Home / শীর্ষ সংবাদ / অনলাইনে করোনা সংকটেও রমরমা কোচিং বাণিজ্য
রমরমা কোচিং বাণিজ্য

অনলাইনে করোনা সংকটেও রমরমা কোচিং বাণিজ্য

করোনার মতো মরণব্যাধির মধ্যেও থেমে নেই কোচিং বাণিজ্য। অধিকাংশ কোচিং সেন্টারে অনলাইনে ক্লাস চলছে। এক্ষেত্রে পড়ার মান ভালো না হলেও আগের মতোই ফি নেয়া হচ্ছে। অনেকে আবার অনলাইনের অজুহাতে বাড়তি ফি আদায় করছে। অনেক নামিদামি কোচিং সেন্টার থেকে ছয় মাস বা এক বছরের ফি এককালীন পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। অগ্রিম ফি পরিশোধ না করলে কোচিং সেন্টারের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না।

অবিভাবকরা জানিয়েছেন, করোনার কারণে আর্থিক সংকটে আছে অনেকে। সংসারের নিয়মিত খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন অধিকাংশ অবিভাবক। এমন পরিস্থিতিতে কোচিং এর ফি পরিশোধের এমন চাপ দেয়া অমানবিক।
শিক্ষাবিদরা কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ জানিয়েছেন। একই সঙ্গে কোচিং বাণিজ্যে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবিভাবকদের আইনের আশ্রয় নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

শিক্ষক নামধারী কিছু সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তি কোচিং বাণিজ্য করে অবিভাবকদের বেকায়দায় ফেলে মোটা অংকের অর্থ আদায়ের এই কৌশল বন্ধের দাবি জানিয়ে অবিভাবকরা বলেছেন, যে সব শিক্ষকরা কোচিং করান তাদের অধিকাংশই নামিদামি বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তারা ক্লাসে ঠিকমতো না পড়িয়ে কোচিং এ ব্যস্ত। শিক্ষার্থী ও অবিভাবকরা কোচিং সেন্টারগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। করোনার মধ্যে আর্থিক সংকটেও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হয়নি বরং বেড়েছে।

করোনা সংক্রমণরোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। লকডাউন থাকায় শিক্ষার্থীরা ঘরের বাইরে গিয়ে পড়তে পারছে না। শিক্ষার্থীরা অনেকটা গৃহবন্দি জীবনযাপন করছে। এমন পরিস্থিতিতে সন্তানের মানসিক সুস্থতার কথা ভেবে কোচিং এ পড়ার সুযোগ দিতে চান অনেক অবিভাবক।

করোনা সংক্রমণরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয় বলে সরকার কোচিং সেন্টার বন্ধে নির্দেশ দিয়েছে। করোনাব্যাধির সংক্রমণের আশংকায় কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীরাও আসা বন্ধ করে দিয়েছে। দু’চার দিন বন্ধ রাখলেও বেশিরভাগ কোচিং সেন্টার অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে। মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে অগ্রিম ফি দিলেই কেবল শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টারের অনলাইন ক্লাসে যোগ দেয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে।

রাজধানীর ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, গুলশান, উত্তরা এলাকাতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলা মাধ্যমের তুলনায় ইংরাজি মাধ্যমের কোচিং এর ফি বেশি। বাংলা মাধ্যমের মাধ্যমিক শ্রেণির বিজ্ঞান শাখার প্রতিটি বিষয়ের জন্য করোনার আগে কোচিং ফি গড়ে ১ হাজার থেকে ১২’শ টাকা বা তার বেশি নেয়া হতো। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির গণিত, পদার্থ, রাসায়ন বা জীববিদ্যা কোচিং এ পড়াতে নেওয়া হত ১২’শ টাকা থেকে ১৫’শ টাকা বা তার বেশি। এভাবে বাংলা মাধ্যমের উচ্চ মাধমিক শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীকে গণিত, পদার্থ, রাসায়ন ও জীববিদ্যা এই চার বিষয় পড়তে প্রতি মাসে ৪ হাজার ৮’শ টাকা থেকে ৬ হাজার টাকা বা বেশি দিতে হতো। করোনার কারণে অনলাইনে জুমের মাধ্যমে কোচিং ক্লাস নেয়া হলে এখনো একই ফি আদায় করা হয়। করোনার আগে অধিকাংশ কোচিং সেন্টারে এককালিন ফি নেয়া না হলেও এখন ছয় মাস থেকে এক বছরের ফি অগ্রিম জমা দিতে বলা হয়েছে। এতে উচ্চ মাধ্যমিকের একজন শিক্ষার্থীর অবিভাবককে এক বছরের জন্য এককালিন ৫০ হাজার টাকার বেশি দিতে হচ্ছে।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ফটোকপি দোকানের ব্যবসায়ী আব্দুল জলিল বলেন, আমার ছেলে ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তার কলেজের কিছু শিক্ষক কলেজের বাইরে কোচিং করান। করোনার কারণে তারা একদিনও কোচিং বন্ধ করেনি। করোনার আগে আমার ছেলেকে পদার্থবিদ্যা, রাসায়নবিদ্যা, জীববিদ্যা ও গণিত এই চার বিষয় পড়াতে মাসে ৬ হাজার টাকা দিয়েছি। এখন অনলাইনে ক্লাস করাতেও একই ফি দিচ্ছি। মাসের ৫ তারিখের মধ্যে বিকাশে ফি পাঠিয়ে না দিলে ক্লাস করতে দেয়া হয় না। আমার ছেলেসহ ওর অনেক বন্ধু অনলাইনের ক্লাসে পড়া ভালো বুঝতে পারছে না। কিন্তু কি করবো? সন্তান বাসায় বন্দি। এর মধ্যে কোচিং বন্ধ করে দিলে ছেলে কিভাবে দিন কাটাবে ? অন্য কোন কোচিং এ ভালো পড়ায় কিনা তা করোনার মধ্যে খোঁজ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। এর মধ্যে পদার্থবিদ্যার স্যার ছয় মাসের টাকা এক বারে অগ্রিম জমা দিতে বলেছে। করোনার মধ্যে ফটোকপি করাতে তেমন কেউ আসে না। আমার ব্যবসা প্রায় বন্ধ। পরিচিতদের ব্যবসাও ভালো যাচ্ছে না। ধারকর্যও কেউ দিতে চায় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোচিং এর টাকা যোগাড় করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। করোনার মধ্যে কোচিং ফি কমানো উচিত ছিল।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আরিফ রহমান বলে, আমি যে কোচিং এ পড়তাম সেখানে করোনার জন্য এখন আর কেউ ক্লাস করতে যায় না। কোচিং এ জুমের মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস নেয়া হয়। আমার বাবা মাসের প্রথমে কোচিং ফি বিকাশ করে দেন। অনলাইনের চেয়ে স্যার সামনা-সামনি পড়ালে ভাল বুঝেছি। সামনা-সামনি স্যার অনেক নোট দিতেন। জুমে অনেকে একসঙ্গে ক্লাস করি। অনেক প্রশ্ন মনে আসলেও করতে পারি না।

অন্যদিকে কোচিং সেন্টারগুলোতে ১ জুন ইংরাজি মাধ্যমের ‘ও’ লেবেল এবং ‘এ’ লেবেলের নতুন ব্যাচ শুরু হওয়ার কথা। করোনার আগে কোচিং এ ‘ও’ লেবেলের প্রতিটি বিষয়ের ক্লাসের জন্য নেয়া হতো ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা বা তার বেশি। প্রতি মাসের ফি প্রতি মাসে পরিশোধের সুযোগ ছিল। এর বাইরে ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য ৮ হাজার টাকা এবং মকের জন্য ১২ হাজার টাকা বা তার বেশি আলাদাভাবে পরিশোধ করতে হত। এখন অধিকাংশ ইংরাজি মাধ্যমের কোচিং সেন্টারে মাসিক ফি পরিশোধের সুযোগ না রেখে ছয় মাস বা এক বছরের ফি একবারে অগ্রিম পরিশোধে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে এক বছরের জন্য একজন ‘ও’ লেবেলের শিক্ষার্থীকে শুধু কোচিং এ ক্লাস করতে একটি বিষয়ের জন্য দিতে হবে ৩০ হাজার টাকা বা তার বেশি।

রাজধানীর লালমাটিয়ার একতা কোচিং সেন্টারের সহকারি আশিষ বলে, আমাদের কোচিং সেন্টারে ‘ও’ লেবেলের রাসায়নবিদ্যা পড়তে হলে ৩০ হাজার টাকা এককালিন দিতে হবে। না হলে অনলাইন কোচিং এর সুযোগ দেয়া হবে না। এখানে পদার্থ ও জীববিদ্যায় পড়তে হলেও একই নিয়ম। ব্যবহারিক ক্লাস ও পরীক্ষা এবং মকের জন্য আলাদা ফি দিতে হবে। তাও অগ্রিম।

ইংরাজি মাধ্যম স্কুল গ্রীন হেরাল্ডের এক অবিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমার দুই ছেলে। একজন ‘ও’ লেবেলে, অন্যজন ‘এ’ লেবেলের শিক্ষার্থী। ‘ও’ লেবেলে পড়া ছেলেকে পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, সাধারণ গণিত, উচ্চতর গণিত, ইংরাজি এই ছয়টি বিষয়ে এবং ‘এ’ লেবেলে পড়া ছেলেকে পদার্থবিদ্যা, রাসায়নবিদ্যা, জীববিদ্যা এবং গণিত এই চারটি বিষয়ে কোচিং করাতে হবে। ওদের এক বছরের কোচিং ফি এককালীন অগ্রিম জমা না দিলে ক্লাস করতে দেয়া হবে না। দুই ছেলের জন্য ১ জুন এর আগে কোচিং ফি, রেজিস্ট্রেশনসহ আমাকে ৩ লাখ টাকার বেশি কোচিং এ জমা দিতে হবে। করোনার কারণে গত কয়েক মাস থেকে আমার ব্যবসা প্রায় বন্ধ। কোচিং ফি যোগাড় করা আমার জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এদিকে স্কুল বন্ধ। কোচিং না করালে ছেলেদের পড়াশুনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ইংরেজি মাধ্যমের বিভিন্ন বিষয় পড়ানোর জন্য রাজধানীতে সাধারণ মানের শিক্ষকের পাশপাশি রয়েছে নামিদামি কিছু শিক্ষক। করোনার আগে এসব শিক্ষকরা কোচিং সেন্টারে প্রতিদিন একাধিক ব্যাচ করে ক্লাস নিত। একটি ক্লাসের সময়সীমা ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট থেকে ২ ঘণ্টা ছিল। নামিদামি শিক্ষকদের প্রতি ক্লাসে একটি ব্যাচে ৬০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকত। কোচিং সেন্টারে ক্লাস করিয়ে বাংলা মাধ্যমের একজন শিক্ষক মাসে ২ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকাও আয় করেছে। ইংরাজি মাধ্যমের একজন শিক্ষক কোচিং করিয়ে মাসে ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা বা তার বেশিও আয় করে।

করোনা ব্যাধি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা বাণিজ্যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিও স্থবির হয়ে পড়েছে। মন্দা চলছে অধিকাংশখাতে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, করোনাকালীন এই আর্থিক সংকটে কোচিং নিয়ে এই বাণিজ্য করা উচিত নয়। যারা এই কাজ করছে তারা অমানবিক আচরণ করছে। সরকারের উচিত এখনই এই বাণিজ্য বন্ধ করা। অবিভাবকদের প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেয়া উচিত।