প্রশ্ন: কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার মৃত্যুসংবাদ মাইকে প্রচার করা যাবে? এ ক্ষেত্রে শরিয়তের বিধান কী?
উত্তর: হ্যাঁ, কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার মৃত্যুসংবাদ মাইকে প্রচার করা জায়েজ। কারণ, মৃত ব্যক্তির জানাযায় অধিক পরিমাণে লোক সমাগম শরিয়তে কাম্য। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মৃতের জানাযার নামাজ এক শ জন মুসলমান পড়ল, যারা সবাই তার মাগফিরাতের জন্য শাফাআত করে—তবে তাদের এ শাফাআত অবশ্যই কবুল করা হবে।’ (মুসলিম, হাদিস নং : ৯৪৭)
আর অধিক লোক সমাগমের মাধ্যম হচ্ছে প্রচার করা। তাই কিছু কিছু হাদিসে জানাযায় অংশ গ্রহণ করার জন্য মৃত্যুসংবাদ প্রচার করার বৈধতাই দেয়া হয়নি শুধু; বরং নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ‘তালহা ইবনে বারা (রা.) রাতে ইন্তিকাল করলে সাহাবিগণ রাতেই তাকে দাফন করে দেন। সকালে সংবাদটি নবী (সা.)-কে জানালে তিনি বলেন, কেন তোমরা আমাকে (তখন) জানালে না? (বুখারি, হাদিস নং:১২৪৭)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশির ইন্তেকালের দিন তার মৃত্যু-সংবাদ দিয়ে জানাযার স্থানে গেলেন, অতপর সাহাবায়ে কেরামকে কাতারবদ্ধ করে চার তাকবিরের সঙ্গে জানাযা আদায় করলেন। (বুখারি ১/১৬৭, হাদিস নং:১২৪৫;মুসলিম,হাদিস নং:৯৫১)
এক বর্ণনায় এসেছে, রাফে ইবনে খাদিজ (রা.) আসরের পর ইন্তেকাল করলে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-কে তার মৃত্যু-সংবাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করা হলো, তার জানাযা কি এখন পড়া যেতে পারে? তিনি বলেন, ‘আশপাশের গ্রামসমূহে খবর না দিয়ে রাফের মতো ব্যক্তির জানাযা পড়া যায় না।’
(সুনানে বায়হাকি,হাদিস নং:৪/৪৭)
এ জাতীয় হাদিস ও বর্ণনার আলোকে অনেক ফকিহ মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা দেওয়া মুস্তাহাব বলেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তিরমিজির একটি হাদিসে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমরা মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা থেকে বেঁচে থাক। কেননা তা জাহেলি প্রথা।’
অনেক আলেম এই হাদিস দ্বারা মৃত্যুসংবাদ প্রচার করাকে নাজায়েজ সাব্যস্ত করেছেন। তবে এভাবে দলিল গ্রহণ সঠিক নয়। কারণ এ হাদিসে শুধু মৃত্যুসংবাদ বোঝানো হয়নি। বরং জানাযার উদ্দেশ্য ছাড়া মৃতের গুণাবলী বর্ণনার উদ্দেশ্যে মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করা বা বিলাপ-আর্তনাদের সঙ্গে মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করাকে বোঝানো হয়েছে। যেটির নিষেধাজ্ঞা একাধিক হাদিস দ্বারা বোঝা যায়। হাদিস ব্যাখ্যাকারগণ এমনই বলেছেন। এতে জানাযা ও দাফনে শরিক হওয়ার জন্য মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করাকে নিষেধ করা হয়নি।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ও হুজায়ফা (রা.) প্রমুখ সাহাবিগণ নিজেদের মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করতে নিষেধ করে গেছেন, শুধু এভাবে প্রচারিত হওয়ার ভয়েই।(তিরমিজি,হাদিস নং:৯৮৪-৯৮৬)
নিম্নে তাদের কিছু ব্যাখ্যা ও উক্তি উদ্ধৃত হলো-
বিখ্যাত হাদিসবিশারদ ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগের মতো না করে, শুধু জানাযার নামাজের সংবাদ দেওয়ার জন্য মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করা মুস্তাহাব। কেননা হাদিসে জাহেলি যুগের মতো মৃতের গুণগান গেয়ে মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করতে নিষেধ করা হয়েছে। (আল-মিনহাজ, শরহে নববি : ৭/২১)
প্রখ্যাত হাদিসবেত্তা হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ‘মৃত্যু-সংবাদ প্রচার নিষিদ্ধ নয়, নিষিদ্ধ তো হলো জাহেলি যুগের কর্মকাণ্ড।’ (ফাতহুল বারি : ৩/১৪০)
ইবনুল আরাবি (রহ.) বলেন, মৃত্যু-সংবাদ প্রচার সংক্রান্ত হাদিসগুলোর সারকথা হলো-
১. আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও নেককারদের মৃত্যু-সংবাদ দেওয়া সুন্নত।
২. মৃতের প্রভাব-প্রতিপত্তি উল্লেখ করে মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করা মাকরূহ।
৩. বিলাপ ও আর্তনাদের সঙ্গে প্রচার করা হারাম। (ফাতহুল বারি, ৩/১৪০, আরেযাতুল আহওয়াজি, ইবনুল আরাবিকৃত : ৪/২০৬)
ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) বলেন, জানাযার কথা প্রচার করতে সমস্যা নেই। (আল জামেউস সগির,পৃষ্ঠা:৭৯)
ইবরাহিম হালাবি (রহ.) বলেন, বিশুদ্ধ মত হলো, মৃতব্যক্তির গর্ব-খ্যাতির উল্লেখ করা ছাড়া সাধারণভাবে অলিতে-গলিতে মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করা দোষণীয় নয়। কেননা জাহেলি যুগের প্রচার তো হলো, বিলাপ-আর্তনাদের সঙ্গে মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করা। (শরহুল মুনয়া,পৃষ্ঠা:৬০৩)
সুতরাং সাধারণভাবে মৃত্যুসংবাদ পৌঁছাতে কোনো সমস্যা নেই। আর তা মৌখিকভাবে যেমন করা যায়, তদ্রূপ বর্তমানে মাইকের মাধ্যমে আরো সহজেই পৌঁছানো যায়।
উল্লেখ্য যে, জানাযা কখন হবে এটি কোনো এলাকায় একবার জানিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট। কিন্তু কোথাও কোথাও দেখা যায় দীর্ঘ সময় নিয়ে মাইকে একই ঘোষণা অনেকবার করা হয়ে থাকে। এমনটি করা ঠিক নয়। কেননা এতে অন্যদের কষ্ট হতে পারে।
মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশিদের কাছে মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করা কোনো দোষের কিছু নয়। বরং তার জানাযায় শরিক হয়ে তার জন্য দোয়া করে তার প্রতি হক আদায় করতে পারে। (হানাফি ফিকহের বিখ্যাত গ্রন্থ বাদায়েউস সানায়ে : ২/২২; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১৫৭ রয়েছে)
প্রসঙ্গত, কোনো কোনো আলেম বাজারে মৃত্যুসংবাদ প্রচার করাকে মাকরূহ মনে করেছেন। তবে বিশুদ্ধ অভিমত হলো, এতে কোনো সমস্যা নেই। আদ্দুরুল মুখতার : ২/২৩৯; ফাতহুল বারি : ৩/১৪০; উমদাতুল কারি: ৭/২০
উত্তর দিয়েছেন: মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব, সহকারী মুফতি, জামিয়া রহমানিয়া সওতুল হেরা, টঙ্গী, গাজীপুর। সম্পাদক, আরবি ম্যাগাজিন মাসিক ‘আলহেরা’।
ইসলাম ডেস্ক
১৩ ফেব্রুয়ারি,২০১৯