যুদ্ধে বিধ্বস্ত হাজীগঞ্জ লাওকোরার আজো মূল্যায়ন হয়নি

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার লাওকোরা গ্রামে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয়েছিল। ভয়াবহ যুদ্ধ বিধ্বস্ত গ্রাম লাওকোরা। আজও ওই গ্রামের যুদ্ধের মূল্যায়ণ হয়নি।

প্রত্যেকে প্রত্যেককে নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। গ্রামটিতে অধ্যাবদি নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ব। প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসছে, ঢাকা পড়ে যাচ্ছে এই গ্রামে পাক-হানাদার ও রাজাকারদের নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্বরতার কাহিনী। স্বাধীনতার পর অজোপাঁড়ার এই গ্রামটিতে পৌঁছেনি ধারাবাহিক উন্নয়ন।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাস্তা-ঘাট ও ২০০১ সালে গ্রামটিতে পৌঁছে বিদ্যুৎ। ১৯৫০ সালে মরহুম বশির উদ্দিন পন্ডিতের প্রচেষ্টায় নির্মিত হয় লাওকোরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তখন থেকে গ্রামটিতে ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষার আলো। উপজেলায় শিক্ষার হারে লাওকোরা গ্রামটি স্বাধীনতার পর একবার প্রথম স্থানে ছিল। দিনে দিনে গ্রামটি শিক্ষাসহ মৌলিক চাহিদা থেকে পিছিয়ে পড়ছে।

৪৬ বছর আগে ২৩ অক্টোবর ঘুমন্ত লাওকোরায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাক-সেনারা। ভয়াল সেই দিনের কথা বলতে গিয়ে আজও প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখের জল আঁকড়ে রাখতে পারে না। তেমনি পারেনি ৬০ বছর বয়সী বিধবা সখিনা বেগম।

তিনি ওইদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘পাঞ্জাবের নিষ্ঠুররা আমার স্বামীকে কোরআন শরীফও পড়তে দেয়নি। কোরআন শরীফ পড়া অবস্থায় গুলি করে মেরে ফেলেছে। শুধু গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি নরপিশাচরা। আমার স্বামীর মৃতদেহটির চিহ্ন রাখেনি ওরা। পুরো বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয় পাক-সেনারা। তখন আমার স্বামীর মৃতদেহ আগুনে পুড়ে আংগার হয়ে গেছে।’

তাঁর স্বামী জয়নাল আবেদীন মজুমদার। তিনি ১৯৭১ সনের ২৩ অক্টোবর পাক-সেনাদের নৃশংস ও বর্বর এই হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। শুধু তিনি নন, খাটের নিচে পালিয়ে হত্যার নির্মম দৃশ্যটি দেখে ভাগিনা ফোকরান চিৎকার না করে থাকতে পারেনি।

আর চিৎকার দেয়াটাই যে তার একই পরিণতি ঘটবে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না। মুর্হূতের মধ্যেই খাটের নিচে থেকে টেনে এনে কামানের গুলি ছুঁড়ে যাযরা করে দিলো বুকের খাঁচা। চলে গেলো তাজা প্রাণ। মামার বাড়ীতে বেড়াতে এসে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন রহিমানগরের ওই ফোকরান।

লাওকোরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে প্রায় ২০ জন ব্যাক্তির সাথে কথা বলেছিলাম। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বেঁচে নেই। উল্লেখ্যযোগ্য ব্যাক্তিগণ হলেন, তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মজিবুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা শামছুল আলম, ওই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার, প্রত্যক্ষদর্শী আবদুস শাকুর মজুমদার, আলী আজগর, আনোয়ার হোসেন, শামছুল হক, মৃত মাওলানা ফজলুল হক, আয়েশা বেগমসহ আরো অনেকেই।

কেন লাওকোরায় হানা দিল পাক-সেনারা?

লাওকোরা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল। এই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার জন্য একটি কমিটি তৈরি করা হয়। গ্রামের মজুমদার বাড়ী ও বড় ফকির বাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন সময় মিলিত হয়েছিল। ওই গ্রামের ফাজিল উদ্দিন ভূঁইয়ার দ্বিতীয় ছেলে আবুল বাসার বাসু ভূঁইয়া ছিল রাজাকারদের সহচর। তাকে মুক্তি সেনা ও গ্রামের লোকজন মিলে ধরে এনে মেরে ফেলে।

খবরটি পৌঁছে যায় হাজীগঞ্জে পাক-বাহিনীর ক্যাম্পে। এর কয়েকদিন পর মুক্তিযোদ্ধের একটি দল অলিপুরের মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের ওরফে উলকার নেতৃত্বে শাহরাস্তি উপজেলার সূচিপাড়ার মোশারফ ভূঁইয়ার সাথে আলোচনা করে ওই অঞ্চলে থাকার কথাছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের দেরি হওয়ায় লাওকোরা গ্রামটিতে এ যুদ্ধ হয়েছিল। যাওয়ার জন্য সবাই লাওকোরা মজুমদার বাড়ীতে মিলিত হয়।

দিনটি ছিল শুক্রবার। লাওকোরা জামে মসজিদে ওই দিন মুক্তিযোদ্ধারা জুমার নামাজ পড়েন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে গ্রামের আবুল কাশেম নামের এক যুবক গিয়ে রাজাকার বাচ্চুকে খবর দেয়।

শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে লাওকোরায় হানা দেয়ার প্রস্তুতি শুরু করে রাজাকার বাচ্চুর নেতৃত্বে পাক-বাহিনীর সেনারা। পরে অবশ্যই ১৬ ডিসেম্বর বুধবার দেশে স্বাধীনতা হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিসেনারা লাওকোরা গ্রামের আবুল কাশেম ও আবদুস ছালাম নামের দুই ব্যাক্তিকে তুলে নিয়ে যায়।

যেভাবে শুরু হয় যুদ্ধ

দিনটি ছিলো ১৯৭১ সালের পহেলা রমজান ২৩ অক্টোবর, শনিবার। শুক্রবার চাঁদ দেখে সবাই তারাবীর নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে ছিল। রোজা রাখার জন্য সবাই সেহরী খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওইদিকে রাজাকার ও পাকিস্তানী সেনারা গ্রামের তিনটি প্রধান সড়ক দিয়ে ঘিরে ফেলে। ঘুমন্ত লাওকোরায় শুরু হলো গোলাগুলি। গ্রামটিতে পাকিস্তানীরা আগে ফায়ার করেছিল।

মুক্তিযোদ্ধাদের সোর্স হিসেবে যারা নিয়োজিত ছিলেলেন তারাও ওই মহুর্তে বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেনি। মজুমদার বাড়ী থেকে মুক্তি যোদ্ধারা দক্ষিণ ও পূর্ব মুখী হয়ে শক্তভাবে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম মুখী হয়ে যে মুক্তি সেনারা অবস্থান নিয়েছিলÑ তারা শুরুতেই হোঁচট খেয়ে ছটকে পড়েছিল। এতে করে লাওকোরায় মুক্তিযোদ্ধাদের পরাজয়ের গ্লানি পোহাতে হয় বলে মন্তব্য করেছেন তৎকালিন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মজিবুর রহমান।

এই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্ইু গ্রুপ একসাথে জড়ো হয়েছিল। এখানে বিএলএফ গ্রুপের নেতৃত্ব দেন খোরশেদ আলম বাচ্চু। তার বাড়ী শাহরাস্তির ইছাপুরা গ্রামে। অপরটি স্টুডেন্ট ফোর্সের নেতৃত্ব দেন আবুল খায়ের মোল্লা। তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন আবদুল হাকিম মোল্লা।

তারা এই যুদ্ধে অংশ নেয়। এলএমজিসহ আবদুল হাকিম মোল্লাকে বিদ্যালয় সংলগ্ন সাঁকোর কাছে বসানো হয়। অথচ তিনি এলএমজিটা খালে ফেলে পালিয়ে যাওয়ায় দুর্বল হয়ে পড়েছিল আবুল খায়েরের মুক্তি সেনারা।

যা যা হয়েছিল লাওকোরা গ্রামে

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ হয়েছিল। তারপর মুক্তিযোদ্ধারা ফরাস্ত হয়ে পড়েন। দুপুরের পর পাক-বাহিনী লুট-পাট শুরু করে। এই গ্রামে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি মজুমদার বাড়ীতে আগুন দেয়া ও বড় ফকির বাড়ীতে হৃদয়বিদারক ঘটনার ট্রাজেডি তৈরি করা।

যুদ্ধের তিনদিন পূর্বে বড় ফকির বাড়ীতে একটি বিয়ে হয়েছিল। তখন ওই বাড়ীতে নতুন বর-কনের অবস্থান ছিল। ওই বাড়ী থেকে পাক-সেনারা জহির ও বাতেনকে ধরে নিয়ে ফকির বাড়ীর মাঠে গুলি করে মেরে ফেলে। তাদের নতুন বোন জামাইকে তারা রেহাই দেয়নি। তাকে মেরে ফেলেছে পাঞ্জাবীরা। জয়ী হলে কী করে? – সেদিন পাকিস্তানিরা সেই বাড়ীতে এভাবেই জয়ের আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠেছিলো।

আক্ষেপ করে ওই দিনের যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে উয়ারুক-রাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শামছুল আলম বলেছিলেন, ‘স্টুডেন্ট ফোর্সে থাকা আবদুল হাকিম মোল্লার এলএমজি চালু থাকলে এ পরিণতি হতো না গ্রামটির।’ খবর নিয়ে জানা গেছে, তার বাড়ী শাহরাস্তি উপজেলার টামটা গ্রামে। তিনি সেই যে পালিয়ে ছিলেনÑ আর ৩২ বছর পর দেশের বাড়ীতে এসেছিলেন। বর্তমানে তিনি জীবিত নেই।

লাওকোরা গ্রামে যুদ্ধের পরিসংখ্যান

এই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়েরের স্টুডেন্ট ফোর্স ছিল ৩৬ জন। বিএফএল গ্রুপে মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম বাচ্চুর নেতৃত্বে ছিল ৩৪ জন মুক্তিসেনা। অন্যদিকে ৪৫ জন পাঞ্জাবী সেনা ও রাজাকার বাচ্চুর নেতৃত্বে ৬৫ জন ছিল।

এখানে একজন লেফটেনেন্ট্যসহ ২২ জন সেনা সদস্য ও রাজাকারসহ প্রায় ৫৫ জন নিহত হয়। পাঞ্জাবদের সেই মৃতদেহ গুলো গ্রামের বিভিন্নজনের নৌকা দিয়ে পারাপার করে নিয়ে যায়। গ্রামের নৌকার মাঝি হিসেবে ছিলেন দিঘীর পাড়ের শামছুল হক। তিনিও যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছিলেন।

পাঞ্জাবীরা এই গ্রামে বড় অস্ত্র হিসেবে আর্টিলারি ব্যবহার করেছে। ভাগ্য ভালো হওয়া ওই আর্টিলারি গোলাটি বিস্ফোরিত হয়নি। এতে পুরো গ্রামটি ভয়াবহ ধ্বংস লীলা থেকে রক্ষা পেয়েছিল। তিন দিকে থেকে ঘিরে ফেলে পাঞ্জাবীরা। তাদের একজন সেনা নিহত হলে ‘ইয়া আলী’ বলে অন্যরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এমনটাই বলেছেন গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীরা। এটি ছিল চাঁদপুর জেলার সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।

এই গ্রামে জয়নাল আবেদীনের মতো আগুনে পুড়ে মারা যান মজুমদার বাড়ীর আরো একজন। এছাড়া পাক-সেনাদের বুলেটের আঘাতে রক্তে রঞ্জিত হয়ে প্রাণ হারান দুই মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৭ জন বাসিন্দা। আর আহত হন ৭ জন।

নিহত দুই মুক্তিযোদ্ধা হলেন, শাহরাস্তি উপজেলার আলীপুর গ্রামের ইলিয়াছ মোল্লা (১৮) ও হাজীগঞ্জ উপজেলার শমেশপুর গ্রামের জহিরুল ইসলাম পাঠান (১৮)। দুই মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল হক পাঠান ও ইলিয়াস প্রাণ হারালেও তাদের বুলেটের খোসা দেখে হতবাক হয়েছিলেন পুরো গ্রামবাসী। পাকিস্তানীদের বুলেটের আঘাতে তাদের মাথার খুলি উড়ে যায়।

তার আগে লড়াই করেছিলেন যেই এলএমজি দিয়ে, সেটি’র বুলেট শেষ হয়ে যাওয়ায় প্রাণ হারাতে হয়। ২৫ অক্টোবর তাঁদের মৃতদেহ রঘুনাথপুর-গোলবাহার হয়ে নাসিরকোর্ট সমাধিস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখানে তাঁদের সমাধি করা হয়।

২৩ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর এই দুইদিন বড় ফকির বাড়ীর মাঠে তাঁদের মৃতদেহ মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল।

নিহত মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস আলীর পাঞ্জাবীদের বুলেটের আঘাত খাওয়ার পূর্বে বড় ফকির বাড়ীর একটি রান্না ঘরে মুড়ি ভাজার খোপা মাথায় দিয়ে কিছুক্ষণ পালিয়ে ছিলেন। তার কাছে থাকা সকল বুলেট শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি মজুমদার বাড়ীতে যাওয়ায় চেস্টা করেছিলেন। বড় ফকির বাড়ী থেকে মজুমদার বাড়ীতে যাওয়ার পথে তিনি পাঞ্জাবীদের গুলিতে নিহত হন। এভাবেই স্মৃতিচারণ করেছিলেন ওই গ্রামের গৃহবধু মরহুমা আয়েশা বেগম।

লাওকোরা গ্রামের নিহত বাসিন্দাদের মাধে রয়েছেন জয়নাল আবেদীন মজুমদার (৫৫), ইয়াছিন মজুমদার (২৫), সৈয়দ আবদুল বাতেন (২৮), মো. আবু তাহের (১৬), হাফিজ উদ্দিন পাটওয়ারী (৫৮), আমির হোসেন পাটওয়ারী (৫৫), চাঁদ মিয়া পাটওয়ারী (৩০), সোনা মিয়া (৭৫), চাঁদ মিয়া বেপারী (৩৮), ছিদ্দিকুর রহমান সর্দার (৪৫), সৈয়দ মোস্তফা কামাল (৩৭), মো. ফোরকান (১৬), মো. হুমায়ন কবির (১৭), ফাতেমা খাতুন (৫৬) ও রাহেলা খাতুন (৪৫)।

আহতরা হলেন, জুনাব আলী মজুমদার (৬৮), হাফিজ উদ্দিন গোপাল (৭০), মো. আবদুর রহিম বেপারী (৩৫), মো. তবদিল হোসেন গোপাল (১৪), রহিমা খাতুন (১৮), রেজিয়া খাতুন (১৪) ও তাজুল ইসলাম (২৫)।

এই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন দুইজন। তাঁরা হলেন মরহুম মোজাফ্ফর হোসেন মজুমদার ও মুন্সী বাড়ীর আবদুস সাত্তার। ওইদিন তাঁরা গ্রামে ছিলেন না।

ভয়াল দৃশ্য দেখা গ্রামবাসীর স্মৃতিচারণ

শহীদ জয়নাল আবেদীন মজুমদারের স্ত্রী সখিনা আক্তার কান্না জড়িতকন্ঠে বলেন, ‘৬ মাসের ছেলে জহির কে নিয়ে যুদ্ধের আগের দিন বাপের বাড়ীতে যাই। তাই বাইচা গেলাম, যেই বাঁচার কোন মূল্য নাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থাকতে দুই ভান টিন আর ৩’শ টাকা পাইছি।’ ছেলে জহিরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘ যেই রাজাকারগো লাইগা আমার বাবারে দেখতে পারলাম না, তাদের ফাঁসি চাই।’

প্রত্যক্ষদর্শী একেএম আবদুস শাকুর মজুমদার বলেন, ‘মজুমদার বাড়ীতে মুক্তিযুদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছে খবর পেয়ে পাঞ্জাবীরা বর্বরতা চালিয়েছে। ভোরবেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় রাজাকার বাচ্চুর নেতৃত্বে গ্রামের তিনদিক দিয়ে আকস্মিক হামলা চালায়। আমরা খবর পেয়ে দৌড়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধাদের জাগিয়ে দিয়েছি। প্রায় অপ্রস্তুতভাবে যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় মোকাবেলা করেন মুক্তিযোদ্ধাগণ।’

প্রত্যক্ষদর্শী আলী আজগর মজুমদার বলেন, ‘আমাকে ধরে পাশ্ববর্তী মাইঝের বাড়ীর উঠানে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি গ্রামের আমার চেয়ে বয়স্ক অনেক পুরুষ সারিবদ্ধভাবে পিছনে হাত বাঁধা। আমাকে বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরপরই পুরো বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয় নির্দয় পাক-সেনারা। তখন দুপুর সাড়ে ১১ টা বাজে। এই বাড়ীর ৩টি ঘর ছাড়া বাকী ২৫টি ঘর আগুনের লেলিহানে ভূমিস্মত হয়ে যায়।’

পাঞ্জাবীদের মৃতদেহ বহনকারী গ্রামের বাসিন্দা শামছুল হক। তিনি বলেন, ‘তখন আমি পানের ব্যবসা করতাম। পাঞ্জাবীরা এসে আমার ভাইকে মারধর করা শুরু করল। তারপর আমাকে ধরে খন্দকার বাড়ীর সামনে নিয়ে আসে। সেখান থেকে আমার নৌকায় তিন পাঞ্জাবের মৃতদেহ নিয়ে উয়ারুক স্টেশন নামিয়ে দেই। তখন নামিয়ে দেয়ার পর আমাকে বেদম মারধর করেছে তারা। এভাবে আমাদের গ্রামের প্রায় ১৫/২০ টি নৌকা দিয়ে তাদের মৃতদেহ গুলো কচুয়া, শাহরাস্তি উপজেলার মেহার স্টেশন, উয়ারুক বাজার ও হাজীগঞ্জে নিয়ে গেছে।’

প্রত্যক্ষদর্শী ও তৎকালীন উপজেলা ছাত্রলীগ কর্মী বড় ফকির বাড়ীর আনোয়ার হোসেন মেম্বার বলেন, ‘২৩ অক্টোবর ভোর সাড়ে ৫ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত এই গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ নরকীয় ঘটনা ঘটে। পাক-বাহিনীর দোসরদের সহযোগিতায় গ্রামটিতে তান্ডবলীলা চালানো হয়। গ্রামের পূর্বে মুড়াগাঁও-গোলপুর, দক্ষিণে টংগীরপাড়-নোয়াপাড়া আর পশ্চিমে বেলঘর-রাজাপুরা দিয়ে পাঞ্জাবীরা হামলা শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াছ ফকির বাড়ীর মাঠে আর জহিরুল ইসলাম পাঠান মজুমদার বাড়ীতে মারা যান। এই গ্রামে ১৭ জন শহীদ হলেও প্রায় ৩০ জন নারী ধর্ষিত হয়েছে।’

অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধার কথা
তরুণ বয়সে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে লাওকোরা গ্রামে আসেন আজাগরার মুক্তিযোদ্ধা শামছুল আলম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক রাতের জন্য এই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থানে নিয়েছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বাচ্চু রাজাকারের নেতৃত্বে ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের উপর হামলা শুরু করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা হামলা শুরু করে। গ্রামের তিনদিক দিয়ে আক্রমণ করেছে, সেটা প্রথমে বুঝতে পারিনি।’

তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মুজিবুর রহমান বলেন, ‘ লাওকোরা গ্রামটিতে আজও যুদ্ধের মূল্যায়ণ হয়নি। প্রত্যেকে প্রত্যেককে নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। তরুণ প্রজন্মের কাছে চেতনা বোধ জন্ম হয়নি। জেলার সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয়েছিল এই গ্রামে। এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ব নির্মাণ করা প্রয়োজন। মুক্তিযোদ্ধাদের সোর্স দুর্বল থাকা ও আবদুল হাকিম মোল্লা এলএমজি ফেলে পালিয়ে যাওয়ায় ওই গ্রামে যুদ্ধে আমরা পরাজিত হতে হয়েছিল। ’

লাওকোরা গ্রামটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
চাঁদপুর-কুমিল্লা মহাসড়কের উয়ারুক স্টেশন থেকে ৪ কিলো মিটার উত্তরে লাওকোরা গ্রামটি। জেলার কচুয়া ও হাজীগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শৈলখালী খালের ওপর একটি পাকা পুল নির্মাণ করেন তৎকালীন শাসক।

চাঁদপুর জেলার এই পুলটি সর্বপ্রাচীন ইট দ্বারা নির্মাণ করা হয়েছে। পুলটি ১৩৩৪-৪২ সনে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের রাজত্বকালে স্থানীয় শাসক আমান শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিলো বলে জনশ্রুতি আছে।

লাওকোরা গ্রামে আমান শাহ ফকিরের ভগ্ন প্রাসাদ ও ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ রয়েছে। পাশেই রয়েছে প্রাচীন কবর। ভগ্ন প্রাসাদটিকে লোকে ফকিরের ভিটা বলে।

লেখক-মনিরুজ্জামান বাবলু
গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক কর্মী
মোবাইল-০১৮১৬০৬৩০৪১

: আপডেট, বাংলাদেশ ২ : ০০ পিএম, ২৫ অক্টোবর, ২০১৭ বুধবার
এইউ

Share