বিশেষ সংবাদ

পলিথিনের বিকল্প পাটের ব্যাগ

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম পলিথিন বাজারজাত ও ব্যবহার শুরু হয় ১৯৮২ সালে। অল্প সময়েই পলিথিন ব্যবহার মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও জরিপে দেশে পলিথিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি এমন মত উঠে আসে। পরিবেশবিদসহ সচেতন সব মহল থেকেই পলিথিন উৎপাদন বন্ধ,আমদানি নিষিদ্ধ ও ব্যবহার বন্ধের জন্য আন্দোলন শুরু হয়।

ফলে সরকার ২০০২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করে দেশকে পলিথিন ব্যাগমুক্ত ঘোষণা করে। যদিও সরকারের এই ঘোষণা ‘কাজীর গরু খাতায় আছে গোয়ালে নেই’ প্রবাদের মতোই কার্যকর হয়। প্রথমদিকে সরকারি নজরদারি ও তৎপরতার কারণে পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার কমে এলেও এখন যে হারে পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার হচ্ছে তা দেশকে ২০০২ সালের পূর্ববর্তী অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

পলিথিন অপচনশীল বলে মাটিতে সূর্যালোক,পানি এবং অন্যান্য উপাদান যা উদ্ভিদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করে তা প্রবেশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কৃষি জমিতে পলিথিন পড়লে যেমন জমিতে ফসল উৎপাদন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে তেমনি পলিথিন থেকে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়া ত্বকে বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি করে। এছাড়া পলিথিনের মাধ্যমে ডায়রিয়া ও আমাশয় রোগ ছড়িয়ে মহামারি আকার ধারণ সময়ের ব্যাপার মাত্র।

যেসব ড্রেন, নালা, খাল বা ডোবা পলিথিন দ্বারা ভরাট হয়ে যায় ওই জমি যেমন অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করা যায় না; তেমনি পলিথিন পানির প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করায় ওই এলাকায় জলাবদ্ধতাসহ নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। তবে পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে প্রচলিত আইন ওই সময়ে কার্যকর কোনও ভূমিকা রাখতে পারেনি। ফলে তৎকালীন সরকার পরিবেশবিদ ও সুধী সমাজের চাপের মুখে বাংলাদেশ পরিবেশ আইন ১৯৯৫-কে সংশোধন করে একটি নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

নানা নাটক-পাল্টা নাটকের পরে ২০০২ সালে ওই আইন প্রণীত হয়। তবে নতুন আইন প্রণয়নের পর যুগ পার হলেও পলিথিন উৎপাদন, বাজারজাত ও ব্যবহার এখন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। যদিও উক্ত আইনের ৬-এর (ক) নং ধারায় সব প্রকার পলিথিন বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রোপাইলিন দ্বারা তৈরি সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, মজুত ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমানে ওই আইন কার্যত অবৈধ পলিথিন উৎপাদনকারী ও ব্যবহারকারীরা মানছে না। আর সরকারের কার্যকর নজরদারির অভাবে আইনের যথাযথ প্রয়োগও সম্ভব হচ্ছে না। গণমাধ্যমে প্রকাশ, বর্তমানে সারা দেশে প্রায় সাতশ’ কারখানায় পলিথিন উৎপাদন করা হচ্ছে। অনেকে পোশাক শিল্প, লবণ ও চিনিসহ ২৩ প্রকার প্যাকেজিং দ্রব্যের দোহাই দিয়ে অবাধে পলিথিন উৎপাদন করছে।

ব্যবহারকারীর সংখ্যাও কম নয়। এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের প্রতিটি পরিবারে প্রতিদিন চারটি করে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। সেই হিসেবে ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় এক কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। জরিপের এ বক্তব্য যে সত্য তা আমরা প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতে গেলেই দেখতে পাই। প্রতিদিন আমরা যেসব পণ্য ক্রয় করি তার প্রায় সবগুলোর ক্ষেত্রেই দোকানদাররা পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। অনেক ক্ষেত্রে ওই পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের পরিমাণ ৮-১০টি ছাড়িয়ে যায়।

পলিথিন নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বে যেসব কর্তাব্যক্তিরা রয়েছেন তারাও এ সমাজের বাইরে ভিন কোনও গ্রহে বসবাস করেন না। তাই তারাও যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়ে বাজারে যান; তখন পলিথিনের অবৈধ ব্যবহার তাদের নজরেও পড়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে হয়তো তারা কাকের মতো চোখ বুঝে আমায় কেউ দেখছে না ভাব ধরে আছেন বলেই আইনের তোয়াক্কা না করেই মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা এখনও অবৈধভাবে পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারের দুঃসাহস দেখাচ্ছে।

পলিথিন উৎপাদন,বিক্রয় ও ব্যবহার সম্পর্কিত আইনটির পাশাপাশি পলিথিনের পরিবর্তে পাটজাত ব্যাগ ব্যবহার করতে ২০১০ সালে পাটজাত ব্যাগ ব্যবহারের যে আইন করা হয়েছিল তাও প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এ আইনটি সময়োপযোগী হলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে অন্য অনেক আইনের মতো শেষ পর্যন্ত কাগুজে আইনের ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে। পাটজাত ব্যাগের দুষ্প্রাপ্যতা, অধিক দাম ও পণ্যের উপযুক্ত ব্যাগের অভাবই এর জন্য প্রধানত দায়ী।

এসব কারণে ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা পাটজাত ব্যাগের পরিবর্তে আবারও পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। যদিও সোনালি আঁশের দেশ হিসেবে একসময় বিশ্ব বাজারে পরিচিতি লাভকারী সোনার বাংলায় পাটজাত ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার করতে ক্রেতা-বিক্রেতাকে উৎসাহী করাটা কঠিন ছিল না।

সময়োপযোগী ও বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে খুব সহজেও পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটজাত ব্যাগকে এ দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় ব্যাগে পরিণত করা যেত। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় সরকারের এ উদ্যোগ শুধু আইন প্রণয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হওয়ার পথে।

যদি এখনও সময় শেষ হয়ে যায়নি। সরকার চাইলে এখনও পলিথিনের পরিবর্তে পাটজাত ব্যাগকে জনপ্রিয় করে তোলা সম্ভব। এক্ষেত্রে পাটজাত ব্যাগ উৎপাদনে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে পাঠ উৎপাদনে কৃষককে বিনামূল্যে সার প্রদান,পাট পচনের ক্ষেত্রে সহায়তা ও পাটের যথাযথ মূল্য প্রদান করার পাশাপাশি পাটজাত ব্যাগ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কারখানাগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

পাটজাত ব্যাগ উৎপাদনের পর তা বিপণনের ক্ষেত্রেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানে শতভাগ পাটজাত ব্যাগ ব্যবহার করার পাশাপাশি সরকারি তত্ত্বাবধানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পাটজাত ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা সময়ের দাবি।

মনে রাখতে হবে,পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের আইন কার্যকর করতে গেলে প্রথমে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটজাত ব্যাগকে মানুষের জন্য সহজলভ্য করা দরকার। ব্যবসায়ীদের চাহিদা মতো সরবরাহের নিশ্চয়তা চাই। অন্যথায় পলিথিন ব্যবহার বন্ধের আইন প্রয়োগ করে অথবা পলিথিন ব্যাগ বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ৬ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করেই কেবল পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন,বিক্রি ও ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না।

প্রকৃতপক্ষে পরিবেশ ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করতে আইনের কার্যকর প্রয়োগ, প্রয়োজনে সংশোধনের পাশাপাশি বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটজাত ব্যাগকে জনপ্রিয় করার মাধ্যমেই কেবল এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। তাই এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদফতরকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পাশাপাশি ব্যবসায়ী ও জনসাধারণকে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের ক্ষতির বিষয় সম্পর্কে সচেতন করার উদ্যোগ নিতে আমরা অনুরোধ করছি। সরকার, ব্যবসায়ী ও জনগণের আন্তরিক প্রচেষ্টাই কেবল পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক : মো.আবুসালেহ সেকেন্দারসহকারী অধ্যাপক,ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Share