Home / সাক্ষাৎকার / বাবার লাশ দেখার শর্ত ছিলো কান্না করা যাবে না
বাবার লাশ দেখার শর্ত ছিলো কান্না করা যাবে না

বাবার লাশ দেখার শর্ত ছিলো কান্না করা যাবে না

বাবার মৃতদেহ দেখে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন বড় মেয়ে তাহমিনা এনায়েত তনু। পাহারায় থাকা সেনা সদস্যরা তাতেই হুংকার ছেড়েছিল, ‘কাঁদলেই গুলি করে দেব।’

ভয়ে তনুকে সরিয়ে নিয়ে যান একজন আত্মীয়। এমন শোকের ক্ষণেও কারো শব্দ করে কাঁদার অনুমতি মেলেনি। কেউ যেন চিৎকার করে কাঁদতে না পারে তা নিশ্চিত করতে রাইফেল হাতে সতর্ক পাহারায় ছিল কয়েকজন সেনা সদস্য। তাই অসহায় স্বজনরা কেবল মরদেহ ঘিরে নীরবে অশ্রু ঝরিয়েছেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে এমন নির্মম ক্ষণ নেমে এসেছিল রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিদায়ী সামরিক সচিব কর্নেল জামিল আহমেদের পরিবারে। সেদিন ভোরে জাতির জনকের বাসায় হামলা চালিয়েছিল একদল বিপথগামী সেনা সদস্য। বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে সেনাপ্রধানসহ বেশ কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁকে রক্ষায় এগিয়ে আসার সাহস দেখাননি কেউই। ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু একজন, কর্নেল জামিল আহমেদ। বঙ্গবন্ধুর মহাবিপদ জেনে চুপ করে বসে থাকতে পারেননি তিনি। তিনিই একমাত্র সেনা কর্মকর্তা, যিনি জাতির জনকের টেলিফোন পেয়ে তাঁকে রক্ষায় ছুটে গিয়ে ঘাতকদের বুলেটে প্রাণ হারান। নীতিভ্রষ্ট একদল সেনা সদস্যের কলঙ্কিত কর্মকাণ্ডের দিনে নিজের জীবন দিয়ে সরকারপ্রধানের প্রতি আনুগত্য ও কর্তব্যপরায়ণতার দৃষ্টান্ত রেখে যান কর্নেল জামিল।

কর্তব্যে অবিচল, অসীম সাহসী কর্নেল জামিলকে সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি পথভ্রষ্ট সেনা সদস্যরা। তারা জামিলের মরদেহের প্রতিও চরম নিষ্ঠুরতা দেখায়। কর্নেল জামিলকে দাফন করা হয় জানাজা ছাড়াই। এমনকি এই বীর সেনার কাফনের কাপড়েরও ব্যবস্থা করা হয়নি। বিছানার চাদরে মুড়িয়ে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

ইতিহাসের সেই নির্মম অধ্যায়ের এসব তথ্য কালের কণ্ঠকে জানান শহীদ কর্নেল জামিল আহমেদের দ্বিতীয় কন্যা আফরোজা জামিল কঙ্কা। সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কঙ্কার বয়স তখন ১২ বছর। তার থেকে তিন বছরের বড় ছিলেন তনু।

গত শনিবার রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএসের বাসায় কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরের স্মৃতিচারণা করেন আফরোজা জামিল। তিনি বলেন, “গণভবনে মা-বাবার শয়নকক্ষের পাশেই ছিল আমাদের কক্ষ। ভোরের দিকে বাবা ও মায়ের উচ্চস্বরের কথাবার্তায় আমার এবং বড় বোনের ঘুম ভেঙে যায়। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম মা-বাবা বিচলিত। বাবা বিভিন্ন জায়গায় ফোন করছেন। পরে জেনেছি, বিচলিত হওয়ার কারণ ছিল বঙ্গবন্ধুর ফোন। লাল ফোনটা বেজে উঠতেই মা (আনজুমান আরা) এগিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরেছিলেন। ওপাশ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘জামিল কই? জামিলকে দে।’ মা দ্রুত বাবাকে ডেকে দেন। ফোন রেখে উদ্বিগ্ন বাবা জানান, বঙ্গবন্ধুর বাসায় হামলা হয়েছে। এরপর সেনাপ্রধানসহ একাধিক পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন বাবা। সেনাপ্রধান (কে এম সফিউল্লাহ) ফোর্স পাঠাবেন বলে বাবাকে আশ্বস্ত করেন।”

আফরোজা জামিল বলেন, “এক মুহূর্ত দেরি না করে বাবা ৩২ নম্বরের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর গাড়ির চালক আইনউদ্দিন মোল্লাকে ডেকে গণভবনে অবস্থানরত পিজিআর সদস্যদের ৩২ নম্বরের দিকে এগোনোর খবর দিতে বলেন। এরপর দ্রুত তৈরি হয়ে সাধারণ পোশাকেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে রওনা হন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মাকে বলেন, ‘মেয়েদের দেখে রেখ।’ অজানা এক আশঙ্কায় মা বলেন, ‘যাবা?’ বাবা তখন খানিকটা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলেন, ‘কী বলছ তুমি? আমাকে যেতেই হবে।’”

আফরোজা জামিল বলেন, “আমার বড় বোন তাহমিনা এনায়েত তনু বাবাকে এক গ্লাস পানি দেন। বাবা পানি খেয়ে সিগারেট ধরালেন। উনি প্রচুর সিগারেট খেতেন। সিগারেটটা খানিকটা খেয়ে ফেলে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। এ সময় মা বললেন, ‘ফেরার সময় শ্বেতাকে নিয়ে এসো।’ এটাই ছিল বাবার সঙ্গে মায়ের শেষ কথা।” ফাহমিদা আহমেদ শ্বেতা কর্নেল জামিলের তৃতীয় কন্যা। তিনি ঘটনার দিন মোহাম্মদপুরে খালার বাসায় ছিলেন।

আফরোজা জামিল বলেন, “বাবা তখন ডিজি-ডিএফআই পদে দায়িত্বরত। তিনি বের হয়ে যাওয়ার পর মা আমাদের বড় চাচাকে ফোন করেন। খারাপ কিছু হতে পারে, তিনি বোধ হয় এমনটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। চাচা বলেন, ‘মিঠুকে (কর্নেল জামিলের ডাকনাম) আটকালে না কেন?’ মা উদ্বিগ্ন হয়ে বিভিন্ন সেনা কর্মকর্তাকে ফোন করতে থাকলেন। এরই মধ্যে রেডিওতে ঘোষণা এলো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। সকাল ৯টার দিকে বাবার গাড়ির চালক আইনউদ্দিন বাসায় ফিরে কোনো কথা না বলে শুধু কাঁদতে লাগল। মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার সাহেবকে কোথায় রেখে এসেছ?’ আইনউদ্দিন কিছু না বলে শুধু কাঁদতে থাকল। মা তখন গণভবনে সেনা কর্মকর্তাদের ফোন করতে থাকলেন। কিন্তু কেউই স্পষ্ট করে কিছু জানাচ্ছিল না। এভাবে দুপুর হয়ে গেল। জোহরের নামাজের সময় সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর ফোন এলো। তিনি ফোনে মাকে বললেন, ‘ভাবি, জামিল ভাই আর নেই।’ আমাদের মাথায় যেন তখন আকাশ ভেঙে পড়ল। দুপুরের দিকেই দুজন সেনা কর্মকর্তা আমাদের বাসায় এলেন। আমাদের তাঁরা লালমাটিয়ায় বড় চাচার বাসায় নিয়ে গেলেন। আমরা বাবার মরদেহের অপেক্ষায় রইলাম।”

যেভাবে নিহত হন কর্নেল জামিল

কর্নেল জামিলের গাড়িচালক আইনউদ্দিন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ২০ নম্বর সাক্ষী। তাঁর চোখের সামনেই নিহত হন কর্নেল জামিল। আইনউদ্দিনের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ভোর ৫টার দিকে তাঁর রুমের কলিং বেল বেজে ওঠে। তখন তিনি অজু করছিলেন। তাড়াতাড়ি বাসার সামনে গেলে কর্নেল জামিল ওপর থেকে দ্রুত গাড়ি তৈরি করতে এবং গণভবনে গিয়ে সব ফোর্সকে হাতিয়ার-গুলিসহ পাঁচ মিনিটের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার নির্দেশ জানাতে বলেন। গণভবনে সৈনিকদের নির্দেশ জানিয়ে তিনি ফিরে এলে কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে রওনা হন। ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর রোডের মাথায় তাঁরা গণভবন থেকে আসা ফোর্সদের দেখেন। সোবহানবাগ মসজিদের কাছে পৌঁছলে দক্ষিণ দিক থেকে শোঁ শোঁ করে গুলি আসতে থাকে। তখন ফোর্স অ্যাটাক করানোর কথা বললে কর্নেল জামিল বলেন, এটা ওয়ার-ফিল্ড নয়, ফোর্স অ্যাটাক করালে সিভিলিয়ানদের ক্ষতি হতে পারে।

তখন আইনউদ্দিনকে প্রতিপক্ষের অবস্থান জেনে আসতে নির্দেশ দিয়ে কর্নেল জামিল গাড়িতেই বসে থাকেন। আইনউদ্দিন যখন দেয়াল ঘেঁষে ৩২ নম্বরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন পাঁচ-ছয়জন সেনা সদস্য দৌড়ে জামিলের গাড়ির দিকে যায়। তিনি (আইনউদ্দিন) হাতে ইশারা করে কর্নেল জামিলকে সরে যেতে বলেন। স্যার, স্যার বলে আওয়াজও করেন কয়েকবার। কিন্তু কর্নেল জামিল তাঁর দিকে তাকাননি।

কর্নেল জামিলকে হত্যার মুহূর্তের কথা জানিয়ে আইনউদ্দিন বলেন, ‘ওই সময় আর্মির অস্ত্রধারী লোকগুলো গাড়ির কাছে পৌঁছে যায়। কর্নেল জামিল দুই হাত উঠিয়ে তাদের কিছু বলার বা বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা দুই-তিনটি গুলি করলে কর্নেল জামিল মাটিতে পড়ে যান।’

রাইফেল তাক করে কান্না চাপাতে বাধ্য করা হয়

কর্নেল জামিলকে হত্যার পর তাঁর স্ত্রী, সন্তান, ভাইসহ ঘনিষ্ঠজনদের কান্নার অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছিল পথভ্রষ্ট সেনা সদস্যরা। সেদিন স্বজন হারানোর তাজা শোক বুকে নিয়েও মরদেহের সামনে শব্দ করে কাঁদতে পারেনি কর্নেল জামিলের পরিবার। উচ্চস্বরে কাঁদা বা হৈচৈ করা যাবে না—এ শর্তে রাজি হয়ে শহীদ জামিলের মরদেহ দেখতে পান স্বজনরা। লাশ দেখানোর সময় পাহারায় থাকা সেনা সদস্যরা রাইফেল তাক করে রেখে কান্না চাপাতে বাধ্য করে স্বজনদের।

আফরোজা জামিল বলেন, ‘আমরা লালমাটিয়ায় চাচার বাসায় বাবার লাশের অপেক্ষায় ছিলাম। বাবার লাশটিও ঘাতকরা আমাদের দেখতে দিতে চায়নি। একপর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর-উত্তমের মধ্যস্থতায় তারা আমাদের লাশটি দেখতে দিতে রাজি হয়। কিন্তু শর্ত বেঁধে দেয় লাশ দেখে কাঁদা যাবে না। শর্ত মেনে নিলে রাত সাড়ে ১১টায় একটি ল্যান্ডরোভার গাড়িতে করে বাবার লাশ লালমাটিয়ায় নিয়ে আসে। বাবাকে গাড়ির পেছনের সিটে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু গাড়িতে পুরো শরীর না ধরায় দুই পায়ের খানিকটা বেরিয়ে ছিল। অতি ফর্সা পা দেখেই আমরা বাবাকে চিনতে পারি। আমি বাবার পা ধরলাম। সেখান থেকে মরদেহ ঢাকা সেনানিবাসে খালেদ মোশাররফের বাসায় নেওয়া হয়। সেখানে স্বজনদের মরদেহ দেখতে দেওয়া হয়।’

শোক ও ভীতিকর সেই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে আফরোজা জামিল বলেন, “আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে ছিল সেনা সদস্যরা। গভীর শোকে আচ্ছন্ন আমাদের কারো হাহাকার প্রকাশের অনুমতিও ছিল না। মার চোখ দিয়ে নীরবে অশ্রু ঝরতে থাকল। এমন সময় হুট করে আমার বড় বোন তনু হু হু করে কেঁদে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে এক সেনা সদস্য বলে উঠল, ‘কাঁদলেই শ্যুট করে দেব।’ ভয় পেয়ে কেউ একজন তনুকে ভেতরে নিয়ে যায়।”

জোটেনি কাফনের কাপড়, জানাজা

সেদিন পথভ্রষ্ট সেনা সদস্যরা শুধু বর্বর হত্যাকাণ্ড চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। তারা নিহত ব্যক্তিদের লাশের প্রতিও নির্মমতা দেখিয়েছে। পদস্থ সেনা কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও সেদিন কর্নেল জামিলের জানাজা পড়ানো হয়নি, কাফনের কাপড়ের ব্যবস্থাও করা হয়নি। সেনা পাহারায় কোনো রকম গোসল করিয়ে, বিছানার চাদর দিয়ে মুড়িয়ে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাঁকে।

এ প্রসঙ্গে আফরোজা জামিল বলেন, ‘আমার চাচি আমেরিকা থেকে বিছানার একটা সাদা চাদর এনেছিলেন। তা দিয়েই বাবাকে সমাহিত করা হয়। বাবাকে ভালোমতো গোসলও করানো হয়নি। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের স্ত্রী আজমির শরিফ থেকে আতর আর কিছু সুগন্ধি এনে বাসায় রেখেছিলেন। উনি সেগুলো দেন বাবাকে দাফনের আগে। দাফনের সময়ও রক্তে চাদর ভিজে যাচ্ছিল।’

বঙ্গবন্ধুর প্রিয়পাত্র ছিলেন কর্নেল জামিল

১৯৭১ সালে পাকিস্তানে আটকা পড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারলেও বঙ্গবন্ধুর প্রিয়পাত্র ছিলেন কর্নেল জামিল। আফরোজা জামিল বলেন, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলার সময়ে বাবা আইএসআইয়ে কর্মরত ছিলেন। তখন বাবাসহ আরো দুজন কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যায়, এমন বেশ কিছু কাগজপত্র রমনা পার্কে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু দুজন অফিসারের মাধ্যমে জানতে পারেন। ১৯৭৩ সালে বাবা আমাদের নিয়ে পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার সুযোগ পান। এয়ারপোর্টেই একজন সেনা কর্মকর্তা জানান, বাবাকে বঙ্গবন্ধু দেখা করতে বলেছেন। আমরা বাসায় চলে যাই আর বাবা সোজা চলে যান ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। সেখান থেকে বাসায় ফিরে বাবা জানান, বঙ্গবন্ধু বাবাকে তাঁর সঙ্গে থাকতে বলেছেন। তিনি বাবাকে সিকিউরিটি কমান্ড্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেন। পরে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হলে বাবাকে সামরিক সচিব করেন। বঙ্গবন্ধু বাবাকে আস্থা-বিশ্বাসের যে জায়গায় স্থান দিয়েছিলেন, নিজের জীবন দিয়ে বাবা সেই আস্থার প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন।’

দুর্দিনেও রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব ফিরিয়েছেন আনজুমান আরা

১৫ আগস্টের মাসখানেক পর কর্নেল জামিলের স্ত্রী আনজুমান আরা বুঝতে পারেন তিনি সন্তানসম্ভবা। স্বামীর মৃত্যুর আট মাস পর জন্ম নেয় তাদের কনিষ্ঠ কন্যা কারিশমা জামিল। চার মেয়েকে নিয়ে অসহায় অবস্থায় পড়েন আনজুমান আরা। এ সময়ে তিনি সুইডেনসহ কয়েকটি দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব পান। কিন্তু যে মাটিতে কর্নেল জামিলকে সমাহিত করা হয়েছে তা ছেড়ে যেতে রাজি হননি তিনি।

আফরোজা জামিল বলেন, “সে সময় বিভিন্ন দেশ থেকে আমরা রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব পাই। কিন্তু মা দেশ ছেড়ে যেতে রাজি হননি। তিনি বলতেন, ‘আমরা দেশ ছেড়ে গেলে কর্নেল জামিলকে কেউ মনে রাখবে না।’ বাবার মৃত্যুর পর আমাদের নিয়ে মায়ের নতুন যুদ্ধ শুরু হয়। আমাদের কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। একবার আমার নানি ও আমাদের সঙ্গে নিয়ে মা সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের বাসায় যান। সেখানে জিয়াউর রহমান আমাদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন।”

বাবার মৃত্যুর পর নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলার কথা জানিয়ে আফরোজা জামিল বলেন, ‘১৯৭৯ সালে আমরা মোহাম্মদপুরে হুমায়ুন রোডের একটি বাসায় থাকতাম। একদিন হঠাৎ আমাদের বাসায় ডাকাতি হলো। টাকা-পয়সা, গহনার সঙ্গে বাবার স্মৃতিজড়িত প্রায় সব কিছুই ডাকাতরা নিয়ে গেল।’

বাবার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে জানিয়ে আফরোজা জামিল বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই ভালো ছবি আঁকতে পারতাম। চিত্রকলা নিয়ে পড়তে আমাকে বাবা প্যারিসে পাঠাতে চেয়েছিলেন। আমার বড় বোনকে ডাক্তারি পড়তে রাশিয়ায় পাঠানোর স্বপ্ন ছিল বাবার। তাঁর মৃত্যুর পর আমাদের আর এসব স্বপ্ন পূরণ হয়নি।’

আক্ষেপ নিয়েই চলে গেছেন আনজুমান আরা

খানিকটা আক্ষেপ নিয়েই ২০১২ সালের নভেম্বরে চিরবিদায় নেন আনজুমান আরা। আফরোজা জামিল বলেন, “বাবা সেনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বের প্রতি অবিচল থেকে প্রাণ দিয়ে সেনাবাহিনীর সম্মানকে বাড়িয়ে গেছেন। তাই মা চাইতেন সেনাবাহিনী শহীদ জামিলকে যথাযথ সম্মান দিক। ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্য যে কলঙ্কজনক ইতিহাস সৃষ্টি করে তা নিজের জীবন দিয়ে কিছুটা লাঘব করে গেছেন কর্নেল জামিল। মা প্রায়ই দুঃখ করে বলতেন, ‘জামিলের মৃত্যুর পর কতজনই তো সেনাপ্রধান হলো; কিন্তু একজন সেনাপ্রধানও তো জামিলের সমাধিতে গেল না। সেনাবাহিনী তো তাকে সম্মান জানাতে কিছু করল না।’”

আফরোজা জামিল বলেন, “মহাখালী ডিওএইচএসে আমাদের যে বাড়ি তা আমার মা এক সেনা কর্মকর্তার কাছ থেকে কিনেছেন। ঢাকায় আমাদের একটি জায়গাও দেওয়া হয়নি। মা বলতেন, ‘কর্নেল জামিলের মতো কর্মকর্তাদের সম্মান দিলে তরুণ কর্মকর্তারা উৎসাহিত হতো। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার সাহস ও অনুপ্রেরণা পেত এখনকার সেনা কর্মকর্তারা।’”

কর্নেল জামিলকে স্বীকৃতি

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ সময় কর্নেল জামিলের আত্মদানকে মূল্যায়ন করা হয়নি। তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে কর্নেল জামিলকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করা শুরু হয়। ১৯৯৭ সালে জামিলের পরিবারের উদ্যোগে গঠন হয় কর্নেল জামিল ফাউন্ডেশন। জামিলের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২০০৯ সালে তাঁকে বীর-উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। সেনাবাহিনীও তাদের এই বীর সেনাকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করেছে।

সংস্কৃতিমনা ছিলেন কর্নেল জামিল

আফরোজা জামিল বলেন, “বাবা ছিলেন সংস্কৃতিমনা। রবীন্দ্রসংগীত তাঁর ভীষণ পছন্দের ছিল। নিজেও রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ গানটি প্রায়ই গাইতেন। মাকে সঙ্গে নিয়ে প্রায়ই গাইতেন ‘মায়াবন বিহারিনী’ গানটি। ফটোগ্রাফিরও শখ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণে গিয়ে কিনে এনেছিলেন ইয়াশিকা ম্যাট ক্যামেরা। তা দিয়েই ছবি তুলতেন।”

যেমন আছেন পরিবারের সদস্যরা

১৯৯৬ সালে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন কর্নেল জামিল আহমেদের সহধর্মিণী আনজুমান আরা। ২০১২ সালের নভেম্বরে তিনি মারা যান। চার মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে তাহমিনা এনায়েত তনু ঢাকায় থাকেন। গ্যালারি কসমস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তিনি। মেজ মেয়ে আফরোজা জামিল পেশায় চিত্রশিল্পী। তিনি তৎকালীন ঢাকা আর্ট কলেজ, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। সেজ মেয়ে ফাহমিদা আহমেদ শ্বেতা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। আর সবার ছোট কারিশমা জামিল মেকআপ আর্টিস্ট। মহাখালী ডিওএইচএসে তাঁর ব্রাইডাল মেকআপের একটি প্রতিষ্ঠান আছে। (উৎস-কালেরকণ্ঠ)

নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১১:০০ এএম, ১৫ আগস্ট ২০১৬, সোমবার
ডিএইচ

Leave a Reply