‘আমাদের দেহগুলো কাটতে দেবেন না, পাশাপাশিই কবর দেবেন’

আমাদের মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। সবার কাছে আমাদের একটাই অনুরোধ। আমাদের দেহগুলো দয়া করে কাটতে দেবেন না। পাশাপাশিই আমাদের কবর দেবেন। আর সবাই আমাদের ক্ষমা করে দেবেন। আমরা একজন আরেকজনকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। তাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলাম। বেঁচে থাকতে তো কেউ আমাদের এই সম্পর্ক মেনে নেবে না। বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে তাদের মনেও কষ্ট দিতে পারব না। তাই এই পথ বেঁচে নিতে বাধ্য হলাম দুজন। ইতি: রমজান + সুখী।’

পাঠক, এটি একটি সুইসাইড নোট। দুই তরুণ-তরুণীর আত্মহননের আগে এই চিরকুট লিখে গেছেন। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়ার চৌধুরীহাটে গভীর রাতে এ ঘটনা ঘটে। মৃত্যুর আগে অভিভাবকেরা তাঁদের সম্পর্ক মেনে না নিলেও পাশাপাশি হয়েছে শেষ আশ্রয়। বাড়ির পাশের পুকুরপাড়ে শুয়ে আছে এই জুটি। এখনো তাজা কবর। কবরে গুঁজে দেওয়া খেজুর গাছের ডাল দুটিও সতেজ।

রমজান আলী (২০) ও সুখী আকতার (১৬)। চৌধুরীহাটের বারইপাড়া গ্রামে সামনাসামনি দুজনের বাড়ি। দূরত্ব বড়জোর ৫০ গজ। সম্পর্কে বেয়াই-বেয়াইনও (তালতো ভাই-তালতো বোন)। রমজান নোয়াপাড়া কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সুখী নোয়াপাড়া মুসলিম উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। পাশাপাশি থাকার সুবাদে কাছাকাছি আসে একে অপরের। একসময় দুটি তরুণ মন স্বপ্ন দেখে ঘর বাঁধার। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বও আরেকটি প্রেমের সম্পর্ক ঘিরে। তিন বছর আগে রমজানের বড় ভাই আজগর আর সুখীর বড় বোন লাকী ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। এ সম্পর্ক এখনো মেনে নেয়নি দুই পরিবার। এই বিষয়টি বারবার ঘুরপাক খেতে থাকে দুজনের মাথায়। কী করবেন তাঁরা। পরিবার, না সম্পর্ক—এই টানাপোড়েনে মুষড়ে পড়েন রমজান ও সুখী। শেষ পর্যন্ত জীবনকে ছুটি দিয়ে দিলেন এই দুই তরুণ-তরুণী। মরণেও দুজন দুজনকে ছাড়া ভাবতে পারেননি কোনো কিছু। সেখানেও সহমরণ। সুখীদের বাড়ির পেছনের পুকুরপাড়ে একটি জামগাছের ডালে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন দুজন একসঙ্গে। একে অপরকে কোমরে বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায় তাঁদের মরদেহ। নিশ্চিত হওয়া গেছে, সুইসাইড নোটটি সুখীর হাতের লেখা!

গত মঙ্গলবার চৌধুরীহাটে সুখীদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ঘরের দাওয়ায় বসে আছেন মা জোবেদা খাতুন। মুখে কথা নেই। শুধু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। মেয়ের জন্য এখনো বিলাপ করে চলেছেন বাবা মোহাম্মদ ইদ্রিস। বাড়ির ভেতরে সুখীর কক্ষে পড়ার টেবিলে থরে থরে সাজানো পাঠ্যবই রসায়ন, বাংলা…। খাতাও পড়ে আছে টেবিলের ওপর। শুধু সুখী নেই।

তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট সুখী। ভাইদের বড় আদরের ছিল সে। বোনের মৃত্যুসংবাদ শুনে ওমানের মাসকাটে থাকা দুই ভাই ছুটে এসেছেন এক নজর শেষ দেখা দেখতে। ভাইদের জন্য মরদেহের গাড়িতে লাশ রেখে দেওয়া হয় দুদিন। তাঁরা আসার পর দাফন করা হয়।

বাবা ইদ্রিস বলেন, ‘আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি ও (সুখী) এ কাজ করবে। শান্তশিষ্ট, পড়ালেখায়ও ছিল ভালো। ছেলেটিও (রমজান) ছিল শান্ত। আমাদের মাথায় ছিল না তারা দুজন এমন করবে।’ মাসকাট থেকে আসা সুখীর ভাই মোহাম্মদ হাসান বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছা ছিল তাঁকে ডাক্তারি পড়াব। এখন সব শেষ।’ রমজানের বাড়িতেও শোকের মাতম। ছয় ভাই একবোনের সবার ছোট রমজান। তিনি চলে গেলেন সবার আগে। বাবা সালেহ আহমেদ থাকেন সৌদি আরবে। ছেলের মৃত্যুসংবাদ শুনে তিনিও মুষড়ে পড়েছেন। এ ঘটনা মানতে পারছেন না সুখীর বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও। কথা বলার সময় শ্রেণী শিক্ষক ফণী ধর দাশের গলা ধরে আসছিল। বললেন, ‘সে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত প্রথম অথবা দ্বিতীয় হয়ে এসেছে। কিন্তু নবম শ্রেণীর শেষ দিকে এসে সে প্রায়ই বিষণ্ন থাকত। যার প্রভাব পড়ে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে। রোল নম্বর হয় ১১। আমি নানাভাবে তার কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেছি কি হয়েছে। কিন্তু কিছু বলেনি।’

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জিয়া উদ্দিন বলেন, ‘এ ঘটনার পর আমরা প্রতিটি শ্রেণীতে কাউন্সেলিং করেছি। শিক্ষার্থীদের বলেছি, এ ধরনের ঘটনা হলে পারিবারে বলতে না পারলেও যেন শিক্ষককে জানায়। আর অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে।’ রমজানের বন্ধুরা জানান, তিনি প্রায় সময় তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে হতাশ থাকত। বলত, ‘দেখিস, একদিন সব ছেড়ে চলে যাব।’ এ যাওয়া যে শেষ যাওয়া হবে, তা বোঝেননি বন্ধুরাও।

মোহিত কামাল, মনোরোগ চিকিত্সকআত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়।

মোহিত কামাল, মনোরোগ চিকিৎসক তরুণ-তরুণীদের এ ঘটনা নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম মনোরোগ চিকিৎসক মোহিত কামালের সঙ্গে। তিনি তিনটি ভাগে ভাগ করে এ ঘটনাটি বিশ্লেষণ করেছেন। প্রথমত: তরুণ প্রজন্ম ও মানসিকভাবে বিষণ্ন নারী-পুরুষদের বলতে চাই, আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয়। আত্মহত্যা মানে নিজেকে খুন করা। ধর্মীয় অনুশাসন ও সামাজিক বিধিনিষেধ না মেনে আইন লঙ্ঘন করা। রমজান ও সুখী সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, তাঁরা সমস্যা দেখে নিজেদের খুন করেছেন। তাঁরা খুনি।

দ্বিতীয়ত: অভিভাবকেরা তাঁদের অবেগটা বুঝতে পারেননি। এটি তাঁদের বড় ব্যর্থতা। রমজান ও সুখীর আবেগের মধ্যে কোনো শঠতা ছিল না। তাঁদের ভালোবাসার টানটা ছিল তীব্র। তরুণ বয়সের প্রথম প্রেম এ রকম হয়। সবকিছু ছাপিয়ে সম্পর্কটা তাঁদের কাছে অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায়। একে অপরকে না পেলে জীবন শেষ হয়ে যাবে, এমন ধারণা হয়। কিন্তু অভিভাবকেরা তাঁদের আবেগ না বুঝে পুরোনো বিরোধ জিইয়ে রেখেছেন। যার ফলে চলে গেল দুটি প্রাণ।

তৃতীয়ত: অভিভাবকদের বলতে চাই, তরুণ-তরুণীদের এ ধরনের সম্পর্ক দেখলে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের আবেগকে মূল্য দিয়ে সুযোগ দিতে হবে বিষয়টি শেয়ার করার। সময় নিয়ে তাদের বোঝাতে হবে। বাড়াতে হবে মমত্বের হাত। তাহলে বাস্তবতা বুঝে তারা নিজেরাই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কিন্তু তা না করে আমাদের সমাজে প্রথমেই তাদের ওপর নেমে আসে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। তা কখনোই সমস্যার সমাধান নয়। বাধা পড়লেই তারা পালিয়ে যায়, আত্মহত্যা করে কিংবা জড়িয়ে যায় মাদকের জালে। সংকট উত্তরণে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তাদের মনোরোগের চিকিৎসা দেওয়া উচিত।

নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ১০:২৫ পিএম, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, বুধবার

এমআরআর  

Share