করোনা মহামারীর মধ্যে আসন্ন পবিত্র রমজান মাসের আমল নিয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন সময়ের আলোচিত ইসলামী বক্তা মিজানুর রহমান আজহারী।
সোমবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে তিনি এসব পরামর্শ দেন।
আজহারীর স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে দেয়া হলো-
১. এ বছর রমজানের শুরুতেই আপনার জাকাত আদায়ের পরিকল্পনা করে ফেলুন। আপনার জাকাতবর্ষ পূর্ণ হতে কয়েক মাস বাকি থাকলেও সম্ভব হলে এ রমজানেই জাকাত আদায় করে দিন। জাকাত অগ্রিম আদায় করা যায়। তাই করোনা পরিস্থিতিতে অভুক্ত ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে, আপনার জাকাতের অর্থ পৌঁছে দিন তাদের হাতে।
কাজকর্ম সব বন্ধ থাকায় খাদ্যাভাবে কঠিন সময় পার করছে শ্রমজীবী স্বল্পআয়ের এ মানুষগুলো। এমন সংকটাপন্ন মুহূর্তে এর চেয়ে ভালো কোনো সৎকর্ম আর হতে পারে না।
পাশাপাশি বিগত বছরের অপরিশোধিত জাকাত থাকলে সেটিও এই রমজানে আদায়ের পরিকল্পনা করুন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করছেন-
‘এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র অন্তরে যে জাকাত তোমরা দিয়ে থাক, তা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়’। (আল-রুম: ৩৯)
২. কোরআনুল কারিম কেন্দ্রিক রমজানে বিশেষ পরিকল্পনা করুন। খতম উঠানোর জন্য ওঠেপড়ে না লেগে বিশুদ্ধ তিলাওয়াত নিশ্চিত করুন এবং তাদাব্বুর তথা বুঝে বুঝে এবং অনুধাবন করে কোরআনিক মেসেজগুলো হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করুন। তাড়াহুড়ো করে অনেক খতমের চেয়ে বুঝে পড়া ও তিলাওয়াতের গুণগত মান নিশ্চিত করা বেশি জরুরি।
রমজান আসার আগেই কোরআনের বিশেষ কিছু অংশ বা কয়েকটি সুরা মুখস্ত করার পরিকল্পনা করুন। পরিবারের সবাই মিলে মুখস্তকৃত অংশগুলো একে অপরকে শোনাতে পারেন। কোয়ারেন্টিনকে কোরআন টাইম বানান। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করছেন- ‘এর পরও কি ওরা কোরআন নিয়ে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে তা অন্তরে ধারণ করবে না? নাকি ওদের মনের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে? (মুহাম্মাদ: ২৪)।
৩. যেহেতু লকডাউন চলছে, সবাইকে বাসায় থাকতে হচ্ছে, হাতে এখন প্রচুর সময়। সময়গুলো প্রোডাক্টিভ কাজে বিনিয়োগ করুন। বাসায় ইসলামী হালাক্বার আয়োজন করতে পারেন, যেখানে পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলে কোরআনের সরল বঙ্গানুবাদ, মর্মার্থ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির কিংবা রিয়াদুস সালিহিনের মতো যে কোনো হাদিস গ্রন্থের ওপর বিষয়ভিত্তিক সামস্টিক পাঠের ব্যবস্থা থাকবে।
বিভিন্ন ইসলামিক স্কলারের লেকচারগুলো ইউটিউব থেকে শুনুন, তাদের লাইভ প্রোগ্রামগুলোতে জয়েন করুন এবং এগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন। নলেজ শেয়ারিং অনেক বড় সাদাকাহ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- ‘আমার পক্ষ হতে একটি বাণীও যদি তোমার জানা থাকে, তবে তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও”। (বুখারি)
৪. তারাবিহর সালাতের ক্ষেত্রে, রাকাত বিতর্ক এড়িয়ে চলুন। ধীরেসুস্থে, একাগ্রচিত্তে এবং তা’দিলুল আরকান মেনটেইন করে সালাত আদায় করুন। বিশ রাকাত নামাজ পড়তে পারাটাই উত্তম। আবার রাসুল (সা.) এর আট রাকাতের হাদিসের বর্ণনাও স্বতঃসিদ্ধ। তাই কোয়ান্টিটি নিয়ে বিতর্ক না করে, কোয়ালিটি সালাতের দিকে মনোযোগী হোন। ইসলামী শরিয়ায় যে ব্যাপারগুলোতে প্রশস্ততা রয়েছে, সেগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়।
তা ছাড়া কোরআনে সুন্দর আমলের কথা বলা হয়েছে, বেশি আমলের কথা নয়। তাই স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাণবন্তভাবে রাতের সালাত দুই রাকাত করে যত বেশি আদায় করা যায়, ততই সওয়াব।
নিষ্প্রাণ সালাত আল্লাহতায়ালার কাছে মূল্যহীন, যদিও তা সংখ্যায় বেশি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- ‘তোমাদের সাধ্যে যতটুকু কুলায় ততটুকুই ইবাদত করো। আল্লাহর শপথ, নিশ্চয়ই আল্লাহ কখনও ক্লান্ত হবেন না; বরং তোমরাই ক্লান্ত হয়ে পড়বে’। (মুসলিম)
৫. সারা বছর হয়তো অনেকেরই তাহাজ্জুদ পড়ার সুযোগ হয়ে উঠে না। এ মাসে এই বিশেষ সুযোগটি কাজে লাগানো যেতে পারে। সেহরি খাওয়ার জন্য তো আমাদের উঠতেই হবে। তাই প্রতিরাতে সেহরি খাওয়ার আগে অথবা পরে দুই-চার রাকাত তাহাজ্জুদ আদায় করার পরিকল্পনা করুন।
আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আর রাত্রির কিছু অংশ তাহাজ্জুদে কোরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকুন। এটি আপনার জন্য অতিরিক্ত। অচিরেই আপনার পালনকর্তা আপনাকে এক প্রশংসনীয় মাকামে অধিষ্ঠিত করবেন’। (বনি ইসরাইল: ৭৯)
৬. পরিমিত ইফতার ও সেহরি গ্রহণের পরিকল্পনা করুন। মাত্রাতিরিক্ত ইফতার ও সেহরি গ্রহণের ফলে অলসতা তৈরি হবে এবং সারাদিন কোরআন তিলাওয়াতে ও রাতে কিয়ামুল্লাইলে আপনি মজা পাবেন না। তাই রমজানে হেলথি ডায়েট মেনটেইন করার চেষ্টা করুন। এতে আপনার প্রোডাক্টিভিটি অনেক গুণে বেড়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- ‘পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাবারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ থাকবে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য’। (তিরমিযি)
৭. ক্বদর বা ভাগ্যরজনী তালাশের জন্য রমজানের শুরু থেকেই সিরিয়াসলি পরিকল্পনা নিয়ে রাখুন। প্রয়োজনে ক্যালেন্ডারে তারিখগুলো মার্ক করে রাখুন; যাতে করে কোনোভাবেই এ রাতের বরকত মিস না হয়ে যায়।
রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর যে কোনো একটি রাত হলো- সেই বহু প্রতীক্ষিত ক্বদরের রাত। যে রাতে পবিত্র কোরআনুল কারিম নাজিল হয়েছে, যে রাত হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, যে বরকতময় রাতে আরশের মালিকের রাজকীয় ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিজ্ঞোচিত ফয়সালা দেয়া হয়, আর সে রাতে ফজর উদিত হওয়া অবদি গোটা দুনিয়ায় শান্তির সমীরণ বহে। সব ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে, ইবাদতে মশগুল থাকুন এ মহিমান্বিত রজনীতে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতের মাহাত্ম অর্জন থেকে বঞ্চিত হলো, সে আসলেই দুর্ভাগা’। (নাসাঈ)
বার্তা কক্ষ, ২১ এপ্রিল ২০২০