Home / ফিচার / দেনমোহরের ঊর্ধ্ব চাপে কিছু লোভী পুরুষের নাভিশ্বাস
Hai rommo

দেনমোহরের ঊর্ধ্ব চাপে কিছু লোভী পুরুষের নাভিশ্বাস

শনিবারের শনির দশা উপ-শিরোনামে ‘দেনমোহরের ঊর্ধ্ব চাপে নাভিশ্বাস কিছু লোভী পুরুষের’ নামে একটি রচনা লিখেছেন উপ-সচিব মোহাম্মদ আবদুল হাই। এ পর্বে বিষয় হলো দাম্পত্য জীবন ও দেনমোহর প্রসঙ্গ। চাঁদপুর টাইমস পাঠকদের জন্যে তা তুলে ধরা হলো।

বেহেস্তে নাকি আদমের একা একা ভালো লাগছিল না। মন সর্বক্ষণ উসখুস করছিল। এতো আলিশান বেহেস্ত । নানা রকম সুমিষ্ট ফলে ভরপুর। যতো ইচ্ছা আদম খেতে পারে। তারপরও কোথায় যেন কিসের অভাব। শরম ও লাজে সাহস করে আল্লাহকে বলতে পারে না ।

কিন্তু আল্লাহ জানেন আদমের কি সমস্যা । জিজ্ঞেস করলে আদম জানায়, একা একা ভালো লাগে না, একটা কিছু করেন । আল্লাহ হাওয়াকে দেখালেন। হাওয়া দেখেই আদম খুশিতে গদগদ করে উঠলেন। দৌড়ে গিয়ে ধরতে চাইলেন।

আল্লাহ্ বল্লেন, না এতো সহজ না । আদম বলে , আর পারছিনা, ওকে আমার চাই চাই, যে কোন শর্ত মানতে রাজি। আল্লাহ্ বললেন, দেনমোহর দিতে হবে। আদম বল বললো, আপনার দয়ায় বেঁচে আছি, খাই দাই, ঘুমায়। দেনমোহর কোথায় পাবো ?

আল্লাহ্ বললেন, আকাশের দিকে তাকাও। আদম তাকালেন । আদেশ হলো , পড়ো । আদম পড়লেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ “। ব্যস, এ দেনমোহর পরিশোধ হয়ে গেল। অতঃপর আদম হাওয়াকে নিয়ে মহাসুখে বাস করতে লাগলো।

তখন হতে আদমের বংশধর নারী-পুরুষ দেনমোহর পরিশোধ করে পৃথিবীতে জোড়ায়-জোড়ায় স্বামীস্ত্রী হিসেবে বসবাস করতে লাগলো। আরব দেশে খেজুর, দুম্বা, বকরি বা উট ছিলো দেনমোহর । বিয়ের সময় নারীকে সম্মান দেখিয়ে সম্মানজনক দেনমোহর দেয়ার বিধান ছিলো। আর প্রেম প্রীতি ভালোবাসাই ছিলো মুখ্য। নানী দাদিরা দেনমোহর কখনো আদায় করেননি।

কিন্তু বিবাহের পর বাসর রাতে মহামান্য সম্রাজ্ঞী(স্ত্রী) কে স্পর্শ করার আগেই নাকি এটি পরিশোধ করা লাগে। নানীকে দেনমোহরের কাহিনী জিজ্ঞেস করে জানা গেল, বাসর রাতে নানা ১হাজার টাকা দেনমোহর ছিলো, তা পরিশোধের অক্ষমতা জানালে নানী মুচকি হেসে মাফ করে দেন।

অতঃপর নানা যে উপহার তাঁকে দেন, তার মূল্য নাকি কোটি টাকারও বেশি। কি সে উপহার জিজ্ঞেস করলে নানী বললো, নাতবৌ নিয়ে বাসরঘরে গেলে নিজেই টের পাবে।

নিজে টের পেলাম কিনা জানি না, তবে বর্তমানে কিছু লোভাতুর পুং জাতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে । এখন চলছে দেনমোহর ফ্যাশন মহা সগৌরবে । প্রেম করে বিয়ে, ইয়ে করে বিয়ে, পারিবারিক পছন্দে বিয়ে কিংবা ঘটক আঁখি ভাইয়ের কল্যাণে বিয়ে হোক না কেন, দেনমোহর সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ এক টাকা হতে পঞ্চাশ লাখ এক টাকা।

এ ক্ষেত্রে মজার বিষয় হলো দরদাম করে কয়েক লাখ কমানো গেলেও এক টাকা কমে না। তাইতো দেখা যায় পাঁচ লাখ এক টাকা, দশ লাখ এক টাকা, পঞ্চাশ লাখ এক টাকা। অথচ এক টাকা ভিক্ষে দিলে ভিক্ষুকও রাগ করে বলে, টাকা না থাকলে ভিক্ষার থালা হতে দশ টাকা নিয়ে যান , তারপরও এক টাকা ভিক্ষে দিয়ে অপমান করবেন না। বুঝা গেল ভিক্ষুকেরও প্রেস্ট্রিজ (সম্মান) আছে !

বর্তমানে দেনমোহর ফ্যাশন, ইজ্জত সম্মান , গৌরব ও অহঙ্কারের প্রতীক, যেখানে ভালোবাসা নস্যি মাত্র। ভালোবাসা পরে- আগে দেনমোহর কিংবা ভালোবাসো কিনা: প্রমাণ কতো দেনমোহর ঘোষণা দিবে তার ওপর নির্ভর করে। মেয়ের মা বান্ধবীকে মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিলে জিজ্ঞেস করে দেনমোহর কত দিচ্ছে? পাঁচ থেকে দশ লাখ বললে বান্ধবী শোনায়, এতো কম !

আমার ভাগ্নি পেয়ারারতো গত মাসে বিয়ে হলো, দেনমোহর বিশ লাখ এক টাকা ছিল । বুঝিয়ে দেয়, পাত্র গরীব, মেয়ে পক্ষ ঠেকায় পড়ে এতো কমে রাজি । দেনমোহরের বর্তমানে সবচেয়ে বড় মার্কেট হচ্ছে ডাক্তার, লন্ডন ও আমেরিকা প্রবাসী সমাজ।

এ সমাজে দেনমোহরের কম্পিটিশন চলছে এবং দিন দিন এ কম্পিটিশন তীব্র আকার ধারণ করছে। এ সমাজে মোটামুটি বিশ লাখ এক টাকার নীচে দেনমোহরের সন্ধান মেলা ভার। এখানে পাত্র পছন্দসই হলে আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ইতোপূর্বে সর্বোচ্চ দেনমোহর কত ছিল তা জেনে নেয়া হয়। এরপর সর্বোচ্চ মুলামুলি/দরকষাকষি করে অবশ্য অবশ্যই পূর্ববতী রেকর্ড ভেঙে দেয়া হয়। মহা আত্মতুষ্টিতে ঢেঁকুর তোলে নিজের কন্যা পেয়ারা সবচেয়ে ভাগ্যবতি বলে সবার চেয়ে বেশি দেনমোহরে বিয়ে দেয়া গেলো।

মজার বিষয় হলো, ধরে নেয়া হয় যে দেনমোহর পরিশোধ করা লাগে না। কেবল কাবিন নামায় লিখলেই হলো। বিয়ের সময় পাত্রী পক্ষ তাই বুঝাতে চায়। এ ছাড়াও পাত্রী পক্ষ বিয়ের সুরক্ষা(বিয়ে যাতে ভবিষ্যতে না ভাঙ্গে) হিসেবে বেশি দেনমোহর ধরা হয়। অর্থাৎ পাত্রের উপর আস্থা কম !

গত মাসে আমার ছোট ভাই বিদেশ হতে আসে। দেখতে সুন্দর ও বড়ভাই ম্যাজিস্ট্রেট বলে তার জন্য মোটামুটি যোগ্যতা অনুসারে ভালো পাত্রী পাওয়া গেলো। সব ঠিকঠাক। কেবল আমার (লেখক) সম্মতি চাইলে প্রথম জিজ্ঞাসা ছিলো, দেনমোহর কত ? ছয় লাখ হতে দশ লাখ এক টাকা। যেখানে দেখে সেখানে এ অবস্থা । আমি রাজি না। দেনমোহর কমাতে হবে। উত্তরে জানায়, ভিক্ষুকের মেয়ে হলেও ‘পাঁচ লাখ এক টাকার’ নীছে কেউ মেয়ে দিতে রাজি নয়। জানিয়ে দিলাম, আমিও রাজি না। পরে একটা পরিবার পাওয়া গেল যারা বললো, যা দিলে ছেলে পক্ষ খুশি তাতেই রাজি। আমিও রাজি । বিয়ে হয়ে গেলো।

পাত্রী দেখে মাথা ঠিক রাখতে না পেরে যাঁরা সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে বেশি দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করে, তারা অনেক সময় ধরা খায় । কঠিন ধরা: না পারে কইতে, না পারে, সইতে, না পারে ছাড়তে।

কারণ সংসারে শান্তি নাই, শান্তি মারা গেছে-শান্তির বাপও মারা গেছে। এখন কেবল নৈশভোজের পরে নিশি যন্ত্রণা চলেছে, নীচের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা গভীর রাতে ওপর ফ্ল্যাটে প্রায় ভূমিকম্পের আলামত দেখে আর মনে মনে হাসে এ ভেবে যে, আদম ও হাওয়া বেহেস্তের ফল গাছে ঝাঁকা দিয়ে খাচ্ছে বোধ হয় ।

পত্রিকা ও সোশাল মিডিয়ার ভাষ্যমতে, এক গ্রামে বেসরকারি ভার্সিটির এক শিক্ষক ঘরে স্ত্রী-সন্তান থাকা সত্ত্বেও সুন্দরী ছাত্রীর সাথে ভালোবেসে ফুসকা খেলেন কিছুদিন ।

স্বাদের গভীরতা তীব্র আঁকার ধারণ করলে ছাত্রী জানায় ফ্রি ফুসকা খাওয়া চলবে না। বাধ্য হয়ে ফুসকার লোভে পঁয়ত্রিশ লাখ এক টাকায় গোপনে শাদি মোবারক করলেন। ঘরোয়া পরিবেশে ফ্ল্যাটে রেখে ফুসকা খাওয়া অব্যাহত রাখলে ছাত্রী থুক্ক; ২ নং বউ থক্কু; মান্যবর দ্বিতীয় স্ত্রী জানান আনুষ্ঠানিক ঘরে তুলো, নতুবা আগের বউকে জানাবে, কোর্টে নারী নির্যাতন মামলা এবং ফেসবুকে স্ক্রিনশর্ট পোস্ট হবে। বেচারা এক চেকে পঁয়ত্রিশ লাখ ১ টাকা নগদ পরিশোধ করে ফ্রি ফুসকা খাবার স্বাদ জন্মের তরে মিটিয়ে নেন।

জীবনে একবার দেনমোহর জনিত এক ঘটনার সামাল দেয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করবো এখন।

বিদেশ ফেরত রহিম বিয়ে করবেন। অনেক পাত্রী দেখলেন । পছন্দ হয় না। কারণ রহিম পাত্রী দেখতে গিয়ে মনে মনে ঐশ্বরিয়া, ক্যাটরিনা, মাধুরী কিংবা টাইটানিকের নায়িকা কেঁট কে খোঁজ করে । হাত মিলে তো পা মিলে না, পা মিলে তো মুখ মিলে না, আঁখিয়া মিলেতো টাকিয়া (চুল) মিলে না। আত্নীয় স্বজন ফেল, কয়েক ডজন ঘটক আঁখি ভাইও ফেল ! অবশেষে ঘটক ফাঁকি ভাই দায়িত্ব নিলেন। আই এ পাস উশ্রী কাজলকে দেখালেন। পাত্রী দেখে তো পাত্র, পাত্রের মা, বাবা, ভাইবোন চৌদ্দগৌষ্ঠি রাজি। কোনমতেই এ পাত্রী হাতছাড়া করতে রাজি নয়, পাত্রতো পারলে ওই দিনই বিয়ে করে সোজা হানিমুনে চলে যায়!

পাত্রীর সাথে পাত্রের ম্যাচিং, বয়স, পছন্দ অপছন্দ দেখা হয় না। সুযোগ বুঝে পাত্রীর লোভী পিতাও রাজি হয়ে গেলেন। দশ লাখ ১ টাকা দেনমোহরে মহা ধুমধামে বিয়ে হয়ে গেলো।

ঢাকঢোল পিটিয়ে বেশ কিছুদিন নায়িকা মানে নতুন বউ প্রদর্শন চললো। যে দেখে সে তাজ্জব, ইয়াং ছেলেরা তো মনে মনে হিংসা করে।পড়াশোনা করে কি লাভ, বিদেশে চাকরি করলেতো ভালো হতো। এ রকম সুন্দরী কি করে কম শিক্ষিত রহিম মাস্তিমাত করে দিলো।

তার পরের ঘটনা প্রায় ছয় মাস পরে। রহিম বিদেশ চলে যায়, স্বর্ণ ,গহনাপাতি সব বউয়ের কাছে। ব্যাংকে বউয়ের নামে একাউন্টও খোলা হয় । সব টাকা পয়সা ওই একাউন্টে পাঠায়। ইমোতে কথা হয়, দেখা হয়, চলে ভালোবাসার অভিনয় ।

তারপর মোটামুটি সব হাতিয়ে অশিক্ষিত শাশুড়ির সাথে আর থাকতে পারবে না বলে আরো পড়াশোনার জন্য বউ শহরে চলে যায় । নতুন বাসা নেয়। স্বামী খুশিতে গদগদ। প্রতিমাসে স্ত্রীর একাউন্টে টাকা পাঠায়। অশিক্ষিত মা শিক্ষিত পুত্র বধুর মর্ম বুঝে না । তাই বউ যা চায় তাই হবে। মা ও খুশিতে সব মেনে নেয়।

এরপর হঠাৎ বিনামেঘে বজ্রপাত! যৌতুক চাওয়ার অপরাধে স্বামী, স্বামীর বাবা, মা, ভাই-বোনের বিরুদ্ধে মামলা । পাশাপাশি কোর্টের মাধ্যমে তালাকনামা পাঠিয়ে দেনমোহরের দশ লাখ এক টাকা ও আরো ছয় মাসের ভরণপোষণের টাকা দাবি ! এক টাকাও কম হবে না। গ্রাম্য শুশুর শাশুড়ি মামলার ভয়ে পলাতক । আমার (ম্যাজিস্ট্রেট লেখকের) দ্বারস্থ হলেন নিস্তার পেতে ।

ঘটনা শুনলাম, ঘটনার গভীরে প্রবেশ করলাম। ডাল মে কুচ কালা হ্যায় – আবিষ্কার করলাম। কয়েকদিন জেল খাটতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করলাম। প্রত্যুত্তরে জানালো, মাফ চায়-দোয়াও চায়, যে করে হোক মুক্তি চায়! পাত্রীর ভাই আমার বন্ধু । আলাপ করে ছয় লাখ এক টাকা নগদ পরিশোধ করে পাত্র পক্ষকে অব্যাহতি দেয়া হলো।

চার লাখ টাকা কম নিলেও ঐতিহ্য রক্ষার্থে ১ টাকা কম নেয়নি ! এক টাকার মাহাত্ম্য কি জানি না । তবে অনুমান করছি শের শাহের আমলে এক টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেতো তার স্মরণে জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ !

আর হ্যাঁ, নায়িকা কাজল খালাতো ভাইয়ের সাথে ছাত্র জীবন হতে কুচ কুচ হোতা হ্যায় ছিলো। তা ধরে রাখতে স্বামী ধন হতে মোটামুটি সবমিলিয়ে ২৫ লাখ এক টাকা খসিয়ে পগারপার! তবে কাজলের দ্বিতীয় ইনিংস এ দেনমোহর কত ছিলো জানি না । কিন্তু লাখের সাথে ‘ টাকা যে ছিলো তা ১০১% নিশিত ! এখানেও ১ ! আসলে, ১ একাই একশো । তাহলে দেনমোহর কেবল এক টাকা হয়না কেন ?

উদ্দেশ্য : নরনারীর সংসার হোক ভালোবাসার, বিশ্বাস, আস্থার কল্যাণ ও স্বর্গীয় বন্ধনের । বিয়ের সময় ধার্যকৃত দেনমোহর স্ত্রীর জন্য সম্মানজনক হোক এবং বিয়ের আসরেই তা সসম্মানে পরিশোধের ব্যবস্থা করা হোক।

লেখক- প্রাক্তন এডিসি ও ডিডিএলজি, চাঁদপুর।
বর্তমানে ডেপুটি প্রজেক্ট ডাইরেক্টর(স্মার্ট কার্ড),
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, ঢাকা

: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১০:০৩ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার
ডিএইচ