Home / ইসলাম / ইসলামে ‘করজে হাসানাহ’র নির্দেশ ও উপকারিতা
করজে হাসানাহ’র
করজে হাসানাহ’র

ইসলামে ‘করজে হাসানাহ’র নির্দেশ ও উপকারিতা

নিঃশর্ত ঋণ আদান-প্রদানের ইসলামি পরিভাষা হলো ‘করজে হাসানাহ’। মানুষ প্রয়োজনের তাগিদেই এ ধার বা ঋণ আদান-প্রদান করে থাকে। ইসলামি অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থা ‘করজে হাসানাহ’র ফজিলত ও সাওয়াব অপরিসীম। কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা থেকেই তা প্রমাণিত। করজে হাসানা বা উত্তম ঋণের বিনিময় সম্পর্কে একাধিক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
১. ’তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা কর, জাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও।’ (সুরা মুযাম্মিল : আয়াত ২০)

২. ‘নিশ্চয়ই দানশীল ব্যক্তি ও দানশীলা নারী, যারা আল্লাহকে উত্তমরূপে ধার (করজে হাসানাহ) দেয়, তাদেরকে দেওয়া হবে বহুগুণ এবং তাদের জন্যে রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার।’ (সুরা হাদিদ : আয়াত ১৮)

৩. مَّن ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللّهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ أَضْعَافًا كَثِيرَةً وَاللّهُ يَقْبِضُ وَيَبْسُطُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
‘তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে, আল্লাহকে করজে হাসানাহ দিতে প্রস্তুত; অতঃপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহু গুণ বৃদ্ধি করে দেবেন। আল্লাহই সংকোচিত করেন এবং তিনিই প্রশস্ততা দান করেন এবং তাঁরই কাছে তোমরা সবাইকে ফিরে যেতে হবে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৪৫)

করজে হাসানার উপকারিতা
করজে হাসানা মানে হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াবের আশায় কাউকে নিঃশর্ত ঋণ দেওয়া। ইসলামের দৃষ্টিতে এই করজে হাসানার উপকারিতা অপরিসীম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময় তাঁর প্রিয় সাহাবিদের করজে হাসানার প্রতি উত্সাহিত করেছেন। কেননা এর মাধ্যমে মানুষ অফুরন্ত সওয়াব ও কল্যাণে ভাগিদার হতে পারে। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় প্রমাণিত-
১. হজরত কায়স বিন রুমি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কোনো একজন মুসলিম অন্য মুসলিমকে দুবার ঋণ দিলে এ ঋণদান আল্লাহর পথে সে পরিমাণ সম্পদ একবার সদকা করার সমতুল্য।’ (ইবনে মাজাহ)

২. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার বিপদগুলো দূর করে দেবেন।’ (বুখারি)

৩. হজরত বুরাইদাহ আল-আসলামি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি (ঋণগ্রস্ত) অভাবি ব্যক্তিকে অবকাশ দেবে, সে দান-খয়রাত করার সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি ঋণ শোধের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সময় বাড়িয়ে দেবে সেও প্রতিদিন দান-খয়রাত করার সওয়াব পাবে।’ (ইবনে মাজাহ)

৪. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এক ব্যক্তির কিছু ঋণ ছিল। (ঋণদাতা তাগাদা দিতে এসে কিছু অশোভনীয় আচরণ করে) সাহাবাগণ তাকে কিছু (প্রতিরোধ) করতে চাইলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাকে ছেড়ে দাও, পাওনাদারের কিছু বলার হক আছে। তিনি তাদের আরও বললেন, তাকে এক বছর বয়সী একটি উট খরিদ করে দাও। সাহাবাগণ বললেন, আমরা তো তার দেয়া এক বছর বয়সের উটের মতো পাচ্ছিনা; বরং তার চেয়ে ভালো উট পাচ্ছি। তিনি বললেন, তবে তাই কিনে তাকে দিয়ে দাও। কেননা যে উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ করে, সে তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি। কিংবা তিনি বলেছেন, সে তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম।’ (বুখারি)

করজে হাসানাহ বা ঋণ পরিশোধে অবহেলা
এমনকি কেউ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সময়মতো ঋণ পরিশোধে অবহেলা করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্বনবি। হাদিসে এসেছে-
হজরত শারিদ বিন সুওয়ায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে সচ্ছল ব্যক্তি কোনো দেনা পরিশোধ করতে গড়িমসি করে, তাকে অপমান ও শাস্তি দেওয়া আমার জন্য হালাল। আল আত-তানাফিসী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, অপমান করা অর্থ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে এবং শাস্তি দেওয়ার অর্থ তাকে জেলখানায় বন্দি করা।’ (ইবনে মাজাহ)

করজে হাসানাহ গ্রহণকারী অক্ষম হলে
কিন্তু ঋণগ্রহীতা যদি বাস্তবেই অক্ষম হয়, তাহলে সামর্থ্য থাকলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি লোকদের ঋণ দিত; যখন সে কোনো গরিবকে দেখত, তখন সে তার চাকরকে বলত, তাকে ক্ষমা করে দাও, হয়তো আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে আমাদের ক্ষমা করবেন। এরপর লোকটির মৃত্যুর পর আল্লাহ তাআলার দরবারে উপস্থিত হলে, আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দিলেন।’ (নাসাঈ)

করজে হাসানাহ দেওয়ার উৎসাহ ও দোয়া
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভাবিকে ঋণ দেওয়ার প্রতি যেমন উৎসাহ দিয়েছেন, তেমনি সময় মতো ঋণ পরিশোধের প্রতিও জোর দিয়েছেন। এমনকি তিনি নিজেও সর্বদা ঋণমুক্ত জীবনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন।

মানুষের কাছ থেকে উত্তম ঋণ তথা করজে হাসানা নেওয়ার পর তা পরিশোধের প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকা যেমন জরুরি। তেমিন তা পরিশোধে মহান আল্লাহর দরবারে ধরণা দেয়ার বিকল্প নেই।

কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধার-দেনা পরিশোধের তাওফিক কামনা করে আল্লাহ তাআলার দরবারে ধরনা দেওয়ার কথা বলেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখনই কোনো পেরেসানি অনুভব করতেন, তখনই এ দোয়া পড়তেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ الْجُبْنِ وَالْبُخْلِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ غَلَبَةِ الدَّيْنِ وَقَهْرِ الرِّجَالِ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়া আউজুবিকা মিনাল আঝযি ওয়াল কাসালি, ওয়া আউজুবিকা মিনাল ঝুবনি ওয়াল বুখলি, ওয়া আউজুবিকা মিন গালাবাতিদ দাইনি ওয়া কাহরির রিঝালি।
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আপনার কাছে দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে আশ্রয় চাই, অপারগতা ও অলসতা থেকে আশ্রয় চাই, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে আশ্রয় চাই এবং ঋণের ভার ও মানুষদের দমন-পীড়ন থেকে আশ্রয় চাই।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)

সুতরাং করজে হাসানার উপকারিতা ও সাওয়াব পেতে হলে এমনভাবে করজে হাসানা তথা উত্তম ঋণ দিতে হবে, যাতে দুনিয়ার কোনো স্বার্থ না থাকে। বরং শুধু আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে এ ঋণ দিতে হবে। শুধু তাই নয়, সে অর্থ এমন কাজে খরচ করতে হবে যে কাজ আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন।

সুতরাং হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী করজে হাসানা বা উত্তম ঋণ গ্রহণ করার পর যদি তা পরিশোধের প্রচেষ্টা থাকে এবং ঋণ গ্রহণকারী আল্লাহর কাছে তা পরিশোধে বেশি বেশি এ দোয়া পড়ে তবে আল্লাহ তাআলা তাদের ঋণ পরিশোধের তাওফিক দান করবেন।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে করজে হাসানা গ্রহণ ও তা সময় মতো পরিশোধ করে উত্তম পুরস্কার পাওয়ার তাওফিক দান করুন। ঋণ পরিশোধের নিয়তে হাদিসে বর্ণিত দোয়া বেশি বেশি পড়ে ধার-দেনামুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

বার্তাকক্ষ, ২৯ জুলাই, ২০২১;