষ্টিতে যে কারোর কাছে আকাশসম মনে হলেও দেশের সাড়ে ষোল কোটির জনগণের কাছে নিতান্তই অপ্রতুল। এ লেখাতে আমি একজন নাগরিক হিসেবে কিছু প্রস্তাব দিতে চাই। অন্যের কাছে তা হেরফের হবে এটাই স্বাভাবিক।

৬৪টি জেলায় ৪৯০টি উপজেলা এবং ৪৫৬২টি ইউনিয়ন রয়েছে। প্রতিটি জেলা শহরে বছরে ২০ দিন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করলে প্রতি অনুষ্ঠানের জন্য যদি ৩০ হাজার টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় তাহলে প্রয়োজন ৩ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকা। একই অনুষ্ঠান উপজেলাগুলোতে খরচ কমিয়ে যদি ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে করা হয় তাহলে খরচ হবে ১৯ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা।

একইভাবে ইউনিয়ন পর্যায় লাগবে ১৩৬ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা। সর্বমোট অনুষ্ঠান বাবদ খরচ হবে ১৬০ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা। বিভাগীয় শহরে, জেলা ও উপজেলা শহরে সংস্কৃতি বিস্তারে বছরে অন্তত একবার সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান করলে ব্যয় হতে পারে আরও তিনগুণ টাকা। সব মিলিয়ে এ বাবদ ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে।

প্রতিটি উপজেলায় শিল্পকলা একাডেমি ভবন নির্মাণের জন্য ১০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ হলে টাকা প্রয়োজন হবে ৪ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। আপাতত ৫শ’টি ইউনিয়নে একাডেমি ভবন নির্মাণের জন্য ইউনিয়ন প্রতি ২ কোটি টাকা বরাদ্দ হলে অর্থের প্রয়োজন ১ হাজার কোটি টাকা। সাহিত্য কাজের জন্যে অনুরূপ কাজটি করলে ১০ হাজার কোটি টাকা লাগতে পারে। এছাড়া সাহিত্য ও সংস্কৃতি কাজের জন্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, অনুসন্ধান, গবেষণা, প্রশিক্ষণ কাজের জন্যও অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন।

তাছাড়া শিল্পী ও লেখক পুল, অনুষ্ঠান সরঞ্জাম ক্রয়সহ আরও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর সমাধানকল্পে সব মিলিয়ে ১১ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এখনকার হিসেব অনুযায়ী বাজেটে ২% বরাদ্দ অন্তত পাঁচ বার থাকা উচিত।পাঁচবছর পর এটা কমিয়ে আনা যেতে পারে।কারণ কয়েকবছর এ খাত উন্নতিতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন হবেনা।তখন ব্যবস্হাপনা খরচ লাগবে শুধু।

আপাতত এমনও হতে পারে সাহিত্য -সংস্কৃতি -বিনোদন কাজে উপরোক্ত প্রস্তাব অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিয়ে সাহিত্য ক্ষেত্রে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হোক। সাহিত্যকর্মকে ত্বরান্বিত করা সময়ের দাবি। শিক্ষার্থী তথা শিক্ষিত ও সমঝদার মানুষের মেধা-মনন আরো বিকশিত করতে এবং দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য লিপিবদ্ধ করতে এবং মেধা-মনন উৎকৃষ্ট ও বিকশিত করতে এ খাতে বরাদ্দ না করে পথ মসৃণ হতে পারে না।

প্রকাশনা, গান, পুস্তক এ সবকিছুতেই সাহিত্যের অনন্য অবদান। এ দিকটিকে খাটো করে দেখার বিষয় নয়। এ ক্রান্তিকালে সংস্কৃতিকর্মীর পাশাপাশি কবি -লেখকগণও দুঃখ-দুর্দশায় রয়েছে।করোনাকাল এটা যদি আরও দুই কিংবা তিনবছরও স্হায়ী হয় তাহলে সাহিত্য-সংস্কৃতির উপর নির্ভর করা পেশাজীবিগণ এর বেঁচে থাকাই হুমকিতে পড়বে।আপদকালীন সময়ে অন্তত ৫শ কোটি টাকা এ ক্ষেত্রে থোক বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে।

তাই শেষাংশে উল্লেখ করা আবশ্যকযে ভারতে ৪ বা ৫টি ছবি বানাতে যা খরচ হয় আমাদের দেশের বিনোদন সংস্কৃতির বাজেটের সমান। আমরা বাজেটে সাহিত্য-সংস্কৃতির আরো বিশালতা চাই। সমাজের প্রতিটি মানুষ যাতে সাহিত্য সংস্কৃতির ছোঁয়া পায়, সে জন্য উপরোক্ত প্রস্তাবটি বিবেচনা করতে সরকারের প্রতি আকুল আবেদন করছি। কারণ ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন এসব সাহিত্য আন্দোলনই বটে। ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মীরাই ছিলেন উপদেশক।

দেশে অবকাঠামোর উন্নয়নটি শৈল্পিক ও সৌন্দর্য বটে। এখানেও শিল্প ও সংস্কৃতি আমি দেখতে পাই। পদ্মা সেতুর পদক্ষেপে আমরা সাহসী হয়েছি। মনে হচ্ছে আমরা অনেক কিছুই পারবো। চোখ ধাঁধানো ফ্লাইওভার আমাদের আনন্দে ভাসাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় মানবিকতা প্রকাশ পেয়েছে। এটাও আমাদের উন্নত সংস্কৃতিরই বহিঃপ্রকাশ। আমরা খুশি।

এতো উন্নতি দেশপ্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ। এর পেছনে চেতনা ও সংস্কৃতিই মূল। যে দেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন নেই, দেশে অর্থনৈতিক বিপ্লব হলেও পিছু হটেছে। যেমন সোভিয়েত রাশিয়া। চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব কিছু হওয়ায় তারা বিশেষ এগিয়ে যাচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আর্থিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধিশীল হয়ে আরো এগিয়ে যেতে চাই। আমাদেরা এগিয়ে যেতে হবেই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও আহবায়ক,চাঁদপুর লেখক পরিষদ। মোবাইল: ০১৬২ ৭৮৪০৪৯৫ , ১০ জুলাই ২০২০