Home / জাতীয় / ৭ মাসে গণ*পিটুনিতে নিহত ৪৩ জনের অধিকাংশই ছিলো নিরীহ ও প্রতিবন্ধী
৭ মাসে গণপিটুনিতে নিহত ৪৩ জনের অধিকাংশই ছিলো নিরীহ ও প্রতিবন্ধী

৭ মাসে গণ*পিটুনিতে নিহত ৪৩ জনের অধিকাংশই ছিলো নিরীহ ও প্রতিবন্ধী

দেশে হঠাৎ করে গণ*পিটুনির ঘটনা বেড়েছে। গত চার দিনেই বিভিন্ন স্থানে সাতজনকে গণ*পিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব বলছে, এ বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি থেকে জুন) সারা দেশে ৩৬ জন আর গত চার দিনে ৭ জন মিলিয়ে ৪৩ জন গণ*পিটুনিতে নিহত হয়েছেন।

গণ*পি*টুনির শিকার ব্যক্তিদের পরিচয় পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারী, মানসিক রোগী, প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধাসহ নিরীহ মানুষ গণপিটুনির শিকার হচ্ছেন।

এর মধ্যে রাজধানীর বাড্ডায় ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গত শনিবার গণপিটুনির শিকার হয়ে জীবন দিতে হলো তাসলিমা বেগমকে। তাঁর এমন মৃত্যু মানুষকে নাড়া দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে। এই ঘটনার রেশ না কাটতেই ওই দিন রাতে সাভারের অজ্ঞাত আরেক নারী গণপিটুনিতে নিহত হন। আর রোববার (২১ জুলাই) নওগাঁর মান্দায় পুকুরে মাছ ধরা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ছেলেধরার গুজব রটিয়ে ছয়জনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, নানা কারণে মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। আবার অপরাধীদের বিচারও ঠিকঠাক হচ্ছে না। মূলত এ কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

সম্প্রতি গণপিটুনির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ সদর দপ্তর গত শনিবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটেছে। গুজব ছড়িয়ে ও গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ। দ্রুতই জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে ওই বিজ্ঞপ্তিতে।

গণপিটুনির শিকার কারা -১৮ জুলাই নেত্রকোনায় ব্যাগে করে এক শিশুর ছিন্ন মাথা নিয়ে দৌড়ে পালানোর সময় এক যুবককে (২৮) পিটিয়ে হত্যা করেছে ক্ষুব্ধ জনতা। এরপর শনিবার বিভিন্ন স্থানে পাঁচজনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার খবর পাওয়া যায়। ওই দিন রাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে অজ্ঞাত একজন (বয়স আনুমানিক ৫৫) নিহত হয়েছেন। উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের দেওড়াছড়া চা–বাগান এলাকার কয়েকজন চা–শ্রমিকের ভাষ্য, গুজবের ওপর ভিত্তি করে উত্তেজিত কিছু লোক ওই ব্যক্তিকে পিটুনি দেন। অবশ্য পুলিশ নিহত ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি।

শনিবার নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গণপিটুনিতে নিহত সিরাজ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। সিদ্ধিরগঞ্জের ওসি শাহীন পারভেজ জানান, সিরাজ বোবা ও বধির ছিলেন। তিনি ছেলেধরা নন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজীব নন্দী বাংলাদেশ ও ভারতে গণপিটুনির বিষয়ে একটি গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীই বেশি গণপিটুনির শিকার হচ্ছে।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যা ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক।

তিনি বলেন, এ–জাতীয় ঘটনায় দেখা যায়, মানুষ কোনো বিষয়ে প্রাক্-মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। এরপর কোনো ঘটনায় সন্দেহ বা আতঙ্কগ্রস্ত হলে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে। যারা এসব ঘটনা ঘটায়, তখন তাদের মধ্যে বিচারবোধ কাজ করে না। এ জন্য সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে সবার আগে। আর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

কোন এলাকায় ঘটনা বেশি – আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে গত ছয় মাসে যে ৩৬ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন, তার মধ্যে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি, ১৭ জন। এ ছাড়া ঢাকায় নয়জন, খুলনায় পাঁচ, সিলেটে দুজন, বরিশালে দুজন এবং রাজশাহীতে একজন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন।

রাজীব নন্দীর গবেষণা বলছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো ঘনবসতির শহরে ছোটখাটো ঘটনায় গণপিটুনির ঘটনা ঘটলেও নিম্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে এমন ঘটনা বেশি হয়। যেমন নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, উত্তরবঙ্গ ও চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত উপজেলায় গণপিটুনির প্রবণতা বেশি।

বিচারে ধীরগতি – আট বছর আগে ২০১১ সালের জুলাই মাসে ঢাকার সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশি গ্রামে ‘ডাকাত সন্দেহে’ গণপিটুনিতে ছয় ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছিল। ওই ঘটনা নিয়ে তখন সারা দেশে তুমুল আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনার আট বছরেও বিচারকাজ শেষ হয়নি। এ ঘটনায় আসামি ৬০ জন, সবাই জামিনে আছেন।

ঢাকার একটি আদালতে এই মামলার বিচারকাজ চলছে। মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের একজন শাকিলা জিয়াসমিন বলেন, এখন ওই মামলার দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তার জেরা চলছে। আগামীকাল ২৩ জুলাই পরবর্তী তারিখ রয়েছে। তাঁর জেরা শেষ হলে আরেকজন তদন্ত কর্মকর্তার জেরা বাকি থাকবে। তিনি আশা করেন, আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে বিচারকাজ শেষ হয়ে যাবে।

২০১১ সালের ২৭ জুলাই নোয়াখালীতে নিরীহ কিশোর মিলনকে ডাকাত সাজিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও সে সময় ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল।

শিক্ষক রাজীব নন্দীর গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতে গত ১০ বছরে চাঞ্চল্যকর ২০টি গণপিটুনির কোনো বিচার হয়নি এবং সঠিক তদন্তও হয়নি। এর মধ্যে আমিনবাজারের গণপিটুনিসহ বাংলাদেশের ঘটনা সাতটি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। কোনো বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করছে না। আরেকটি বিষয় হলো অপরাধ হচ্ছে, কিন্তু অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, শাস্তি হয় না—এমন একটি ধারণাও কিছু মানুষের মধ্যে ঢুকেছে। এসব কারণে এসব ঘটনা ঘটছে বলে মনে হচ্ছে।

এসব থেকে উত্তরণের উপায় কী? কাজী রিয়াজুল হক বলেন, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। (প্রথম আলো)

বার্তা কক্ষ, ২২ জুলাই ২০১৯