Home / খেলাধুলা / জনাথন ও জেসিকাকে টানে বাংলাদেশ
জনাথন ও জেসিকাকে টানে বাংলাদেশ

জনাথন ও জেসিকাকে টানে বাংলাদেশ

জনাথন–জেসিকার বাবা বাংলাদেশি; মা সুইডিশ। দুই ভাইবোন সুইডেনের টেনিসে নিজেদের অবস্থান করে নিয়েছেন। টেনিস ওঁদের স্বপ্ন, টেনিসকেই ওঁরা করতে চান পেশা। খেলার স্বপ্ন দেখেন বাবার দেশ বাংলাদেশের হয়েও। দুই ভাইবোনের এগিয়ে চলার কথাই রইল এখানে।
জনাথন মৃধা ও জেসিকা মৃধা। দুই ভাইবোন। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের বাসিন্দা। পশ্চিমা বিশ্বে মৃধা পদবি নেই। ওখানে তাহলে কোন সূত্রে মৃধা গোত্রের আবির্ভাব?

মৃধা পদবিটাই শেকড় চিনিয়ে দেয়। তবে তাঁদের শরীরে যেমন বাংলাদেশি ডিএনএ আছে, আছে সুইডিশ রক্তও। জনাথন-জেসিকার বাবা মাহবুবুর রহমান মৃধা বাংলাদেশের সন্তান। ওঁদের মা মারিয়া সুইডিশ। একেবারে নির্ভেজাল সুইডিশ নন, স্প্যানিশ বাবা আর সুইডিশ মায়ের সন্তান। প্রবাসী বাংলাদেশি সমাজে এমন অজস্র কাহিনি খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রবাস জীবনে বিদেশিনী বিয়ে করে সেখানেই থিতু হয়েছেন কোনো বাংলাদেশি যুবক। সন্তানসন্ততি হয়েছে। সন্তানেরা পুরোপুরি বিদেশি চেহারা পেলেও কোথায় যেন বাংলাদেশের ছাপ থেকে যায়। শরীরে না হলেও মানসিকতায় কিংবা আচরণে। জনাথন আর জেসিকার চেহারায় মিলে-মিশে আছে বাংলাদেশ-সুইডেন। প্রায় সমান সমান।

তাহলে বাবা ও মায়ের দেশের প্রতি টানটাও সমান ভাগ হওয়ার কথা! রহমান মৃধা (সুইডেনে মাহবুবুর নামটা আছে শুধু সনদে) বলছেন, তাঁর সন্তানদের মধ্যে কেন যেন বাবার দেশের প্রতিই বেশি টান। টেনিস বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী দেশের একটি সুইডেন আবার ওঁদের টেনেছে টেনিসে। লারসন-ব্রোলিনের ফুটবল নয়, ওঁরা বেছে নিয়েছেন বোর্গ-এডবার্গের টেনিস। টেনিস শিখছেন স্টকহোমের গুড টু গ্রেট টেনিস একাডেমিতে। যে একাডেমির প্রধান কোচ স্বনামখ্যাত ম্যাগনাস নরমান। অ্যাসোসিয়েশন অব টেনিস প্রফেশনালস (এটিপি) নির্বাচিত ২০১৬ সালের বর্ষসেরা কোচ তিনি। অল্পবিস্তর টেনিসও খেলেছেন তিনি। সুইডেনের হয়ে ডেভিস কাপ জিতেছেন ১৯৯৮ সালে। ২০০০ ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনাল খেলেছেন। টমাস ইয়োহানসন, রবিন সোদারলিং, স্তান ভাভরিঙ্কাদের মতো ছাত্র পেয়েছেন তিনি। ভাভরিঙ্কা তিনটি গ্র্যান্ড স্লাম (অস্ট্রেলিয়ান, ফ্রেঞ্চ ও ইউএস ওপেন) জিতেছেন তাঁকে পাশে নিয়েই।

এখন নরমানের সবচেয়ে বিখ্যাত ছাত্র জনাথন, সেরা দু-তিনজন ছাত্রীর একজন জেসিকা। ২২ বছরের জনাথন এরই মধ্যে পেশাদার টেনিসে নাম লিখিয়েছেন। ষোড়শী জেসিকা এখনো শৌখিন খেলোয়াড়, পা ফেলতে চলেছেন পেশাদার জগতে। টেনিস ওঁদের স্বপ্ন, টেনিসকেই ওঁরা করতে চান পেশা। কোনো একদিন খেলতে চান বাবার দেশ বাংলাদেশের হয়ে।

বাবা রহমান মৃধা নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ছেলে-মেয়ের ওপর চাপিয়ে দেননি। ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে সেটি হয়ও না। কিন্তু রহমান নিজে বিস্মিত হন যখন ছেলে-মেয়ের মুখে শোনেন বাংলাদেশের নাম। তখনই যেন পাখির ডানায় ভর করে তাঁর মনটা উড়ে চলে আসে বাংলাদেশে। চোখে ভাসে মাগুরা জেলার সবুজ-শ্যামল নহাটা, তাঁর জন্মগ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নবগঙ্গা নদী, নদীর ওপারে গঙ্গারামপুর প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বিদ্যালয়ের সোনালি অতীত মনের মধ্যে প্রজাপতির মতো ওড়াউড়ি করে। দেশের জন্য, নিজের জন্মভূমির জন্য কিছু করতে সাধ জাগে। সেটি তিনি করেনও। এলাকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের অর্থসাহায্য করেন। বাবার চরিত্রের এই ভালো দিকটি সংক্রমিত হয়েছে জনাথন-জেসিকার মধ্যেও। সরকারি মাসিক ভাতার পুরো ১০ হাজার টাকাই ওঁরা তুলে দেন বাবার হাতে। সেই টাকা নহাটা-গঙ্গারামপুরের অনেক অভাবী ছাত্রছাত্রীর লেখাপড়ার কাজে লাগে।

তবে বাবার দেশকে আরও একটু বেশিই সাহায্য করতে চান জনাথন-জেসিকা। কোনো একদিন আন্তর্জাতিক টেনিস খেলতে চান বাংলাদেশের হয়ে। সেটি হতে পারে ডেভিস কাপ, হতে পারে কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়ান গেমস বা অলিম্পিক।

রহমান মৃধার বিশ্বাস, তাঁর ছেলে-মেয়েরা টেনিসের শীর্ষ পর্যায়ে খেলবেই। স্কুলের শিক্ষাজীবন শেষ করে জনাথন পেশাদার জগতে পা রেখেছেন, তাঁর এটিপি র‍্যাঙ্কিং ৫২৮। র‍্যাঙ্কিং তিন শর নিচে থাকলে গ্র্যান্ড স্লামের বাছাই পর্বে খেলার সুযোগ পাওয়া যায়। এ বছরের মধ্যেই কাঙ্ক্ষিত ওই র‍্যাঙ্কিংয়ে পৌঁছে আগামী অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের বাছাইতে খেলতে চান জনাথন। অবশ্য এটিপি টুর্নামেন্টে খেলে নিজের সামর্থ্যও জানান দিতে পেরেছেন। স্টকহোম ওপেনের বাছাইতে একবার পৌঁছেছিলেন সেমিফাইনালে, কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিলেন সুইডিশ ওপেনের। জেসিকার আইটিএফ র‍্যাঙ্কিং ১৪২০, পড়ছেন দশম গ্রেডে। স্কুল শেষ করে পেশাদার টেনিসে ঢোকার সংকল্প তাঁরও।

রহমান মৃধা নিজের জীবনের ছবিই যেন দেখতে পান সন্তানদের মধ্যে। তাঁর মতোই সাফল্যের জন্য উন্মুখ জনাথন-জেসিকা। যতক্ষণ না পর্যন্ত লক্ষ্যে পৌঁছানো হচ্ছে ভেতরে-ভেতরে ওঁরা যেন জ্বলতে থাকেন। ঠিক এমন সাফল্য-তৃষ্ণায় নহাটা থেকে একদিন ঢাকায় এসে ভর্তি হয়েছিলেন রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ১৪তম আইএসএসবি পেরিয়ে জিডি পাইলটও হয়েছিলেন। কিন্তু দেশে থাকেননি। তাঁকে টেনেছিল বিদেশ। মন যেন কার কথা শুনছিল—বিদেশেই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। ১৯৮৪ সালে সুইডেনে গিয়ে ফার্মেসিতে পড়েন, করেন এমবিএ, চাকরি পান বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি ফার্মাসিয়ায়। কোম্পানির উৎপাদন ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক হন।

রহমান মৃধা বলে যান, জনাথনের মধ্যেও আছে এমন তৃষ্ণা। নয় বছর বয়স পর্যন্ত সে ফুটবল খেলত, সমবয়সীরা পেরে উঠত না। পরে টেনিসে গিয়েও হারিয়ে দিত বড়দের। ১০ বছর বয়সে সে ছিল স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের সেরা। শেষ পর্যন্ত সে টেনিসকেই বেছে নিল চ্যালেঞ্জ হিসেবে।

জেসিকার গল্পটাও ভাইয়ের মতো। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত করত ফিগার স্কেটিং। সমবয়সীরা পারত না। পরে মায়ের অনুমতি নিয়ে হাতে নিল টেনিস র‍্যাকেট। কোচ টেনিস প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে এগিয়ে এলেন সাহায্য করতে। জনাথন এগোচ্ছে রজার ফেদেরারকে আদর্শ মেনে। জেসিকার আদর্শ সেরেনা উইলিয়ামস।

প্রতিভা চিনতে পেরেছেন প্রশিক্ষকেরা। ছেলে-মেয়ের সংকল্প ও আকাঙ্ক্ষাকে মূল্য দিয়ে রহমান-মারিয়া ওঁদের খেলার পেছনে খরচ করে চলেছেন। খরচ কম নয়, দুজনের জন্য বছরে ব্যয় ১০ লাখ ক্রোনা অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় এক কোটি টাকা। এ দেশ-সে দেশ ঘুরে খেলে বেড়াতে হয়। কদিন আগেই যেমন তাঁরা ঘুরে এলেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া। প্রতি সপ্তাহে দুজনের পেছনে ব্যয় ২৫-৩০ হাজার ক্রোনা। রহমান-মারিয়ার বিশ্বাস, জনাথন ও জেসিকা স্বপ্ন পূরণ করবেনই। সেই আশাতেই এখন দিন গোনা।

জিমন্যাস্ট মার্গারিতা মামুন বাংলাদেশের হয়ে খেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ দেশ প্রত্যাশামতো অবকাঠামো বা প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে পারেনি বলে ফিরে যান রাশিয়ায়। পরে ২০১৬ রিও ডি জেনিরো অলিম্পিকের রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে রাশিয়াকে সোনা জিতিয়ে স্মরণ করেছেন বাবার জন্মভূমি বাংলাদেশকে। আর এই দেশ দীর্ঘশ্বাসে উদ্‌যাপন করেছে মার্গারিতার সাফল্য।

এদিকে সুইডেনের উন্নত অবকাঠামো-পরিকাঠামোয় বেড়ে ওঠা জনাথন-জেসিকা কিনা আসতে চান বাবার দেশ বাংলাদেশে। বাংলাদেশকে তাঁরা কিছু দিতে চান টেনিস থেকে।

বাবার দেশকে আরও একটু বেশিই সাহায্য করতে চান জনাথন-জেসিকা। কোনো একদিন আন্তর্জাতিক টেনিস খেলতে চান বাংলাদেশের হয়ে। সেটি হতে পারে ডেভিস কাপ, হতে পারে কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়ান গেমস বা অলিম্পিক।

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১২: ০০ পি .এম ২৫মার্চ,২০১৮রোববার
এ.এস