Home / খেলাধুলা / ‘দুই দিন হলো চাকরি হইছে, বাহাদুরি দেখাস! ৫০০ টাকা বাজি লাগবি?
Ajharul Islam
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে শেষ জাতীয় অ্যাথলেটিকসে চাকতি নিক্ষেপের আগমুহূর্তে আজহারুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

‘দুই দিন হলো চাকরি হইছে, বাহাদুরি দেখাস! ৫০০ টাকা বাজি লাগবি?

‘দুই দিন হলো চাকরি হইছে, বাহাদুরি দেখাস! ৫০০ টাকা বাজি লাগবি?’ সিনিয়র অ্যাথলেটের এ কথায় ভীষণ জিদ উঠল টগবগে তরুণের। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্টে ১৯৯৩ সালের এক সকালের কথা।

সেই টগবগে আজহারুল ইসলাম এখন দাঁড়িয়ে জীবনের গোধূলিলগ্নে। কিন্তু দুই যুগ আগের সেই ৫০০ টাকার বাজিতেই লেখা হয়েছে তাঁর বাকি জীবনের গল্প; যার পাতায় পাতায় রোমাঞ্চ!
১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন আজহারুল, ছিলেন বক্সার। অনুশীলন শেষে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দেখলেন, মাঠে সিনিয়র এক অ্যাথলেট লৌহ গোলক (শটপুট) নিক্ষেপ করছেন। মানুষটি দেখতে শারীরিকভাবে শক্তিশালী হলেও সে তুলনায় গোলকটি বেশি দূর এগোচ্ছে না। আজহারুল ভাবলেন, ‘এত বড় শরীর নিয়ে তামাশা দেখায় নাকি!’
বুকে খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে আজহারুল তাঁর কাছে গিয়ে টিপ্পনী কাটলেন, ‘আমি তো বাঁ হাত দিয়ে মারলেও আপনার চেয়ে বেশি দূরে নিতে পারব।’ আর যায় কোথায়! কদিন হলো চাকরিতে ঢোকা কোনো তরুণের মুখে এমন কথা শুনলে সিনিয়র অ্যাথলেটের ভালো লাগে? চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ধরলেন ৫০০ টাকা বাজি। আজহারুলও তাতে রাজি।
তবে বাজিটা বাঁ হাতের নয়, ছিল ডান হাতের। সিনিয়র অ্যাথলেটের চেয়ে দুই হাত দূরে গোলক পাঠিয়ে আজহারুল জিতেছিলেন সেই বাজি। এরপর আচমকাই পাল্টে গেল তাঁর জীবনের গল্প। অফিসের আদেশে বক্সিং ছেড়ে আজহারুল নেমে পড়লেন গোলক নিক্ষেপে। তারপর আর থামাথামি নেই। এই ৪৭ বছর বয়সেও আজহারুলের গোলক নিক্ষেপ চলছে!
তিনি এগিয়ে চলেছেন একের পর এক রেকর্ড ভেঙে। গত ডিসেম্বরে সর্বশেষ জাতীয় অ্যাথলেটিকসের ডিসকাস থ্রোয়ে (চাকতি নিক্ষেপ) গড়েছেন রেকর্ড। ২০০৬ সালে নিজেরই গড়া রেকর্ড ৪৪.৬ মিটার ডিঙিয়ে এবার গড়েছেন ৪৪.৩৭ মিটারের মাইলফলক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে ২০১০ সালের এসএ গেমসে ৪৪ দশমিক ৯৮ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে ব্রোঞ্জ জয়ই তাঁর সেরা পারফরম্যান্স।
সোনালি সময়টা পেছনে ফেলে এলেও আজহারুল গোলক তুলে রাখেননি। অথচ ৪৭ বছরে পা রাখার আগেই অনেকে খেলা ছেড়ে অখণ্ড অবসরে ছেলেমেয়েদের শোনান ফেলে আসা সময়ের গল্প। তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন আজহারুল। কিন্তু তাঁকে দেখলে ঠিক প্রথাগত বাঙালি শ্বশুর বলে মনে হবে না! এখনো কী সুঠাম দেহ, শরীরটা মেদহীন ঝরঝরে। এখনো প্রতিনিয়ত ঘাম ঝরান বলেই চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরও মরিচা ধরেনি তাঁর পারফরম্যান্সে। আজহারুলের বসে থাকার তাই সময় নেই। চুক্তির ভিত্তিতে ট্র্যাকে নামছেন নৌবাহিনীর জার্সিতে।
বক্সিং গ্লাভস ফেলে আজহারুল অ্যাথলেটিকসের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে এসেছিলেন গোলক নিক্ষেপের এক বাজি জিতে, যে গল্পটা শুনলেন শুরুতেই। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি সাফল্যের মুখ দেখেছেন ‘ডিসকাস থ্রো’য়ে (চাকতি নিক্ষেপ)। ১৯৯৬ বাংলাদেশ গেমসে অভিষেকে এ ইভেন্টে জিতেছিলেন ব্রোঞ্জ। পরে ১৯৯৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ইভেন্টে জিতেছেন টানা স্বর্ণ! ২০১২ সালে কঙ্গোয় জাতিসংঘ মিশনে থাকায় খেলা হয়নি। সেভাবে অনুশীলনও করতে পারেননি। পরের বছর তাই দেখা পান ব্রোঞ্জ পদকের। ২০১৪ আসরে ফের তুলে নেন স্বর্ণপদক। এরপর এক বছরের বিরতি দিয়ে টানা দুই স্বর্ণ জিতেছেন সর্বশেষ দুটি আসরেই।

কিন্তু গোলক নিক্ষেপ ভুলে গেলে চলবে না। ২০০৫ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত (জাতীয় অ্যাথলেটিকস) আজহারুল এই ইভেন্টে জিতেছেন টানা ছয় স্বর্ণ। সাফল্যের খেরোখাতাই বলছে আজহারুল বিরল ক্রীড়াবিদদের একজন, সামান্য একটি বাজি জয়ের আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে যিনি পরে জীবনের গল্পটাই পাল্টে দিয়েছেন।

স্মৃতির পৃষ্ঠা উল্টে প্রায় ২৫ বছর আগের সেই বাজির কথা মনে পড়ল আজহারুলের, ‘ওই বাজিটা আমাকে আজকের আজহারুল বানিয়েছে। মাদ্রাসার ছাত্র ছিলাম। অ্যাথলেটিকস সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু সেদিন চোখের আন্দাজে মনে হয়েছিল, আমি সেই বড় ভাইকে হারাতে পারব। তাই সাহস করে বাজি ধরা। অথচ তখন আমার বেতনই ছিল ৫৫০ টাকা! হেরে গেলে টাকাটা আমি কখনোই দিতাম না। জিতেও নেওয়া হয়নি।’

আজহারুল নিশ্চয়ই এখন মনে মনে সেই সিনিয়র অ্যাথলেটকে ধন্যবাদ দেন। সেদিন তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন বলেই তো তিনি গোলক ও চাকতি নিক্ষেপে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল অ্যাথলেট। কিন্তু একদিন তো থামতে হবে। কালে কালে বয়স তো আর কম হলো না! অবসর নিয়ে মানুষের প্রশ্ন আজহারুল এড়িয়ে চলছেন। প্রতিদিন নিজেকে তৈরি করছেন আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার। হৃদয়ে লালন করা স্বপ্নটা যে তাঁর ছুঁতে হবে, ‘নিজের সবকিছু নিংড়ে সামনের সাফ গেমসে লড়তে চাই। বাংলাদেশকে দিতে চাই একটি স্বর্ণ।’

কিন্তু স্বপ্ন দেখলেই তো হবে না। আজহারুলের সামনে যে কঠিন বাস্তবতা। ক্রিকেটের বাইরে বাকি ক্রীড়াবিদরা বাংলাদেশে যেন ‘ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো!’ খেলাটার প্রতি তিনি যতটা নিবেদিত, তিনি পেয়েছেন কতটা? বিষণ্ন হাসিতে আজহারুল বলেন, ‘শুধু জন্মদিনটা’। বাংলাদেশের ‘বিজয়’ আর তাঁর জন্ম যে একই দিনে—১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। (প্রথম আলো)
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০১:০৩ পিএম, ১০ জানুয়ারি ২০১৮, বুধবার
ডিএইচ