Home / সারাদেশ / মিলনমেলায় মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে গেলেন একাত্তরের রণাঙ্গণে
মুক্তিযোদ্ধারা

মিলনমেলায় মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে গেলেন একাত্তরের রণাঙ্গণে

শীতের বিকেলে মৃয়মান সূর্যের সকল আলো ঝল-ঝল করছিলো রাজধানীর মগবাজার আউটার সার্কুলার রোডের ৭০ নম্বর বাড়ির ছাদে। যেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাঈল হোসেন বেঙ্গলের আমন্ত্রনে ঢাকা ও এর আসপাশে ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শতাধিক মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আয়োজন করা হয় ব্যতিক্রমধর্মী এক মিলনমেলার। অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য উপস্থিত সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ৭১ এর রণাঙ্গণের মহান মুক্তিযুদ্ধে।

দীর্ঘদিন পর শনিবার  এ আয়োজনে জীবন সায়াহ্নে এসে শ্রদ্ধেয় মুক্তিযোদ্ধারা অনেকদিন পর একে অপরকে কাছে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। ব্যতিক্রমী এ অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজধানী ঢাকার বেঙ্গল প্লাটুনের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাঈল হোসেন বেঙ্গল। তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেঙ্গল সংগঠনটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান, সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা সিটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।

বাড়ির প্রশস্ত ছাদে বিকাল ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্ব। বৈকালিক চা-নাস্তা খেতে খেতে একে অন্যের সাথে কুশলাদী বিনিময় করেন। কীভাবে সময় কাটছে, কার শারীরিক অবস্থা কেমন, পরিবারের সদস্য কতজন, তারা কে কি করছেন, জীবন সঙ্গীনীসহ নাতিপুতিদের খবরা খবর বিনিময় করেন।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই একসাথে সবাই মিলে জামাতে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন তারা। এসময় মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গণের সাথী শহীদযোদ্ধাদের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা হয়। মাগরিবের জামাতে ইমামতি করেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক মহানগরীরর কমান্ডার আলহাজ্ব নূরুল ইসলাম।

এরপর, শুরু হয় আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রথমেই মুক্তিযোদ্ধা একজন সাংবাদিক ইসমাইল হোসেন বেঙ্গলকে প্রশ্ন করেন, শ্রদ্ধেয় কমান্ডার আপনি বলবেন কী; কেন আমাদের স্মরণ করেছেন? কেন এ মিলন মেলা ? এর পিছনে কি কোন উদ্দেশ্য আছে? মাইকের সামনে এসে বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল তার স্বভাবসুলভ ভাষায় বললেন, ‘আমি প্রায় প্রতিদিনিই খুব ভোরে টেলিফোনের আওয়াজে জেগে উঠি। টেলিফোন ধরতেই অপরপান্ত থেকেই ভেসে আসে কোন এক রনাঙ্গণের সাথীর না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার বেদনা বিধুর খবর। আমাকে প্রায়সই এমনি ধরনের খবর শুনে পড়তে হয় (ইন্নাল্লিলাহি ওয়াইন্না ইলাহি রাজিউন)।’

একথা বলেই, মুক্তিযোদ্ধা বেঙ্গল ঢুকরে কেঁদে উঠেন। তাঁর এ বুকভাঙ্গা ব্যাথাতুরে কান্না শুনেই নিরব নিস্তব্দতায় উপস্থিত সকল মুক্তিযোদ্ধাদের চোঁখে পানি এসে যায়। কিছুক্ষন পর আবেগ সংবরণ করে তিনি বলেন, ‘আমি আমার রণাঙ্গণের সাথী নূর ইসলামকে ফোন করি। কথাটা তাকে বলতেই সে জবাব দেয়, তুই কাঁদিস কেনো? আমার আরো বেশি কান্না আসে। সে বলে, ভয় হচ্ছে না। আমি বলি হ্যাঁ, না, মানে আমি রাণাঙ্গণের সাথীদের সাথে একসাথে মিলিত হতে চাই। সে আমাকে বলে একি জানাযার প্রস্তুতি নাকি। আমি সুধাই যাই বলিস ভাই। এ আমার আকাঙ্খা। সে আমাকে সমর্থন করে। সমর্থন করে আরেক বন্ধু। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নূরুল আমিন। তাকে বাসায় আসতে বলি। তার পর দুজন একসাথে বসে এক এক করে যতটা মনে পড়ে সাথীদের ফোন করে আমন্ত্রন জানাই। আজকে তোমরা সবাই এসেছো। আমরা একত্রিত হয়েছি। আসো আমরা সবাই মিলে যুদ্ধের কিছু স্মৃতি কথা, বর্তমানের কিছু না পাওয়ার ব্যথা ভাগাভাগি করি।

এ বলে তিনি শ্রোতাদের মধ্যে থেকে বক্তব্য রাখার জন্য এক এক করে সবাইকে আহ্বান করেন। একে একে বক্তারা স্মৃতিচারণ করেন এবং সেই সাথে কিছু উপদেশ দেন। জীবন সাহ্নানে অল্প সময়ের মধ্যে মহান আল্লাহর প্রদত্ত নির্দেশাবলী পালন করে কিভাবে সত্যের পক্ষে সৈনিকের ভূমিকায় অবর্তীন হয়ে দায়বদ্ধতা থেকে দেশবাসীর কল্যাণে কাজ করতে পারি। সেই সাথে মহান মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিকথা নিজস্ব ভাষা বর্ণনা লেখার জন্য তাগিদ দেয়া হয় এবং সবার কথা স্বনিবেশ করে বই আকারে একটি সংকলন প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

চমৎকার একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ইসমাঈল হোসেন বেঙ্গলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার ভূয়সী প্রশংসা করেন বক্তারা। আশা করা হয় অন্যরাও এমনিভাবে মাঝে মাঝে এ ধরনের মিলন মেলার আয়োজন করবে।

সভায় অন্যানের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থন করেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সেক্রেটারী জেনারেল নঈম জাহাঙ্গীর, মুক্তিযোদ্ধা দলের ভাইস চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা ক্র্যাক প্লাটুনের মাহফুজ আমান, মো. হারুন, রিজবী, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সিটি কমান্ডার ও বাকী ইউনিটের সদস্য শফিকুর রহমান শহীদ, বাকী ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডার আতিকুর রহমান আতিক, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সিটি কামান্ডার আব্দুল আজিজ এফএফ, জেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা শেখ আতাউর রহমান, সাবেক এমপি বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ঝিনাইদহের নুরুদ্দিন, ময়মনসিংহের মুক্তিযোদ্ধা পিনু, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন, শফিকুল আক্তার রবি সহ আরো অনেকে।

এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা গ্রুপ ছবি তোলেন জনে-জনে, জোড়ায়-জোড়ায়। বিনোদনের জন্য গান পরিবেশন করেন টিভি ও রেডিওর প্রখ্যাত শিল্পি নারগিস আক্তার। অসুস্থতার জন্য প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী অনুষ্ঠানে না আসতে পারলেও তিনি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের শুভেচ্ছা জানান। এসময় অ্যানান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দেশের বরেণ্য কবি ও সাহিত্যিক দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক আল মুজাহিদি, কবি আবুল ফজল, কবি মাহমুদুন নবী যতি, মুক্তিযোদ্ধা ফখরুল ইসলাম।

সাভার থেকে যানজট ফেরিয়ে অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে যোগদান করেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পদ্মা রহমান ও তার স্বামী ব্যাংকার মুক্তিযোদ্ধা সাদেকুর রহমান। সভাশেষে সকলে একসাথে রাতের বিশেষ খাবারের জন্য মিলিত হন। অনুষ্ঠানের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন ইসমাইল হোসেন বেঙ্গলের তিন সন্তান ইব্রাহীম ইবনে ইসমাইল কমল, ডা. রাজিব এবং রোহান ও আহ্বান ফাউন্ডেশনের সদস্যরা।

আতাউর রহমান সোহাগ