Home / উপজেলা সংবাদ / একমাত্র সন্তানকে রেখে করোনাযুদ্ধে ডা. রুবেল-পলিন দম্পতি
চিকিৎসক দম্পতি
চিকিৎসক দম্পতি ডা. সুজাউদ্দোলা রুবেল ও সাজেদা বেগম পলিন।

একমাত্র সন্তানকে রেখে করোনাযুদ্ধে ডা. রুবেল-পলিন দম্পতি

একমাত্র সন্তানকে দূরে ঠেলে করোনাযুদ্ধে চিকিৎসক দম্পতি
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) এই কঠিন দুর্যোগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানবসেবায় ব্রত রয়েছেন চাঁদপুরের এক চিকিৎসক দম্পতি। তারা সবকিছু ভুলে নিজেদের মানুষের সেবায় নিয়োজিত রেখেছেন। দিনরাত নিরলসভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

এই চিকিৎসক দম্পতি হলেন- চাঁদপুরের আড়াইশ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ও করোনা বিষয়ক ফোকাল পার্সন ডা. এএইচএম সুজাউদ্দৌলা রুবেল এবং চাঁদপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজেদা বেগম পলিন।

করোনার এই কঠিন সময়ে সহকর্মীদের অনেকেই যখন আত্মরক্ষায় নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন তখন মানবসেবার ব্রত নিয়ে করোনা মোকাবেলায় আত্মনিয়োগ করেছেন এই চিকিৎসক দম্পতি। একমাত্র সন্তানকে দাদা-দাদির কাছে রেখে এই দম্পতি দিনরাতের অধিকাংশ সময় করোনা চিকিৎসায় ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে নিরলস পরিশ্রম ও সাধারণ মানুষের পাশে থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দেয়ার করণে ‘করোনা জেনারেল’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন চাঁদপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজেদা বেগম পলিন। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তাকে ‘করোনা জেনারেল’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। আর চাঁদপুরের আড়াইশ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেলকে করোনাভাইরাস বিষয়ক ‘ফোকাল পারসন’ ও মেডিকেল টিমের প্রধান হিসেবে মনোনীত করেছে।

চলমান করোনাযুদ্ধে নিঃসন্দেহে চাঁদপুরে চিকিৎসকদের মধ্যে শীর্ষযোদ্ধা তারা। সেবা নিতে আসা মানুষ, করোনা শনাক্ত হওয়া রোগী, স্বজন, সহকর্মী ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারাও তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দেশে করোনা সংক্রমের শুরুতেই আইইডিসিআরে করোনা বিষয়ক প্রশিক্ষণে জেলা থেকে শুধুমাত্র এ দুজন চিকিৎসক অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আরও কয়েক দফা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এই চিকিৎসক দম্পতি।

চাঁদপুর জেলায় করোনা রোগী বাছাই, নমুনা সংগ্রহ ও চিকিৎসা বিষয়ে যেসব চিকিৎসকের নাম এসেছে তাদের মধ্যেও শীর্ষে ডা. রুবেল-পলিন দম্পতি। এই চিকিৎসক যুগলের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার ফসল হিসেবে চাঁদপুর জেলার মধ্যে এখন পর্যন্ত সর্বাধিক সংখ্যক করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে সদর উপজেলা ও সদর হাসপাতালে।

হাসপাতালে নিয়মিত ডিউটির পাশাপাশি চিকিৎসা নিতে আসা লোকদের করোনা সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা, করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা লোকদের নমুনা সংগ্রহ করা, তাদের প্রাথমিক চিকিৎসাপত্র দেয়া, শনাক্তকৃত রোগীদের হাসপাতাল অথবা বাসায় (আইসোলেশন/কোয়ারেন্টাইন) চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান ও চিকিৎসাপত্র দেয়া, আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন রোগীদের প্রতি বাড়তি নজর রাখা, মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করা- একাধারে এসব কাজ করতে হয় ডা. এএইচএম সুজাউদ্দৌলা রুবেলকে। এর পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, মিডিয়াকর্মী, রোগী ও তাদের স্বজনসহ আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হয়, তথ্য দিতে হয়। পরম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে হাসিমুখে এতসব সামাল দিচ্ছেন তিনি।

ডা. এএইচএম সুজাউদ্দৌলা রুবেল বলেন, আসলে চাকরি বলেই নয়, মানবিক কারণে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কাজ করে যাচ্ছি। কাজের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হলো লোকজন তাদের সব উপসর্গ বলতে চায় না। এতে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ছে। টানা ডিউটির পর বাসায় গেলে জরুরি প্রয়োজনে আবারও আসতে হয়। সেটা দিনে হোক আর গভীর রাতেই হোক। সবচেয়ে বেশি মিস করি আমাদের সন্তানকে। ভাগ্যিস আমার বাবা-মা বাসায় আছেন। তাদের কাছে সন্তান রেখে আমরা দুজন মানুষকে সেবা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, মানবসেবার ব্রত নিয়েই তো ডাক্তার হয়েছি। মাঝে মধ্যে ক্লান্তিও আসে। কিন্তু পিছু হটলে তো হবে না। নিজেদের করোনাযুদ্ধের প্রহরী মনে করে আবার এগিয়ে যাই। এখান থেকে পিছু হটার সুযোগ তো নেই।

তার স্ত্রী ডা. সাজেদা বেগম পলিন বলেন, চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে আমার কোনো হাসপাতাল নেই। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের বিশেষ ব্যবস্থায় দাফন করা, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি টিম পাঠিয়ে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা, সন্দেহভাজন, আক্রান্ত, মৃতদের বাসা লকডাউন করার কাজ প্রতিদিনই করে যাচ্ছি। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘কোভিড-১৯’ নামের এক ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে প্রতিদিন এ রোগ নিয়ে তথ্য, পরামর্শ, চিকিৎসা ও সতর্কতা তুলে ধরছি। কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে, কখন দিন যায়, রাত পার হয়- তা টের পাই না।

তিনি আরও বলেন, চাঁদপুর সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের পাশাপাশি এখন ১৫ ওয়ার্ডের চাঁদপুর শহরটিও দেখতে হয়। কষ্ট তো হয়, খারাপও লাগে। ছেলেটাকে অনেক মিস করি। এখন আর আগের মতো সময় দেয়া হয় না তাকে। বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি বাসায়, আমাদের কারণে তারা আক্রান্ত হন কি-না সেই ভয়েও থাকি। বাসায় তাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করি- এটা যে কত কষ্টের তা বুঝানো যাবে না। মানুষের উপকারে আসতে পারাটা অনেক কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। আশায় বুক বাঁধি- এ দুর্যোগ তো স্থায়ী হবে না। করোনা তো একদিন পরাস্ত হবেই। আমরা করবো জয়, একদিন!

চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এ এইচ আহসান উল্যাহ বলেন, এই চিকিৎসক দম্পতি মানবতার সেবায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের কর্তব্যনিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ, একাগ্রতা, ধৈর্য্ ও সাহসিকতা অতুলনীয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা উপসর্গ নিয়ে অথবা এ সংক্রান্ত যে কোনো বিষয় সংবাদ জানার জন্য সাংবাদিকরা তাদের সঙ্গে যখনই যোগাযোগ করেন, কোনো রকম বিরক্ত না হয়ে ব্যস্ততার মাঝেও তথ্য তারা তথ্য দেন।

চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এই চিকিৎসক দম্পতি শহরের আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানে কাজ করলেও করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা, নমুনা সংগ্রহ ও সচেতনতায় শুরু থেকে সক্রিয় রয়েছেন। সন্তানকে দূরে ঠেলে মানবকল্যাণে দিন-রাত খাটুনির চিত্র এ জেলায় দ্বিতীয়টি না থাকায় এ দম্পতি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

তিনি আরও বলেন, ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেলকে করোনা বিষয়ক ‘ফোকাল পারসন’ ও মেডিকেল টিমের প্রধান হিসেবে মনোনীত করে কর্তৃপক্ষ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা শতভাগ সঠিক ও সময়োপযোগী ছিল। ডা. রুবেল তার কাজের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তার প্রমাণ রেখে চলেছেন। এছাড়াও ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেলের পাশাপশি করোনার সময়ে ডা. সাজেদা বেগম পলিন রোগীদের সেবায় দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলছেন। তার এর যুগান্তকারী পদক্ষেপের কারণেই তাকে স্বাস্থ্য অধিদফর থেকে ‘করোনা জেনারেল’’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের ১৪ জন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে করোনাযুদ্ধের জেনারেল উপাধি দেয়া হয়। এর মধ্যে ডা. সাজেদা বেগম পলিন অন্যতম।