Home / তথ্য প্রযুক্তি / ফেসবুক: বিষন্নতা সৃষ্টির যন্তরমন্তর ঘর
ফেসবুক

ফেসবুক: বিষন্নতা সৃষ্টির যন্তরমন্তর ঘর

ফেসবুকের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন। বিশেষত পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখার একটি ভার্চুয়াল উপায় হিসেবে ফেসবুকের আবির্ভাব ঘটে (কিন্তু গন্ডগোলটা এখানেই, কারণ আমরা এখন এক ঘর থেকে অন্য ঘরেও ফেসবুক বা ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে যোগাযোগ করি)। ফেসবুকের কল্যাণে আমরা এখন আমাদের বন্ধু বা চারপাশের মানুষজনের হাঁড়ির খবর জানতে পারছি। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় তখন যখন আমরা তার সাথে নিজেদের হাঁড়ির তুলনা শুরু করি। আর যখনই আমাদের হিসেব মেলে না তখনই যত ঝুটঝামেলা উঁকি দেয়। অন্যের সাথে তুলনা করতে গিয়ে আমাদের অবস্থা হয়, ‘সবার অংক মেলে, আমার অংক মেলে না’। কারণ আপনি যখন অন্যের সাথে নিজের তুলনা করেন তখন সবসময় নিজের অবস্থাকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরেন। আপনার বন্ধুর ট্যুরে যাওয়ার ছবি দেখে আপনার মনে হয়, ট্যুরে কেন আমি যেতে পারছি না। তখন আপনি নিজের ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গিয়ে বন্ধুর সাথে নিজেকে তুলনা করা শুরু করেন। আর তখনই ঘটে যত বিপত্তি। দেখা গেলো আপনি হয়তো টাকা জোগাড় করতে না পেরে বা পারিবারিক সমস্যার কারণে ট্যুরে যেতে পারেননি। ব্যাস, মুহূর্তের মধ্যে মনটা হয়ে যায় বিষন্ন। হয়তো সেদিন পুরোটাই একরাশ বিষন্নতায় ডুবে থাকেন আপনি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর এই পরিমাণ ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কী ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয়েছে সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ এসব মাধ্যমে মানুষ এত বেশি সময় ব্যয় করছে, এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছে যে কখনো কখনো তার বাস্তবজ্ঞান আর থাকছে না। বাস্তবতা তার কাছে নিরর্থক হয়ে মেকি ভার্চুয়াল দুনিয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এতে করে মানুষের মনের ওপর স্বভাবতই চাপ পড়ছে, তার ভাবনাচিন্তার পরিধি পাল্টে যাচ্ছে। বিশেষত ফেসবুক বর্তমানে তরুণ সমাজকে বেশি প্রভাবিত করছে। তরুণরা ফেসবুককে তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে ধরে নিচ্ছে, তারা ফেসবুকের বিকল্প ভাবতে পারছে না। মেকি ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এভাবে নিজেকে বিকিয়ে দেওয়ার ফলে তরুণ সমাজ আজকে তাদের সমস্ত মানসিক উদ্যম হারিয়ে ফেলেছে। তারা হয়ে পড়েছে মানসিকভাবে অসুস্থ, অস্থিরচিত্ত, বিষণ্ণ। মানুষের সামগ্রিক মানসিক সুস্বাস্থ্যের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।

২০১৭ সালে ফেসবুকের একজন কর্মকর্তা চামাথ পালিয়াপিতিয়া ফেসবুক প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন,

’ আমরা এমন মাধ্যম তৈরি করেছি যা আমাদের সমাজের স্বাভাবিক বিকাশের গঠনকে ধ্বংস করে ফেলছে।’

পালিয়াপিতিয়ার মতে, ফেসবুক হচ্ছে ‘ডোপামিন পরিবাহক একধরনের স্বল্পমেয়াদী ফিডব্যাক লুপ’। ফেসবুকে লগ-ইন করার পরই আমরা এক অন্য দুনিয়ায় হারিয়ে যাই। নিউজফিড স্ক্রল করার সময় আমাদের সামনে হরেক রকমের পোস্ট ভেসে আসে। এসব পোস্ট দেখে আমরা হাসি, কাঁদি আবার কখনো বিরক্ত হই। এই ভিন্নধর্মী আবেগগুলো আমাদের মনের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলে। সোজা কথায়, ফেসবুক আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কীভাবে ফেসবুক আমাদের মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে দেওয়া হলো।

আরেকটা ব্যাপার হলো ফেসবুকের কর্মকাণ্ড দেখে আপনি কারও ব্যক্তিজীবনের সুখ-দুঃখের হিসেব করতে পারবেন না। হয়তো আপনার বন্ধুর পারিবারিক জীবনে যথেষ্ট অশান্তি চলছে বলে সে কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার জন্য এই ট্যুরটি বেছে নিয়েছে।

তো এই সোজা কথাটা মাথায় রেখে নিজের ভালোটা বুঝুন। এমন কোনো কাজ করুন যাতে আপনার লাভ হবে। আপনার সময়টুকু ভালো কাজে লাগান, কোনো উৎপাদনশীল কাজে। যেমন, আমি যদি এই লেখাটা সেদিন না লিখে ফেসবুকে বসে থেকে মিম দেখে বেড়াতাম তাহলে কি আজকে আপনি এটা পড়তে পারতেন? এখন প্রকাশিত লেখাটা পাঠক পড়ছে দেখে আমার নিজের কাছেই তৃপ্তি হচ্ছে। সুতরাং ফেসবুকে বাড়তি সময় না দিয়ে এমন কোনো কাজ করুন যাতে আপনার নিজের কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতার প্রকাশ ঘটে ও মানসিক সন্তুষ্টি লাভ হয়। তখন আর ফেসবুকে অন্যের আনন্দঘন ছবি দেখে আপনার ভ্রুক্ষেপও হবে না।

লাইক ও কমেন্টের সংগ্রাম

মনে পড়ে প্রথম যেবার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে প্রোফাইলে ছবি টাঙিয়েছিলেন, সেবার কত ‘লাইক’ পেয়েছিলেন? আচ্ছা, যা-ই পান না কেন, তখন কি কোনো আক্ষেপ হয়েছিল লাইক-কমেন্টের সংখ্যা নিয়ে? আর এখন কি হয়?

বেশিরভাগ মানুষই এই প্রশ্নের উত্তরে না-বোধক জবাব দিলেও মনে মনে কিন্তু সবাই এর উল্টোটাই লালন করেন। সবারই মনে একটা সুপ্ত বাসনা থাকে বেশি বেশি লাইক, কমেন্ট বা শেয়ারের জন্য। এই বাসনা অমূলক নয়, অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু যখন আপনি লাইক-কমেন্টের সংখ্যা নিয়ে বেশি সিরিয়াস হয়ে যান, তখনই সমস্যা শুরু হয়ে যায়। এসবের সংখ্যা বেশি হওয়ার সাথে সাথে সুখানুভূতির মাত্রাটাও বাড়তে থাকে। আবার লাইক-কমেন্ট না জুটলে মন খারাপ হয়, নিজেকে ব্যর্থও মনে হতে থাকে। আমাদের ফেসবুক ব্যবহারের একটা বড় অংশই জুড়ে রয়েছে এই লাইক-কমেন্টের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির আক্ষেপ।

একই বছরের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯-৩২ বছর বয়সীরা যত বেশি ফেসবুক ব্যবহার করেন, তাদের বিষন্নতায় ভোগার হারও তত বেশি। তারা ‘বিষন্নতার অসীমচক্রে বন্দী’। সাইবারবুলিয়িং, নেতিবাচক তুলনা ইত্যাদির কারণে বিষন্নতা ও চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দিতে পারে। ফেসবুকে অতিরিক্ত আসক্তির কারণে স্নায়ুতন্ত্র সম্পর্কিত জটিলতা, মনস্তাত্ত্বিক উত্তেজনা এমনকি সামাজিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত আসক্তির কারণে মানুষ ফেসবুকে এত বেশি সময় ব্যয় করে যে ঘুমানোর প্রয়োজনীয় সময়টুকুও পায় না। ঘুম কম হলে নানারকম শারীরিক অসুবিধা তো হয়ই, পাশাপাশি অপরিমিত ঘুম আচরণগত পরিবর্তনও ডেকে আনতে পারে।

ফেসবুক যোগাযোগের একটি মাধ্যম হলেও যোগাযোগের সবটুকু আনন্দ এতে পাওয়া যায় না। কারণ বাস্তব যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমরা যেসব অবাচনিক যোগাযোগ রূপগুলো (Nonverbal gestures) দেখি ও অনুধাবন করি, ফেসবুকে তা করার কোনো উপায় নেই। এমনকি যোগাযোগের ক্ষেত্রে শারীরিক নড়াচড়ার (Bodily movement) যে ভূমিকা, তা-ও ফেসবুক বা সোশাল মিডিয়ায় অনুপস্থিত। সুতরাং ফেসবুক যোগাযোগের যন্ত্র হলেও তা বাস্তব যোগাযোগ ব্যবস্থার সবগুলো প্রয়োজনীয় উপাদানকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না।

তবে সব কথার শেষ কথা হলো, ফেসবুক আপনাকে কতটা মানসিক অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিতে পারে তা নির্ভর করছে আপনি কীভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছেন তার ওপর। ব্যবহারকারীই ঠিক করবেন ফেসবুককে তিনি নিয়ন্ত্রণ করবেন নাকি ফেসবুক তার ওপর নিয়ন্ত্রণ ফলিয়ে তার মানসিক অবস্থাকে দুর্বিষহ করে তুলবে।

ঢাকা চীফ ব্যুরো, ০১,মে,২০২১;