আজ মে মাসের দ্বিতীয় রোববার। বিশ্ব মা দিবস। সন্তান মাকে, মা সন্তানকে প্রতিদিনই ভালোবাসে। তারপরও মা দিবস কেন? প্রশ্ন জাগতে পারে। মা দিবস উদযাপন যেভাবে শুরু হয়েছে, সেই বিশাদ ব্যাখ্যায় যেতে চাই না। শুধু এতোটুকু বলবো মা দিবস নির্দিষ্ট করে উদযাপন করা একটি গুরুত্ব বহন করে। সেটি হলো মায়ের প্রতি সন্তানদের দায়িত্ববোধ আরো বেড়ে উঠা। তা জাগ্রত করা।
হঠাৎ একদিন আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারপর থেকে মাকে সুস্থ্য করে পরিবারে মাঝে ফিরে পাওয়াটা আমার জন্য সত্যি স্রষ্টার দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ উপহার। আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েছেÑ সেটি হলো স্রষ্ঠার প্রথম শ্রেষ্ঠ উপহার। মাকে নিয়ে হাসপাতালে থাকা অবস্থায় লেখা অনুগল্প গুলো এই মা দিবসে তুলে ধরেছি-
এক. আজ ঈদ। মাকে বলা হয়নি। নামাজে যাবার পূর্বে মাকে বলেছি- ‘মা আমি নিচে যাই।’ মা বলল- ঈদ কবে? আমরা ঈদে বাড়ি যাবো না?
মায়ের এমন প্রশ্নের উত্তর কি দেয়া যায়! বুকে চাপা কান্না আগলে রেখে হাসি দিয়ে গেলাম। প্রতি ঈদের নামাযে যাবার পূর্বে মায়ের হাতে রান্না করা সেমাই খেয়ে যেতাম। মা পানির গ্লাসটাও ঠিকঠাক করে রাখতেন।
আজ মা অসুস্থ। মাকে বলা হয়নি রোগের ধরণ। শুধু বলেছি- মাথায় একটু সমস্যা ধরা পড়েছে। ডাক্তার ঠিক করে দিবেন। তবে শরীরটা আরোও সুস্থ হোক।
দুই. বাবা ঈদের দিন নতুন শার্ট ক্রয় করে ছোট ফুফুর কাছে দিয়েছে। আমি যেন এই শার্ট গায়ে দিয়ে নামায পড়তে যাই। বাবা সকালে ফুফুর কাছে খবরও নিলেন। মায়ের পাশে থেকে সেবা করায় খুশি হয়ে বাবা আমাকে এই নতুন শার্ট উপহার দিলেন। ফুফুর কাছে বাবা এভাবেই বলল।
আমিও বাবা হলাম। মায়ের কাছে থেকে আমার ছেলে আবরার ফাইয়াজের জন্য নতুন পোশাক ক্রয় করার কথা ভুলে গেলাম। অথচ আমার বাবা ঠিকই আমার জন্য নতুন পোশাক উপহার দিলেন।
তিন. নতুন শার্টটি গায়ে দিয়ে নামায পড়ে মায়ের পাশে দাঁড়ালাম। হে আল্লাহ মায়ের ব্রেন অপারেশন যেন সফলতার সাথে করাতে পারি, সেই ব্যবস্থা করে দিয়েন।
চার. রংধনু। জীবনটাই রংধনুর মতো। আজ বিকালে যখন একটি রংধনুর ছবি আটকে ধরলাম। তখন সূর্যের আলো আর বৃষ্টিকে একসাথে দেখেছি। তখন ভাবলাম- জীবনটাও তো সূর্য্যরে আড়ালে টিপটিপ বৃষ্টির মতো ঝরে।
পাঁচ. মা- আমরা চার ভাই, এক বোন ও ভগ্নিপতি আর বাবাসহ সাতজন। রংধনুরও সাত রং। আমরা রংধনুর মতো তোমার জীবনের আকাশটা সাজিয়ে দিবো। মা- তুমি আগের মতো কথা বলো। আগের মতো হাসিমাখা মুখ দেখতে চাই। মা, আল্লাহ তোমাকে দ্রুত সুস্থ ও সবল করে দিবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস রাখি।
ছয়. ওই রংধনুর ছবিটি একবার ভালো করে দেখলাম। কি নেই! পরিচ্ছন্ন বাড়ি, আট্রালিকা, প্রযুক্তি, পুকুর, যাতায়াতের রাস্তা, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টির ফোটা, রোদ্দুর, সবুজ বৃক্ষ, গণতন্ত্রের শিক্ষালয় ( নির্বাচন ও প্রশিক্ষণ ভবন), সংবাদ মাধ্যম (বাংলাদেশ বেতার ভবন), চিকিৎসালয় (নিউরোসাইয়েন্স হসপিটাল), যানবাহনসহ দৃষ্টিনন্দন টিনেরছালা ও বাহারি ফুল বাগিচা। Ñসবই রংধনু ১৯০ডিগ্রিতে আবদ্ধ করেছে।
এ যেন পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত চিত্র। কিন্তু মায়ের মতন আবদ্ধ করে কে মোদের জীবনকে তৈরি করে দিবে? যত সৌন্দর্যময় আছে মায়ের সাথে তুলনা হয় না। পৃথিবীতে প্রথম সৌন্দর্য হলো মা। আমার মা।
সাত. রাত ১২ টা ১৫ মিনিট। ফ্লোরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে গেলাম। ফেসবুক মেমোরি আমাকে স্বরণ করে দিলো দুইটি ছবি। ছবি দুইটি আমার ফেসবুক বন্ধুদের কাছে পরিসংখ্যান্যুায়ী ভালবাসার লাইক পেয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছে।
আট. প্রসঙ্গ- মা ও সন্তান। বুকের কষ্ট চেপে রাখা যায়। চোখের জল কি ধরে রাখা যায়? ২০১৭ সালে আমার চিকুনগুনিয়া জ্বর হয়েছিল। মা নিজ হাতে কত বছর পর আমাকে ভাত মুখে তুলে দিলেন! সেই তৃপ্তি পেয়ে ফেসবুকের জন্য ছোট ভাইকে দিয়ে ছবিটি ক্লিক করে নিলাম। পরে পোস্ট করেছি। আর আজ মায়ের পাশে আমি দাঁড়িয়ে। মুখে খাবার দিতে পারছি না। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা। আর মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা অনেক পার্থক্য। তা শুধু আমি বুঝেছি!
নয়. ন্যাশনাল ইনিস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল। এখানে কেউ গান শুনতে চায় না। শুক্রবার সন্ধ্যায় আট কিংবা নয় বছরের শিশু মোবাইলে গান শুনছিল। দিনাজপুরের এক চাচা খুব বিরক্ত বোধ করে শিশুর হাতের মোবাইল নিয়ে গান বন্ধ করলো। ওইসময় চাচা শিশুর অভিভাবককে বলল- এখানে কি গান শুনার জায়গা? এখানে সবাই জীবন-মরণ নিয়া টেনশনে আছেন।
চাচার স্ত্রী আমার মায়ের পাশের বেডে। দুই লাখ আশি হাজার টাকায় হেলিকাপ্টার ভাড়া করে এই হাসপাতালে এনেছে। এখন মাথায় চার লাখ টাকা দিয়ে কয়েলিং অপারেশন করাবে। চাচা শিক্ষকতা করতেন। এখন প্রাক্তন। টাকার এখন খুব প্রয়োজন। কিন্তু চাচা স্বজনদের ওপর নির্ভর!
দশ. ওই হাসপাতালে চব্বিশঘণ্টা বিরহ। অবিরত কান্না। এখানে প্রতিটা মুহূর্ত ট্রাজেডি ঘেরা। জড়িয়ে জড়িয়ে কান্নার বিলাপ। কেউ মা, কেউ বাবা, কেউ সন্তানকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা। মধ্যবিত্ত এই দেশে কেউ এখানে অর্থের চিন্তা করে না। মগ্ন হয়েও থাকতে দেখি না। সবার শুধু একটাই ফরিয়াদ- একটি প্রাণ বেঁচে থাকুক! কখন চিকিৎসক বলবে আশংকামুক্ত! আমার মাকে শান্তি দাও। সফল অপারেশন করতে শরীরটা সুস্থ্য করে দাও।
এগার. মায়ের এনজিওগ্রাম করানো হবে। চিকিৎসক আমাদের প্রস্তুত থাকতে বললেন। তারপর ৭২ ঘন্টা অভজারভেশনে রাখা হবে। মায়ের অন্যান্য সকল পরীক্ষার রির্পোট ভালো। অপারেশন পর্যন্ত মায়ের শরীর ঠিক থাকলে চিকিৎসক অপারেশন থিয়েটারে নিবেন। আর আমরা মহান সৃষ্টি কর্তার কাছে সুস্থ্যতার আরজি করে রেখেছি। আরজি করছি। আরজি করবো। মা সুস্থ থাকুক, আমাদের জন্য।
বার. মা একটু একটু করে দুইদিন কথা বলছে। যা বলছে আশিভাগই আমাদের (ভাই-বোন) ও স্বজনদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। বাবা জ্বরে ভুগছে খবর শুনে, মা কিছুক্ষণ পরপর বাবার খবর জানতে চায়। মা এমনই- পরিবারের কর্তা। সবার খবর নিবেন। কে কি খাবে। কার কি প্রয়োজন। তদারকি করা। আজ চৌদ্দ দিন অসুস্থ্য রেখে মায়ের আড়াল হবার চেষ্টা করিনি। মন অনেক কাঁদে। চোখ এখন আর পারে না টিপটিপ পানি বুকে ঢেলে দিতে!
তের. মায়ের এঞ্জিওগ্রাম শেষ হলো। ৪৮ ঘন্টা পর্যবেক্ষণ কক্ষে রাখা হবে। ৭২ ঘন্টার মধ্যে রির্পোট দিবে। মায়ের জ্ঞান ফিরেছে। একে একে সময় করে যখন ভাই বোন মিলে দেখা করতে যাই, তখন মায়ের চোখ থেকে পানি ঝরে। সবাই গিয়ে হাসিমাখা মুখে সাহস দিয়ে আসি।
মা মনে হয় আমাদের সাথে রাগ করেছে। আমরা কেন মাকে একা একা রেখে এলাম। মা আর সন্তানদের যে কি আত্মজা। তা আজ ফুটে উঠেছে। মা একা, তাই অপারেশন থিয়েটারের পোষ্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে কাঁদে। আর আমরা সন্তানরা বাহিরে দাঁড়িয়ে কাঁদি- মা একা ভিতরে ভয় পাচ্ছে।
চৌদ্দ. মাকে দেখতে এসেছিল আমার সহকর্মী বন্ধুভর সাংবাদিক মো. এনায়েত মজুমদার। সে দৈনিক আজকের দেশকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। তাঁর পত্রিকার সহ-সম্পাদক সবুজ ভদ্র সাথে আসলেন। মাকে এঞ্জিওগ্রাম করাতে অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার পাঁচ মিনিট পর তাঁরা আসে। তাই মাকে দেখতে পারেনি। মায়ের খোঁজ খবর জেনে আমাদের সান্ত্বনা ও মায়ের জন্য দোয়া করে গেছে। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
পনের. আজ মা আর আমি একসাথে কেঁদেছি। মাকে বলেছি- মা আপনার মাথার সমস্যাটা ঠিক করে দিলেই, আরো সুস্থ্য হয়ে যাবেন। মা বলল- আমারে কি আবার একা নিবো? বাবা তোরা কেউ সাথে থাকস্ না। আমি খুব কষ্ট পাই। ভয় পাই। বলতে বলতেই কেঁদে দিলেন।
আমি আর মনে সাহস, চোখের জল আটকে রাখতে পারিনি। কাঁদলাম। মাও কাঁদলো। টিস্যু পেপার দিয়ে মায়ের চোখের জল মুছে দিলাম।
মাকে বললাম- মা মনে সাহস রেখো। আমরা কাছে আছি। তুমি সুস্থ্য হয়ে যাবে। আর আমাদের আল্লাহ ছাড়া কে আছে মা? শুধু আল্লাহকে ডেকো। সুরা, কলেমা পড়বা মা। মা মাথা নেড়ে বলল- হ, বাবা আল্লাহকে তো ডাকি। আল্লাহ ছাড়া আমার বাবাগো কে আছে। সব সময় সুরা কলেমা পড়ি বাবা।
ষোল. আমি যে আজ মায়ের সামনে কেঁদেছি, মা আমার ভাই রাজীবের কাছে বলে দিলো- ‘বাবলু কান্না করেছে!’
মা সবার কথা বলে। সবার খোঁজ খবর নেয়। মাকে দেখতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইঞ্জিনিয়ার সফিকুর রহমান ও শুক্রবার বিকালে জিউয়ার রহমান বিপুল ভাইয়া মাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে এসেছিলেন। তাঁরা মায়ের সুস্থ্যতার জন্য দোয়া কামনা করেন।
আমার মায়ের অসুস্থ্যতার খবর পেয়ে হাজীগঞ্জ পৌর মেয়র আ স ম মাহবুব-উল আলম লিপন ভাই ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বৈশাখী বড়ুয়া সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর নিয়েছেন। আমাকে মুঠোফোনে মা যেন দ্রুত সুস্থ্য হয়ে উঠে দোয়া করেন ও আমাকে সাহস দিয়েছেন। তাঁদেরসহ আরো অনেক শুভানুধ্যায়ীদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার মায়ের যেন ব্রেন অপারেশন সফলভাবে হয়- সে জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
সতের. মাকে রক্ত দিতে মহান দুই ব্যক্তির কাছে ঋণী। ফুফাতো ভাই সফিউল আযম। তাঁর প্রচেস্টায় মায়ের অপারেশনে রক্ত সংগ্রহ হয়। শরীফ মাহবুবুল কুদ্দুস। মিষ্টভাষী, নীতিবান ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এ কর্মরত।। খবর পেয়েই নিজের জন্য ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট রেখে ছুটে এসেছেন হাসপাতালে আমার মাকে রক্ত দিতে। এটাই ভালোবাসা। এটাই হ্নদ্যতা। আমরা আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। মায়ের অপারেশনে কয়েক ব্যাগ রক্ত দরকার ছিল। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেখে এগিয়ে এসেছেন অনেক শুভাকাঙ্খী। একজন জাকির হোসেন রাজু। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-এ মাস্টার্সে অধ্যয়নরত এবং সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক। আমরা কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তাঁদের উত্তম প্রতিদান কবুল করুক।
আঠার. মাকে নিয়ে হাসপাতালে বসে গল্পটি পড়লাম। গল্পটি লিখেছেন তরী’র সম্পাদক কবি ও গল্পকার আশিক বিন রহিম ভাই। গল্পটি যেন জীবনের একটি প্রতিচ্ছবি। গল্পটির নাম -গাঁধা সমাচার। গল্পটি হুবহু তুলে ধরলাম-
প্রত্যেকটা পরিবারেই একজন পুরুষ থাকে। সে কখনো বাবা, কখনো বড় ছেলে, মেজো ছেলে, ছোট ছেলে কিংবা কখনো কারো স্বামী। যে নামেই পরিচিত হোক না কেনো পরিবারের কাছে সে কেবলই একজন পুরুষ। ওই পরিবারে তার অবস্থান অনেকটা গাধার মতো। প্রয়োজনে সবাই তাকে খাবার দেয়, যতœ নেয়, ভালোবাসে- সর্বোপরি বাঁচিয়ে রাখে। কারণ এই গাধার মাঝেই তাদের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকার সমস্ত উপকরণ নিহিত আছে।
‘গাঁধা’ শব্দটা আমরা বেশিরভাগ ব্যবহার করি নেতিবাচক অর্থে। অধিক ক্ষেত্রে তা বোকাদের বেলাতেই ব্যবহার করা হয়। তবে আমি সেই অর্থে গাধা শব্দটা লিখিনাই। বরং এই গাঁধাকে যারা বোকা ভাবে তারাই এক প্রকার বোকা। কারণ, গাধা একটি নিরীহ প্রাণী। এরা মানুষের অত্যন্ত অনুগত। কারো ক্ষতি করে না। মানুষ অপমান বা ভদ্র ভাষার গালি হিসেবেও ‘গাধা’ শব্দটি ব্যবহার করে। কিন্তু গাধা কর্মঠ, বুদ্ধিমান এবং উপকারী প্রাণীও বটে।
এটা সবাই কি জানি? হয়তো জানি না, হয়তো জানলেও গাধা শব্দটা বলতে বা ব্যবহার করতে ভালো লাগে বলে যাকে তাকে গাধা বলে সম্বোধন করি। আমার লেখার এই গাধা পারিবারিক জীবনে ভাগ্যস্রষ্টার বেঁধে দেয়া দায়িত্বকে হেলা না করে, তা পালনে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয় স্বেচ্ছায়। (তাই কথায় কথায় একে অন্যকে ‘গাধা’ বলার আগে একবার ভেবে নিবেন)
এ মানুষটা গাধার মতো তার দায়িত্বে অনুগত থেকে দিনরাত খেটে যায় পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেয়াসহ দৈনন্দিন জীবনের সকল চাহিদা মেটাতে। ঘরের চাল, ডাল, তেল, নুন থেকে জামা কাপড়, ঔষদ, বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, স্কুলের বেতন, ছোট বোন অথবা বৌয়ের জন্য লাল ফিতে- রেশমি চুরি- কখন কোনটা লাগবে সব তার মুখস্থ (যদিও পকেটে টাকা না থাকলে দু’এক দিন দেরি করারর জন্য ‘মনে নেই’ এমন মিথ্যা কথা বলে থাকে)। ছেলে অথবা ছোট ভাই বখাটে কারো সাথে মিসছে কি- না, ঠিকমতো বিদ্যাপীঠে যায় কি- না তা নজরে রাখাতে দিনরাত সতর্ক আর টেনশনে থাকা তার নিত্যদিনের রুটিন।
এই মানুষটার অসুখ হলে পরিবারের লোকেরা তাকে সুস্থ্য খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কারণ তারা জানে এ মানুষটা বিছানায় পড়ে থাকলে সংসার নামক নৌকোর ছুটে চলা বাধাগ্রস্ত হবে। কখনো কখনো এমনও হয় এ মানুষটার অসুখ হলে, মন খারাপ হলে- বিষয়টা পরিবারের লোকেরা খুব বেশি আমলে নেয় না। যেনো এই মানুষটার অসুখ করতে নেই, মন খারাপ হতে নেই। টাকা রোজগার করতে গিয়ে কারো সাথে জগড়া করা, ছোট হওয়া, অপমানিত হওয়া এ বিষয়ে পরিবারের লোকেরা খুব একটা খেয়াল রাখে না। যেনো তার শরীরে ব্যথা নেই, মনে অসুখ জমতে পারে না।
পরিবারের কেউ একদিন তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে না- তার শরীরটা ভালো কি না, পছন্দের কোনো খারা খেতে বা ভালো কোনো পোষাক পরতে ইচ্ছে করছে কি- না অথবা কোথাও তার বেড়াতে যেতে মন চাইছে কি না। রাতে ঘুমের ছলে কোনো অপ্রাপ্তি বা হতাশা তাকে পীড়া দেয় কি- না কেউ জানতে চায় না কখনোই।
অথচ সবকিছু পাছে ফেলে এই মানুষটা দিনরাত্রি খেটে যায় ক্লান্তিহীন গাঁধার আর যন্ত্রের মতোন। আমাদের সব পরিবারেই এমন একজন মানুষ থাকে, যে কখনো বাবা, বড় ছেলে, মেজো ছেলে, ছোট ছেলে কিংবা স্বামী নামে পরিচিত। আসুন সপ্তাহে অন্তত একটিবার আমরা তার হাতটা জড়িয়ে ধরে বলি- তোমার শরীরটা ভালো তো? কোনো বিষয়ে খুব বেশি টেনশন করছো কি? পছন্দের কিছু খেতে মন চাইছে কি? আমরা তোমায় সত্যি সত্যিই অনেক ভালোবাসি গাঁধা।
উনিশ. অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার পূর্বে মা একটু পানি খেতে চেয়েছিল। দিতে পারিনি। সাড়ে সাত ঘন্টার অপারেশন চলাকালীন সময়ে প্রতিটি সেকেন্ডে আমাদের হার্টে ঠিকঠিক করে উঠল। কেমন চলছে মায়ের ব্রেন অপারেশন? কেমন আছেন মা? কি লাগবে অপারেশন থিয়েটারে? কতরকম প্রশ্ন উদিত হয়ে দুই চোখ জলে টলমল হয়ে উঠলো। মাকে আজ সোমবার বিকেলে পানি, ডাবের পানি, স্যুপ, কমলা ও আঙ্গুর ফলের রস খাওয়ালাম। মনটা আমার কত তৃপ্তিজনক হয়ে উঠল- কাউকে বুঝানো যাবে না।
বিশ. ব্রেন স্ট্রোক। চিকিৎসা। সেবা। মনোবল। অপারেশন। তারপর সতর্কতা। সবচেয়ে বড় আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা। মায়ের অপারশন সিদ্ধান্ত ও থিয়েটারে সাড়ে সাত ঘন্টা সময় যেভাবে লেগেছিল। শুভানুধ্যায়ীদের একটু বর্ণনা দেয়া প্রয়োজন বোধ করছি। কারণ মানবদেহের ব্রেন হলো প্রথম অঙ্গ। এটি বড় একটি অপারেশনও বটে।
মায়ের ব্রেনের দুইটি রগে রক্তক্ষরণ হয়। একটি রগ কয়কটি রগের এলোমেলো স্থানে, সেখানে তিনটি ক্লীপ লাগানো হয়। অপর রগটি স্বাভাবিক স্থানে হলেও দুইটি ক্লীপ লেগেছে। মোট ছয়জন চিকিৎসক মায়ের সার্জারীর সময় নিখুঁত ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
একুশ. পৃথিবীতে ব্রেন অপারেশন হয় দুই ভাবে। একটি ক্লীপিং, আরেকটি কয়েলিং। বাংলাদেশে ক্লীপিং পদ্ধতি পূর্ব থেকে চলমান। আর কয়েলিং পদ্ধতি ৩/৪ বছর হলো। ন্যাশনাল ইনিষ্ট্রিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সেস এন্ড হসপিটালের কয়েলিং বিভাগীয় প্রধান ডা. শরীফ উদ্দীন খান, তাঁর সহযোগী প্রফেসর ডা. মিজানুর রহমান ও ডা.রাশেদ বৈঠক করে আমাকে এনজিওগ্রামের রির্পোট দেখে সিদ্ধান্ত দিলেন কয়েলিং না করে ক্লীপিং করলে ভালো হবে। তিনি দায়িত্ব নিয়ে সার্জারী বিভাগীয় প্রধান ডা. ফরহাদ হোসাইনের কাছে ফাইল পাঠায়। ডা. ফরহাদ হোসাইন গুরুত্বের সাথে দায়িত্বটা বুঝে নিয়ে অপারেশনে তারিখ করেন। শনিবার বিকাল সাড়ে তিনটায় মাকে অপারেশন থিয়েটারে হাসিমুখে দিয়ে আসলাম। মাকে বললাম – মা শুধু আল্লাহকে ডেকো। কলেমা সুরা পড়ো। মা ওই মূর্হুতে বললো- আমিতো সবসময়ই আল্লাহে ডাকি। সুরা পড়ি।
তারপর ঘড়ির কাঁটার দিকে দৃষ্টি দিতে লাগলাম। মাঝে মাঝে ওষুধের স্লীপ নিয়ে আসলে নার্সদের কাছে খবর নিতাম। ছয় ঘন্টা পর ডা. ফরহাদ হোসাইন আমাকে ভিতরে ডেকে নিলেন। বললেন- অপারেশন ভালে হয়েছে। বাকীটা আল্লাহর ওপর ভরসা। আমি তাঁকে বললাম- স্যার আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। এরপর মায়ের মাথায় সেলাই করতে সময়ে লেগেছে দেড়ঘন্টা। সেলেই শেষের ১৫/ ২০ মিনিট পর মা আল্লাহকে ডাকা শুরু করলেন। রবি ও সোমবার মায়ের পুনরায় সিটিস্কেন এনজিওগ্রাম অব ব্রেন এর পরীক্ষা করানো হলো। ডা. ফরহাদ হোসাইন স্যার ও তাঁর সহযোগী প্রফেসর ডা. বায়োজিত রির্পোটগুলো দেখে বলল- অপারেশন ঠিকঠাক আছে। মা, ভালো আছে।
বাইশ. একুশ দিন ধরে প্রিন্ট মিডিয়ার কোন পেপার চোখে পড়েনি। নিজেও পড়তে পারিনি। দেখা বা পড়ার ইচ্ছে হয়নি। দুই/ তিন বার হয়তো অনলাইনে গিয়ে খবরাখবর জানতে চোখ ভুলানোর চেষ্টা করেছি। এই হাসপাতালে মনে হয় আমিই একটু খবরাখবর জানার চেষ্টা করেছি। আমিতো তেরটি বছর ধরে সংবাদকর্মী পেশায়। একটু ইচ্ছে থাকারই কথা।
এই হাসপাতালে ২৪ ঘন্টা মানুষ মানুষকে বাঁচাতে প্রতিযোগিতায় থাকে। প্রাণপণ লড়াই করছে। কারো আছে মনোবল। আবার কারো আছে অর্থবিত্ত। কিন্তু চিকিৎসাশাস্রে ধনী-গরীব বলে রোগ বালাই নেই। ধনীর যেই রোগ, গরীবেরও সেই রোগ হতে বাঁধা নাই।
মায়ের মুখে সকালে খাবার ও ওষুধ দিয়ে এলাম। ওয়েটিংরুমে বসে থাকাবস্থায় এক দম্পতি এলো ডাক্তার দেখানোর পর বাড়ী যেতে টাকা নাই। এখন সাহায্যের প্রয়োজন। আরেক রোগীর জন্য ‘ও’ পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন। চুয়াডাঙ্গা জেলার এক দিনমজুর সন্তানকে বাঁচাতে প্রতিদিন ওষুধের টাকার ব্যবস্থার চিন্তায় থাকতে হয়। আমার সাথে কথা বলে জানতে পারি, তার ছেলের মাথায় টিউমার অপারেশনের জন্য দুই ব্যাগ ‘এ’ পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন। তিনি অনুরোধ করেছেন- আমি যেন রক্ত জোগাড় করে দেই। কথা দিয়েছি। এখন চেষ্টা করবো। ইনশাল্লাহ পারবো। আমার অনেক শুভানুধ্যায়ী আছেন তো!
তেইশ. ধরণীতে অসুস্থ্য ব্যক্তিগণ সবচেয়ে অসহায়। এটা আমার উপলব্ধি। সুস্থ্য থাকা অবস্থায় তাঁদের যত অর্থই থাকুক। নিজে অসুস্থ্য হলে শুধু সুস্থ্যতার চিন্তায় মগ্ন থাকে। আমি মনে করি কোন অসুস্থ রোগীর কাছে সুস্থ্য স্বজনদের সেবার দায়িত্ব ও দায়টা নেয়া জরুরী। আমার মায়ের বেলায় দেখলাম পাশে নারীকুল থাকা বা সেবা করার অপ্রতুলতা।
একুশ দিন পর মায়ের পাশে আমি একা। আর কোন স্বজন এই মূর্হুতে নেই। তাই ভাবলাম মানুষ অসুস্থ্য হলে বড় অসহায় হয়ে পড়ে। আমার পরিসংখ্যানে যতদ্দুর পরিচিত বংশে নারীকুলের সংখ্যা অনেক বেশি। তারপরও মায়ের পাশে একজন নারী সেবিকা পাওয়া দূরহ।
আমার ছোট ফুফু (আন্টি) বেশ ক’দিন মায়ের সেবা করেছেন। তাঁর কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। ফুফাতো বোন লাখী ও শিমুলের কাছেও ঋণী। তারা বিভিন্নভাবে পরামর্শ ও খাবার আর থাকার ব্যবস্থা করেন। নিয়মিত খোঁজ খবর নিচ্ছেন। প্রায় চার দিন পর মা আজ সকালে কথা বলতে গিয়ে বললো- বাবা, ভাত খাইছনি?
মাকে বললাম- খাইছি। তবে আরো ক’টাদিন আমাদের এসব নিয়ে ভাববেন না। আগে ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে উঠেন। তারপর সবার খোঁজ খবর নিয়েন। মায়ের মতন কে আছে এমন? জীবনঝুঁকি অবস্থায়ও সন্তানের খাবারের খবর নেন!
চব্বিশ. বাবারে! আমারে দু’টা ভাত কশালি দে। খাইলে মনে হয় মাথাটা আর ব্যথা কইরবো না।- দিতে পারলাম না! বাবা! আমারে একটা কলা খাওয়া।- দিতে পারলাম না!
অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার পূর্বে মা একটু পানি খেতে চাইলো।- দিতে পারলাম না! মায়ের এতো ছোট ছোট চাহিদা পূরণ করতে পারিনি!
একুশ রাত, বিশ দিন পর মঙ্গলবার মায়ের এমন চাহিদাগুলো পূরণ করতে পেরে মহান আল্লাহতালার কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। আল্লাহ মহান, আল্লাহ দয়াময়। আমাদেরকে রহমত দিয়েছেন। সন্ধ্যায় নিজ হাতে মায়ের মুখে ভাত দিলাম। মা খেলেন। কাঁটা বেচে মাছ দিলাম। মা খেলেন।
বিকালে মাকে একটা কলা একটু একটু করে মুখে দিলাম। মা খেলেন। পানিও খাওয়ালাম। আর লোচনের জল যেন মা না দেখে, সেদিকে খেয়াল রাখলাম। মনে মনে আল্লাহ’র দরবারে শুকরিয়া আদায় করলাম। মনে পড়লো মা যে আমাকে অসুখের সময় ভাত মুখে দিয়েছিল। সেই সন্ধ্যা রাতের কথা। মা-সন্তানের সর্ম্পকটা পৃথিবীতে মধুর ও শ্রেষ্ঠ।
পঁচিশ. ন্যাশনাল ইনিস্ট্রিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সেস এন্ড হাসপাতালে খুব বিষন্ন সময় কেটেছে। মায়ের চিকিৎসায় দায়িত্বরত বিভাগের চিকিৎসক রিলিজ দেয়ার পরামর্শ করেন। তাতে আমি খুব বিরক্ত ও বিষন্ন হয়ে পড়লাম। কারণ ব্রেন অপারেশনের পাঁচ দিনের মাথায় কাউকে এখানে রিলিজ দেয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। চিকিৎসকগণ আমাকে যুক্তি দেখালেন, হাসপাতালে অনেক রোগী। তাঁদেরও তো চিকিৎসা দিতে হবে। আপনারা দশদিন পর আবার এসে মাথার সেলাই কেটে নিবেন। আবার চার সপ্তাহ পর কয়েকটা পরীক্ষা করাবেন।
সহযোগী অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান যুক্তি তুলে ধরেন বললেন, বাংলাদেশে নয় কোটির মতো নারী। এই নয় কোটির জন্য তাঁদের বিভাগে মায়ের মতো অসুস্থ্যদের জন্য মাত্র দুইটি বেড সীট! শুনে অবাক হলাম। কষ্ট পেলাম।
সত্যিতো আমার মায়ের মতন অন্য কারো মায়ের চিকিৎসা হওয়া উচিত। কিন্তু আমার মা তো এখনও বসার বা হাঁটার শক্তি পায়নি। মাথার সার্জারি ভালো করে শুকায়নি। যেই পথে মাকে বাসায় নিবো রাস্তা ঝাঁকুনীতে মাথায় সমস্যা হবার বিষয়টি ফেলে দেয়ার মতো না। তারপর মন ভাঙ্গেনি, সাহস নিয়ে চেষ্টা করছি কেবিন অথবা চিকিৎসকদের সাথে আলাপচারিতায় মাকে আর একটু সুস্থ্য করে বাসায় ফেরার। পরে এসে পরীক্ষাগুলো করে নিতাম।
ছাব্বিশ. মাকে রিলিজ করেছে নিউরোসায়েন্স হসপিটাল। হাজীগঞ্জ মিডওয়ে হাসপাতালের কেবিনে পর্যবেক্ষণে রাখবো। ২২ তারিখ পুনরায় চিকিৎসককে দেখানোর জন্য বলা হয়েছে। সাতাশ দিন হলো মা অসুস্থ। আল্লাহ্র ওপর ভরসা। আগামী দিনগুলো মা ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে উঠুক স্রস্টার কাছে এই কামনা।
সাতাশ. ‘সময়ের কাছে আজ অনেক অসহায় হয়ে পড়েছি, মাকে খুব মনে পড়ছে, আর মনের ব্যাথা গুলো হয়তো বলা হবে না মাকে, জানি তবুও সন্তানের চোখের দিকে তাকিয়ে মনের কথা বুঝার ক্ষমতা শুধু মায়েরই থাকে। আসলে মায়ের আঁচলই হলো সন্তানের শান্তির নীড়।’- কথাগুলো আমার একমাত্র বোনের ফেসবুক আইডি থেকে নেয়া।
বোনতো সঠিক কথা লিখেছে। মা বোনকে যে কত ভালোবাসে সেটা বোনই জানে। মা আর বোন কত মিল ছিল- সেটা আমি দেখেছি। আমি বুঝি। হাসপাতালে বোনের অনুপস্থিতিতে মা কত বার যে ডেকেছে, তা আমি শুনেছি। আমাদের চার ভাইয়ের এক বোন। ভগ্নিপতি প্রবাসী। আমরা চেষ্টা করি মূল্যায়ন দিয়ে ভালোবাসা অটুট রাখার। আল্লাহ্ আমার বোনকে হেফাজতে রাখবেন। মায়ের অফুরন্ত দোয়া আছে।
আমি দেড় বছর হলো বিবাহ করেছি। আমার মাকে শ্বশুরগৃহে নিতে পারিনি। মনে বড় ধাঁধাঁ আমার। মা কেন যাবে না। কতদিন মায়ের সাথে অভিমান করেছি। মা রাগও হয়েছিল। কিন্তু আমার মন যে মানে না। মাকে আমার স্ত্রীর বাড়ীতে নিতে পারিনি। মা একদিন বুঝিয়ে বললো- বাবা, তোর এক বোন। ওই বোন জামাই তোর বিয়েতে ছিল না। এখন আমি কিভাবে তোর ভগ্নিপতিকে ছাড়া যাই!
মায়ের কথাটার যুক্তি আছে। আমিও ভেবেছি। না থাক, আমার প্রাণপ্রিয় ভগ্নিপতিকে ছাড়া মাকে কিভাবে নেবো। যুক্তির কথাটা নিয়ে হাসপাতালে বহুবার কেঁদেছি। মাকে তো আমার শ্বশুর বাড়ী দেখাতে পারলাম না!
শনিবার যখন মাকে রিলিজ করা হলো, খবর শুনে আমার ছোট ফুফু আসলো। মা তখন ওই দুঃখটা প্রকাশ করল। আমার মেয়ের জামাই দেশে আইছে। আমার ছেলের বউয়ের বাড়ীতে আমি জামাতা নিয়ে যাইবার কথা। না যাওয়ায় বাবলুর সাথে রাগারাগিও হলো। আর এখন আমি অসুস্থ্য- বলল মা।
মায়ের সার্জারী হবার একদিন পূর্বে ভগ্নপতি দেশে এলো। মায়ের সাথে দেখা করেছে। আবার যেদিন মাকে আনবো, সেদিন ভগ্নপতিও আমাদের সাথে আসবে শুনে মা খুশি হলেন।
আমার মা আজ তিনদিন হাসপাতালে শুয়ে ভগ্নপতিকে কি পিঠা, কি খাবার খাওয়াবে? কে করবে এসব? ভাবনার আকাশে মা। ভগ্নপতির জন্য মায়ের দোয়া আছে। বোনকে নিয়ে সুখী হোক আগামীর দিনগুলো। শান্তি পাবে আমার মা।
আটাশ. আরিবা জাহান রোজা। আমার ভাগনি। আমার মায়ের খুব আদরিনী। আজ সকালে মিডওয়ে হাসপাতালে এসে ভাগনি বলল- ‘নানু নাও!’ ভাগনির হাতে একটি চকলেট ছিল। মা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। নিউরোসায়েন্সস হসপিটালে মা কতবার ভাগনি কথা জিজ্ঞাসা করেছে- তার হিসাব রাখিনি। মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছি, আরিবা এখানে আছে। সবার সাথে দুষ্টুমী করে। নিউরোসায়েন্সস হসপিটালের শর্তের মধ্যে একটি হলো – শিশুদের প্রবেশ নিষেধ।
একদিন সকালে এসে ওই হাসপাতালের পরিচালক ডা. দীন মোহাম্মদ আমার ভাগনিকে দেখে হাসপাতালের কাস্টরিতে সাত ঘন্টার জেল দেয়ার রায় দেয়। জেলটা শিশুর অভিভাবকদের, শিশুর নয়। ভাগ্যিস, আনসারদের সাথে পরিচয় থাকায় আমাদের সাজাটা ভোগ করতে হয়নি। এক বছর চার মাস বয়সে আরিবা তার বাবা রুবেল রানা তালুকদারকে দেখেছে। বাবাকে পেয়ে আরিবা উজ্জেবিত। আমার মন কাঁদে, এই ভাগনির জন্যেও।
ঊনত্রিশ. বাবা, মার জীবনটা এতো ছোট কেন? মা মনে হয় বাঁচবো না! মাথায় এতো যন্ত্রণা আর সইতে পারি না। – এভাবে দিনভর মায়ের মুখে অজস্র কথা। মায়ের সেবা করতে গিয়ে দীর্ঘদিন শুনে আসছি যন্ত্রণায় কাঁতরানো কথাগুলো। কষ্ট শব্দের যত সমর্থক শব্দ আছে, সবগুলো যেন আমাকে বন্দি করে রেখেছে। মাকে ভোরে আবার ঢাকা আগারগাঁও নিউরোসায়েন্সস হসপিটালে নিয়ে যাবো। ১৫ দিন হাজীগঞ্জ মিডওয়ে হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখলাম।
চব্বিশ ঘন্টা মায়ের পাশে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে পরিবারের সবাই মাকে নিবিড়ভাবে সেবা করেছে। শনিবার মাকে পুনারয় পরীক্ষা-নিরিক্ষা করনো হবে। মায়ের মাথার সেলাই ও পিনগুলো সরানো হবে।
মায়ের খোঁজ খবর জানতে চায় শুভানুধ্যায়ীগণ। তাঁদের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ। কেউ মাকে দেখতে আসে, কেউ ফোনে খবরাখবর নিচ্ছেন। দেখা হলে তো সান্ত্বনা দিয়ে মায়ের সেবা করতে প্রেরণা যোগায় সবাই। শুক্রবার সন্ধ্যায় দৈনিক আলোকিত চাঁদপুর পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক মো. জাকির হোসেন, সাংবাদিক হাছান মাহমুদ, গাজী মো. নাছির উদ্দিন মাকে দেখতে এসেছেন। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
ত্রিশ. মাকে মঙ্গলবার সকালে বাসায় আনলাম। এক মাস একুশ দিন পর মনের গহিনে প্রশান্তচিত্ত লেগেছে। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। শত শত শুভানুধ্যায়ী মায়ের জন্য দোয়া করেছেন। আমরা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। মাকে নিয়মিত এক বছর ওষুধের কোর্স দিয়েছে চিকিৎসক। আমরা যেন বাসায় মায়ের সেবা করতে পারি আল্লাহ্ সেই তৌফিক ও রহমত নাযিল করুক। সাত বছর পর বাসা বদল করেছি। মাকে নিচতলা বা দোতলা বাসায় রাখা শ্রেয়। তাই নতুন বাসা নিয়েছি। মাকে নতুন বাসায় নিয়ে এলাম। মা ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। আমিন।
আমার মায়ের প্রতি আনুগত্য প্রতিটি সন্তানের মাঝে লালিত হবে। মায়ের ভালোবাসা কখনও ক্ষয় হয় না। অক্ষয় থাকুক আমার আর আমার মায়ের ভালোবাসা।
লিখেছেন : মনিরুজ্জামান বাবলূ