Home / শিল্প-সাহিত্য / জীবন সায়াহ্নের গল্প…
জীবন সায়াহ্নের গল্প...

জীবন সায়াহ্নের গল্প…

তাকে সবাই ধিক্কার দেয়…, গালমন্দ করে।

তিনি এখনও অনেক বড়ো হতে পারেননি। তার বয়স এখন ৪০। তিনি এখনও বড় হননি সমাজের চোখে! ছোট, একদম ক্ষুদ্রই রয়ে গেছেন অর্থ-বিত্তে দুরবীনের ক্যানভাসে।

মানুষের সম্পদের লোভ সীমাহীন।

দিন দিন সম্পদ বাড়ানোই মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস। এ সমাজে সম্পদে যে বেশি পুষ্ট ও দুষ্ট; তাকে বেশিরভাগ লোকই মান্যিগন্নি করে, তোয়াজ-তোষামোদ করে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্র পাঠায়, প্রয়োজনে নিজেরাই তার বাড়িতে গিয়ে ধর্না দেয়, নেড়ি কুকুরের বাচ্চার মতো পদলেহন করে, হাত-পা চুলকায়।

সবাই লোকটিকে অপাংক্তেয় ভাবে।

এই লোকটির নাম মিজানুর রহমান। সম্ভবত পরিবারের লোকেরা এই নামটি না বুঝেই রেখেছে। ‘মিজান’ আরবি শব্দ। এর অর্থ পাল্লা। আর রহমান অর্থ- দয়ালু। মিজানুর রহমান শব্দের অর্থ দাঁড়ায় দয়ালুর পাল্লা।

সমাজের অথর্ব লোকেরাই এখন দয়ালুর পাল্লা হবার ভাণ করে, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমার, লুণ্ঠন আর অসৎ শাসন-শোষণের কালো টাকা-পয়সা দু’একদিন বিলিয়ে পত্রিকায় ছবি ছাপিয়ে নিজেদের দয়ালু, উদারতার আধার হিসেবে জাহির করতে চায়। আর যার নাম মিজানুর রহমান সে তা করতে পারে না। তার অর্থ-বিত্ত-প্রতিপত্তি নেই। সে শুধু শব্দের পর শব্দ রচনা করতে জানে, গল্পের প্লট নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা কোরে। কবিতায় শব্দগুলো জুৎসইভাবে একটার পর একটা সাজাতে জানে। কিন্তু প্রচলিত সমাজের অন্য দশজনের মতো অঢেল টাকা-পয়সা রোজগার করতে জানে না, অর্থের বন্যা দিয়ে পরিবারের মধ্যে তুফান তুলতে জানে না। তাই তাকে পরিবার নিদারুণ চোখে প্রত্যক্ষ করে, তিরস্কার করে।

তার পরিবারের লোকেরা তাকে বকে, শুধু মা ছাড়া। মা বকেন না। তিনি তো গর্ভে ধারণ করেছেন, তার কাছে সব সন্তানই সমান।
যে মিজানুর রহমান গল্প লেখেন, কবিতা রচনা করেন তিনি জানেন না তিনিও একদিন কারো কোনো গল্পের উপজীব্য হয়ে যাবেন। আর তিনি এটা করতেও চান না। তিনি বিখ্যাত হবার ভাণ করেন না, বা বিখ্যাত হতেও চান না। তিনি স্বভাবে লেখক, রক্তে-অস্থিমজ্জায় তার লেখালেখির চিন্তা। কেউ কেউ তাকে পাগল বলে, কেউবা ভালোবেসে দু’এককাপ চাও খাওয়ায়। তবে যারা চা খাওয়ায় তাদেরকেও লোকেরা পাগল বলে। বলে, ‘পাগলে পাগল চেনে!’

এ সমাজে যারাই সত্যের কথা প্রচার করে, জ্ঞানের মহিমায় ভাস্বর হতে চায় তাদেরকে যুগে যুগেই পাগল বলা হয়েছে, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও দিতে পিছপা হয়নি। তাই আজকে আমাদের গল্পের মূল চরিত্র মিজানুর রহমানও এর ব্যতিক্রম নন।

মিজানুর রহমান দীর্ঘদিন ধরেই এ পথে আছেন। তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরেই সমাজের কথা বলেন, মানুষের কথা বলেন, রাজনীতি-অর্থনীতির কথা বলেন, শুধু বলেন না নিজের কথা। নিজের কোনো উচ্চাশার কথা কখনোই তার গল্পে বা কথায় প্রকাশ পায় না।

প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারও মিজানুর রহমানের জীবনে ঘনায়। একদিন তিনি ক্ষয়ে ক্ষয়ে উপলব্ধি করেন জীবনকে উপভোগ করতে হবে, গল্প নয়- ধন উপার্জন করতে হবে। নিজের তত্ত্বকথার মমত্ব ত্যাগ করে, জীবনকে জীবন বলে কাব্য-গল্প রচনা করার চেয়ে এখোন তার কাছে অর্থ-সম্পদ মুখ্য হয়ে গেছে।

তিনি কী করবেন ভেবে পান না।
কীভাবে অর্থ আয় হবে তা তিনি জানেন না। একবার ভাবেন চুরি-ডাকাতি করলে মন্দ হয় না। ক’দিনের মধ্যেই ম্যালা টাকা ধান্ধা করা যাবে। কিন্তু তিনি তা পারেন না। চুরির অভ্যাস নেই, ডাকাতি তো দূরের কথা।

একবার ভাবেন রাজনীতি করার কথা। কারণ এই পথে অনেক দস্যু-তস্কর, রাজাকারও হয়ে গেছে দেশপ্রেমিক, তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা শোভা পায়। রাস্তায় লোকেরা অভিবাদন জানায়। ইজ্জত-সম্মান কদর বেড়েছে তাদের।

রাজনীতিও তার অসহ্য। সাধারণ মানুষকে ধাপ্পা দিয়ে তিনি বড় হতে চান না বা তিনি এটা করার মতো অভিজ্ঞতাও অর্জন করেননি। কী করবেন তাহলে? গল্প লিখে তো সবাই বড়লোক হতে পারে না, দু’একজন ব্যতিক্রমী ছাড়া।

সময় তাকে দাঁড় করায় কঠিন এক আবর্তের দিকে। আর বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় এক অন্তহীন সীমান্তে যেখানে দিন-রাত শুধু লেখা আর লেখা। এটা শুধু লেখার রাজত্ব। এখানে লাইভ লাইভ খেলা হয়। এখানে কল্পনার কোনো অসাঢ়তা নেই। কল্পনা করে কিছু করা যায় না, বাস্তবতা ছাড়া।

আর হবেই বা কীভাবে, পত্রিকার নিউজ তো কল্পনা করে লেখা হয় না! ‘যা কিছু ঘটে ব্যতিক্রমী তাই নিউজ।’ বলতে থাকেন নিউজ অ্যাডিটর। ‘যেমন কুকুর মানুষকে কামড়ালে তা নিউজ হয় না, কিন্তু মানুষ কুকুরকে কামড়ালে তা নিউজ হয়। আবার কর্মকর্তা কর্মচারীকে পেটালে তা নিউজ হয় না, কিন্তু কর্মচারী কর্মকর্তাকে পেটালে তা নিউজ হয়।’

ক্রমে ক্রমে তিনি শিখে যান কীভাবে নিউজ রচনা করতে হয়। তিনি এখন প্রত্যহ ছুটে চলেন নিউজের সন্ধানে। কখনো আগে, কখনো পিছে, কখনও নিউজের মধ্যেই তার বসবাস। কাঁধে একটা ক্যামেরা নিয়ে প্রতিদিন ছুঁটে চলেন কর্তব্য কাজে। প্রায় বছর খানেক কাজ করলেন তিনি। তাকে ডিঙ্গিয়ে জুনিয়ররা সিনিয়র হলো, কিন্তু মিজানুর রহমানের এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। কাজতো সবই, জুনিয়র আর সিনিয়র আবার কী?

মাঝে মাঝে তিনি ব্যথায় কাতরান। সহকর্মীরা বিয়ে করার উপদেশ দেন। বিয়ে করলে নাকি সব ব্যথা সেরে যাবে। মানুষ একশ’ পার্সেন্ট জ্ঞান অর্জন করতে পারে না বিয়ে নামক ফাঁস ছাড়া।

কিন্তু মিজানুর রহমান ভাবেন বিয়ের মালা গলায় দিয়ে যদি আবার সেই মালায় পেঁচিয়ে জীবন নাশ হয়ে যায় তাহলে তার জীবনটা হবে নিরার্থক। বিয়ের চিন্তা তিনি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন। বিয়ে আর করা হয়ে ওঠে না।

হাতে টাকা আসে ক্রমে ক্রমে। সেই টাকা তিনি ব্যাংকে রাখেন। ভাবেন বেশি টাকা দিয়ে কী হবে, এগুলো ব্যাংকেই থাক। ব্যাংক এগুলোকে লালন-পালন করুক। একদিন ভাবা যাবে এই টাকা দিয়ে কী করা যাবে। খরচের চেয়ে তার আয় বেশি বলে ব্যাংকে এক সময় অনেক টাকা হয়। হতে থাকে, হতে থাকে টাকা। এই টাকা সে পরিবারের কাউকে পাঠায় না। নিজেও কাউকে দান করে না।

ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যার আলো পৃথিবীতে পড়ে। আবার রাতশেষে সকালের সূর্য হাসে। প্রভাতের শিশিরগুলো তাকে একদিন এক সুন্দর ঘোড়া উপহার দেয়। সেই ঘোড়ার আশেপাশে সে এক মানবীকে দেখতে পায়। অপূর্ব সুন্দরী নয়, একদম সাধারণ আট-দশটা মানবীর মতোই সে। তবে ব্যতিক্রম সে, এই পৃথিবীর শত কোলাহলেও হাসতে জানে খিলখিলিয়ে, যেনো সমাজ-সংসারের কোনো চিন্তা-ভাবনা, জরা-যন্ত্রণাই তাকে স্পর্শ করতে পারে না।

সেই মানবীর নাম মাইশা। মাইশা হাসে আর গভীর চিন্তনে হাত বাড়ায় তার পানে। দু’জনের বন্ধুত্ব হয় গভীর। মাইশার সাথে কিছুটা সময় পার করেন তিনি। তিনি ক্রমে ক্রমে ভুলতে চেষ্টা করেন তার আদর্শ, তত্ত্ব, জ্ঞান ও দর্শন। রঙিন পৃথিবী মাঝে রঙের নেশায় আবদ্ধ হয়ে যান তিনি।

মাইশা তাকে নিয়ে যায় জীবনের এক স্বপ্নচূড়ায়। যেখানে স্বপ্ন আর স্বপ্ন। ঘুম আর জাগরণের তফাৎ খুব কম। স্বপ্নে বিভোর হয় দু’জন, জীবনের প্রতিনিয়ত হাতছানিতে কিছুটা সময় লিপ্ত হতে থাকে তারা।

একদিন মাইশা ঘুমস্বপ্নে জানায় সমাজের অসংখ্য অসঙ্গতির কথা। তার এক বান্ধবীর কথা। যাকে একদল পুরুষ রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। সেই গল্পে বিভোর হয় সে, বলতে থাকে তারপর তার বান্ধবী সেই পুরুষদের কবল থেকে ফিরে এসে তাকে বলেছিল, মেয়েটির বুকের মাঝে অসংখ্য পুরুষের হাত খেলা করতে থাকে। কিলবিল করে পোকার মতো। ঘিন ঘিন করে ওঠে সেই হাতগুলো। তার বুকের জমিনে সেই হাতগুলো খোঁজে রঙ্গের মেলা। সেই মেলায় সব পুরুষের হাত একত্রিত হয়ে স্বপ্ন বোনে। জীবন, মানুষের জীবন মাঝে মাঝে এভাবেই অন্যের বুকের জমিনে চড়াই-উৎরাই পার হয় রঙিন সুখে।

তিনি জানে মানুষের জীবন ভঙ্গুর, ক্ষণস্থায়ী। একদিন তাকে আড়মোড়া ভেঙ্গে এই সমতলের ভঙ্গুর ও কণ্টাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হবে। ভুলে যেতে হবে মাইশার গল্প। তবে মাইশাকে নিয়ে তিনি রোমান্টিক গল্প রচনা করবেন, যখন মাইশার ছায়া তার জীবনে আর পড়বে না, শুধু তার স্মৃতিময় ক’টা দিন ভাসবে নয়নের জলে। তিনি মাইশাকে নিয়ে রচনা করেন অনেক অনেক গল্প। গল্প থেকে গল্পান্তরে ভাসতে ভাসতে তিনি উপভোগ করেন কিছুটা সময়।

প্রকৃতির নিয়মেই সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে। ক্রমশ অন্ধকার ঝেঁকে বসে তার জীবনে। মাইশা অচিনপথের যাত্রী হয়ে রঙিন পৃথিবীর দেয়ালে আঘাত করে কাঁচের মতো। ভেঙ্গে যায় রঙিন পৃথিবীর কাঁচগুলো। কিন্তু রয়ে যায় মাইশা ও তার জীবনের গল্পগুলো পাঠকের মনে।

এক সময় তার আকাশে মেঘের আনাগোনা। মেঘ থেকে বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তিনি জীবনের মানে খোঁজেন। তার কাছে এসব অর্থহীন প্রলাপের মতো মনে হয়। স্বপ্ন তার কাছে মনে হয় অদূরদর্শিতা। বেঁচে থাকা মনে হয় নিরর্থক। অর্থকে মনে হয় ড্রেনের জঞ্জালের মতো।

তিনি ব্যাংকে যেয়ে তার জমানো অর্ধেক টাকা মায়ের নামে বিকাশ করে দেন। তারপর বাকি অর্থ নিয়ে চলে যান হিমছড়ির সাগরের উত্তাল তরঙ্গের মায়ায়। তিনি কক্সবাজারের হোটেল প্রবালে থাকেন সাত রাত সাতদিন। হাতের সব টাকা-পয়সা যতো সম্ভব দ্রুত খরচ করতে থাকেন।

পৃথিবীর মায়া ক্রমে ক্রমে ত্যাগ করতে থাকেন তিনি। ভাবেন অর্থহীন জীবন রেখে আর লাভ কি? এ জীবন শেষ করার আগে তো অনেক গল্পই হলো। আজকেই হবে তার গল্পের শেষ অধ্যায়। সারা রাত ধরে মদের মদির নেশায় আচ্ছন্ন হন তিনি। তারপর সৈকতের বালুতে বসে শুরু করেন গল্প আকাশের চাঁদের সাথে। রাতের অর্ধেকটা সময় ধরে কথা বলে বলে তার জীবনের পূর্ণতা আর অপূর্ণতা বলে যেতে চান। চাঁদ হাসে, তিনিও হাসেন। ক্রমে ক্রমে চাঁদের আলোয় ভাটা পড়ে। সৈকতজুড়ে নিকষ অন্ধকার নেমে আসে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন সাগরের জলে নিজেকে মিশিয়ে দেবেন চিরতরে। হাসতে হাসতে নিকষ অন্ধকারে সাগরের পাড়ে ঘুরে বেড়ান, তারপর তিনি শেষবারের মতো পৃথিবীর আলো-আঁধারির খেলা সাঙ্গ করে সাগরের জলে নিজকে সোপর্দ করার জন্যে নেমে পড়েন।

এমন সময় অদূরে দু’জন মানুষের ফিসফাস আওয়াজ তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। একজন পুরুষ, অন্যজন নারী। নারী বলছে, ‘তুমি আমার হাত ধরে রেখো। যতক্ষণ না আমরা সাগরজলের অতল জলে মিশে যাই ততক্ষণ তুমি আমার হাত ধরে রেখো। আমাদের মৃত্যু যেনো একসাথেই হয় এবং সেটা যেনো লোকেরা চিরদিন মনে রাখে।’

‘হ্যাঁ, আমরা তাই করবো।’ পুরুষ কণ্ঠ বলে যেতে থাকে। ‘সাগরের সীমাহীন জলে আমরা আমাদের প্রেম-পূর্ণতায় ভরিয়ে দেবো। অপ্রাপ্তির মাঝে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না।’

এরপরই ঝুপ করে আওয়াজ হলো।

তিনি খুব দ্রুত সে আওয়াজের দিকে এগুতে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকারে সমুদ্রের পানিতে ঝড়তোলা একজোড়া কপোত-কপোতীকে আবিষ্কার করেন।

খুব কষ্ট করে তাদেরকে ডাঙ্গায় তুলে আনেন তিনি। দু’জনই নোনা পানি পেটে ধারণ করেছে। ডাঙ্গায় উঠে বমি করে কিছুটা উগড়ে দেয়। কিছুটা স্বাভাবিক হলে তিনি তাদের কাছে জানতে পারেন তাদের মৃত্যুকে সাদরে বরণের চেষ্টা, উদ্দেশ্য এবং এর আগের কাহিনী।

তিনি তাদের কাহিনী শুনে অবাক হন। মানুষ মানুষকে ভালোবেসে এভাবে মরতে পারে? পাওয়ার চেয়ে জীবনকে ত্যাগ করার মধ্যে অনেক মহত্ব, এরা তাই ভাবছিল এবং তাই তাদের কাহিনীকে অমর করে রাখার জন্যে জীবনকে হাসিমুখে বিদায় জানাতে চেয়েছিল।
তিনি ভাবেন, নিজকে অমর করে রাখার জন্যে তিনি নিজ প্রাণ বিসর্জন দিতে যাননি। শুধু বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন মনে করেই নিজকে সাগরজলে জীবন বিসর্জন দিতে চেয়েছিলেন।

প্রেমপাগল ছেলেমেয়েটিকে তিনি তার হোটেলের কামরায় নিয়ে আসেন। তারপর তাদের হাতে নিজের অর্জিত বাকি ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা দিয়ে বলেন, আজই এই হোটেলে তোমাদের বিয়ে হবে। আমার পক্ষ থেকে তোমাদের জন্যে থাকলো এই নগণ্য আর্থিক উপহার। এই টাকা দিয়ে তোমরা কিছু একটা করে জীবন চালাবে।

মৃত্যুর আগে নিজের অর্জিত টাকাগুলো কারো উপকারে দান করতে পেরে তিনি উৎফুল্ল হলেন। ভাবলেন, যাক হোটেলের গর্ভে টাকাগুলো বিলীন হবার চেয়ে অন্তত একটা কাজে তো লাগলো। এইবার নিজের জীবনটা সাঙ্গ করে ধন্য হওয়া যাবে।

আজ সেই মৃত্যুর অতি আকাক্সিক্ষত রাত। সাগর সৈকতে বসে আছেন তিনি। কিছুটা দূরে একটি সারমেয় শুয়ে আছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। গত রাতের মতোই তিনি রাতের অর্ধেক সময় ধরে চাঁদের সাথে কথা বললেন। চাঁদের সাথে অস্পষ্ট আওয়াজে দূরের সেই সারমেয় তার কাছাকাছি এসে বসে পড়লো। তিনি তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললেন। সে কিছুই বললো না, শুধু তার কথা শুনলো। তিনি বললেন, ‘তুমি একটা কুকুর। তোমার সাথে আমার এই শেষ কথা, যেমন শেষ কথা বলেছি চাঁদের সাথে। তুমি শুনে রাখো, আজ আমার জীবনের শেষ রাত। কিছুক্ষণ পরে যখোন চাঁদ ডুবে যাবে, আর তুমি ঘুমিয়ে পড়বে তখোন আর কেউ জেগে থাকবে না আমার কথা শোনার জন্যে। আমি তখোন সাগরের জলের সাথে মিতালী করবো, এবং নিজকে মিশিয়ে দেবো ওই অথৈ জলে। আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। একমাত্র মৃত্যুই পারে আমাকে আবার নতুন করে অন্য দেশে নিয়ে যেতে।’

কথা বলতে বলতে চাঁদের বাড়ি যাবার সময় হয়। চাঁদের আলো ক্রমশ ঘোলা হয়ে হয়ে চলে যায় অন্য দেশে। কুকুরটিও ঘুমিয়ে পড়ে।

তিনি আস্তে আস্তে উঠে অগ্রসর হন সাগরের জলের দিকে। একরাশ ঢেউ এসে তাকে নিয়ে যায় অনেক দূরে। তিনি হাবুডুবু খেতে থাকেন আর তার পেটে চলে যায় একরাশ নোনতা পানি। ডুবে যাবার আগে তিনি আবারও তাকান এই পৃথিবীর অশান্ত জলরাশির দিকে। বেশ ভালো লাগছে সাগরের জলে মৃত্যুকে ধীরে ধীরে গ্রহণ করতে। পানি খেতে খেতে তিনি এক সময় প্রায় নি®প্রাণ হয়ে গেলেন।

কুকুরটি হঠাৎ করেই উঠে বসলো। তারপর সে ঝাঁপ দিলো সাগরের জলে। সাঁতরিয়ে সে চলে এলো তিনি যে জায়গায় হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। তারপর তার শার্টের কলার কামড়ে ধরে তাকে টেনে টেনে নিয়ে এলো বেলাভূমিতে।

তিনি এখনো অজ্ঞান। কুকুরটি চিৎকার করছে। এমন সময় আবার মেঘের ফাঁক গলে বেরিয়ে এলো চাঁদের আলো। দূরে মসজিদের মাইকে আযান হলো- আল্লাহু আকবর …।

হঠাৎ করেই মুখভর্তি পানি উগরিয়ে বের করে জ্ঞান ফিরে পেলেন তিনি। তারপর চোখ মেলে তাকালেন পাশে দাঁড়ানো উৎকণ্ঠিত কুকুরটির দিকে। কুকুরটি তাকে চোখ মেলতে দেখে জিহ্বা দিয়ে তার মুখ চাটতে লাগলো। তিনি উঠে বসলেন, আবারও মুখ দিয়ে কিছু নোনতা পানি উগড়িয়ে ফেলে দিলেন। তারপর দুই হাঁটুতে ভর করে দাঁড়িয়ে উঠে দেখলেন ভোর হয়ে আসছে পৃথিবীর পরে।
সকালের মৃদু হাওয়া বইছে। শরীরে সে হাওয়া অপূর্ব ভালোলাগার আবেশ জড়িয়ে এলো। তিনি বেলাভূমি ধরে হোটেলের দিকে হাঁটতে লাগলেন। কুকুরটিও তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো উৎফুল্লভাবে। এক সময় তিনি আবার হোটেলের কামরায় ফিরে এলেন। দেখলেন তার কামরায় আলো জ্বলছে। বাইরে থেকে সেই ছেলেমেয়েটির উচ্ছ্বাসমুখর হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

সেই সময় তার জীবন বাঁচানো প্রিয় কুকুরটিও আনন্দে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো।

তিনি ভাবলেন পৃথিবীতে এতো হাসি এতো খুশির জোয়ার বইছে আর তিনি কি-না এসব গল্প অসমাপ্ত রেখেই চলে যাচ্ছিলেন না ফেরার দেশে। ঠিক আছে, আর ক’টা দিন বেঁচে থেকে দেখাই যাক না আর কি কি গল্প অপেক্ষা করছে তার জন্যে। এবার সত্যি সত্যিই তার বেঁচে থাকার ইচ্ছে হলো।

তিনি ঘরের দরজায় টকটক করে আওয়াজ করলেন। মেয়েটি দরজা খুলে দিল। ছেলেটি চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকার ভাণ করে শুয়ে আছে। মেয়েটির চোখেমুখে ভালোবাসার এক অপার্থিব আনন্দ খেলা করছে। সারা রাত হয়তো দু’জন মিলে গল্প করে সময় কাটিয়েছে।

মেয়েটি তাকে দেখে বললো, ‘আসুন লেখক সাহেব। আসুন। গতরাতে আমার বাবা মুঠোফোনে কল করেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, আমাদেরকে তারা মেনে নিয়েছেন, আমরা আজ সকালেই দু’জন মিলে চলে যাবো পিতা-মাতার কাছে। আপনাকে ধন্যবাদ, আপনি আমাদের জন্যে অনেক করেছেন। আমাদের জীবন বাঁচানোর জন্যে আপনার কাছে আমরা চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।’

এ সময় তার পাশে দাঁড়ানো কুকুরটির কথা মনে পড়লো, এই সুন্দর পৃথিবীতে নতুন করে তাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে, আরো কিছুদিন বেঁচে থেকে অনেক অনেক গল্প লেখার জন্যে কুকুরটির কাছেও তাকে চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকতে হবে।

তিনি আর কিছু বললেন না, ভাবলেন না। শুধু কুকুরটিকে সঙ্গে করে চলে গেলেন হিমছড়ির পথে। আজও পর্যটকরা সেখানে গেলে কুকুরটির সাথে লোকটিকে দেখতে পায় মাথায় হ্যাট পরে তিনি উদ্দেশ্যহীনভাবে, বিক্ষিপ্ত ঘোরাফেরা করছেন। (কাল্পনিক)

মিজানুর রহমান রানা; কবি, লেখক ও ঔপন্যাসিক (রচনা-নীল জোছনা, সম্পাদনা- আধুনিক কবিতা সঙ্কলন গর্হন) প্রধান সম্পাদক চাঁদপুর টাইমস

 

|| আপডেট: ০৭:০৭ পিএম, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, শনিবার

এমআরআর