Home / চাঁদপুর / জাতির পিতার জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ার পথে : ইকবাল পাটওয়ারী
ikbal-2nd-part

জাতির পিতার জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ার পথে : ইকবাল পাটওয়ারী

জাতির পিতার জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ার পথে-১ম পর্ব প্রকাশের পর- 
নতুন এ রাস্তা বেয়ে গাড়ি তিনটে আমাদের নিয়ে ছুটছে। এবার ইন্শাল্লাহ কোন বিপদের কোন আশংকা নেই। ফারুক ভাই বল্লেন, আর২৫ /৩০ কিলো গেলেই মাদারীপুর! এবং রাস্তা একেবারে তেলের নান বিয়াই!

এরপর বঙ্গবন্ধুর জেলা গোপাল গন্জ। ঐ রাস্তা তো আরো তেলের মতো! হঠাৎ আমার মনে হলো আরে! মাদারীপুরের নয়া সিভিল সার্জন তো আমাদের মন্টু ভাই! তার মানে ডা: সফিকুল ইসলাম মন্টু। আমাদের স্কুল কলেজের বড় ভাই! চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ছিলেন। এছাড়া একই শহরে আমাদের দেখা দেখি বসবাস তিন চার দশক।তুই তুমি সম্পর্ক আমাদের অনেক সাংবাদিকের সাথে।

ভালো মানুষ! কি কয়? এতো আপন মানুষের সাথে দেখা না করো তারই পাশ দিয়ে চলে যাবো! তা কি হয়? আমার কাছে ওনার নাৃবার আছে। কল দিলাম, যাচ্ছে না। দিলো ফারুক ভাই পেয়ে গেলেন। জোরেশোর সালাম বিনিময়। ঐ প্রান্ত থেকে বলা হলো আরে ফারুক এতো সকালে?

ফারুক ভাই বল্লো- আমরা তো আপনার কাছে! কোথায়? টুঙ্গিপাড়া যাচ্ছি শরীয়তপুর মাদারীপুর হয়ে। এখন কোথায় তোমরা? সখিপুর ভেদের গন্জের মাঝা মামাঝামাঝি। বল্লেন ঠিক আছো তো এখনো? বুঝলাম আর হেসেই দিলাম! এরমধ্যে গাড়ির ঝাঁকুনি হেলানো দুলানোর কোন কমতি নেই। মন্টু ভাই আমাকে শাহাদাত ভাই এবং ফারুককে বল্লেন, কিছুতেই আমরা যেন তার অফিস থেকে চা খেয়ে না যাই।

আর যদি যাই তাহলে আর কখনো কথা হবে না! বাস্। যাক সিদ্ধান্ত নিলাম যাবো। কিন্তু সিদ্ধান্তটা জানাতে হবে অন্য গাড়ািটাতে বসা সভাপতি মহাদয়কে। শাহাদাত ভাই বল্লেন, পাটোয়ারীকে জানান। বাপরে! মাদারীপুরে নামবো, চা খাবো! মন্টু ভাইয়ের সাথে কথা বলবো – এই কথা বলার সাথে সাথে শহীদ ভাই আমাকে নির্ঘাত বলবে- আলাপ আর চা নাস্তা খাওনের লেইগ্গা নি সামনে আগাইতাছস? কাম আছেনি তোগ? বল্লাম শাহাদাত ভাই, না আপনি ওনাকে বলেন।

69691865_419699568677830_1596634640381116416_n

অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে লেখক

শাহাদাত ভাই হেসে দিলেন এবং বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। ফোন ধরলো শাহাদাত ভাইয়ের, ভাষা এরকম- শুনেন সভাপতি সাব! ঐ আমদের ডাঃ মন্টু আছে না! ওনি মাদারীপুরের সিভিল সার্জন। চায়ের দাওয়াত করছে। সেখানে যাত্রা বিরতি হবে। আর আমরাও একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম আর কি। ঠিক আছে। ফোন রাখতেই শাহাদাত ভাই বল্লেন রাজি। হাসলেন। বল্লাম কি ভাই! কি কইলো? আর কি একটু চাপা চাপা মনে হয়! কারণ হয়তো সময় নষ্ট করতে রাজি না। আধঘন্টা যেতে না যেতৈ এরই মধ্যে আবার মন্টু ভাইয়ের ফোন। তোমরা কতদূর? আসতে ভুল করবা না!

সত্যিই আপন মানুষেরা দূরে থেকে যখন আপনের রক্তের গন্ধ পায় তখন মায়ার বাঁধনে পুরোটাই আটকে রাখতে চায়। এটিই দেখেছি এবং শিখতে চেষ্টা করছি।
অবশেষে আমরা ভাঙা গড়ার রাস্তা পেরিয়ে একটা সময় মাদারীপুর জেলা সদরে প্রবেশ করলাম। সিভিল সার্জন অফিস খোঁজে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু তাতে মন খারাপ হচ্ছে না। কারণ শহরে এমন একটা লেকের পাড় আমাদের গাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, মজাই লাগছে। এতো সুন্দর! এতো সুবিশাল লেক! আর তো কখনো দেখিনি! এ যেন বিদেশ! কী নান্দনিক পরিবেশ। আহ! দীর্ঘ নিঃ শ্বাস আমাদের! চাঁদপুরে এমন একটা সুন্দর লেক নেই! যা আছে তো সে যেন জীবিত থাকিয়াও মৃত।! এর এক পঞ্চমাংশের চেয়েও ছোট।

শেষ পেয়েই গেলাম লেকের পাড়ঘেষা সিভিল সার্জন অফিস। নামলাম সবে। মন্টু ভাইয়ের অফিস কক্ষে ঢুকেই করমর্দন। এতো চেনাদের পেয়ে যে কি তার অবস্থা তা বর্ণনা না করলেও বুঝা যায়। অফিস কক্ষে আমরা ছাড়া আছে একজন আগে থেকেই বসা। গাজী টিভির মাদারীপুর প্রতিনিধি আর তার বাচ্চা । ডেঙ্গুর হিসাব নিতে এসেছে। আরে বাবা! এইটা কী সেই পরিবেশ! এইটা জিগায় ঐটা জিগায়! এদিকে আমগো সময় গড়ায়।

madaripur civil serjon office

মাদারীপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সামনে

শহীদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। কি মুড! মেজাজ তুঙ্গে না হইলেও বেশি দেরি নাই বোধহয় বেটাকে বলতে – ভাই আমনের আর আইজগা কাম নাই? যান ভাই! পরে কথা কইয়েন! আমারই মনে হইছিলো কই একটা কিছু। না, আসলে পেশা সেটা পারমিট করবে না, তার হয়তো এসাইনমেন্ট। আর বল্লে মন্টু ভাই। না আর বলা লাগলো না, একসময় তিনি নিজেই থেমে গেলেন। এরমধ্যে আমি আমাদের গাজী টিভির প্রতিনিধি রিয়াদকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। এতো সাংবাদিক দেখে মাদারীপুর সিভিল সার্জন অফিস কর্মকর্তা কর্মচারীরা হতবাক!

যাক্ মন্টু ভাইকে বল্লাম – কি খাওয়াবেন তাড়াতাড়ি, উঠবো। যেতে হবে টুঙ্গিপাড়া, দিনাদিনি আবার ফিরতে হবে।এরই মধ্যে চলে এলো মাদারীপুরের বিখ্যাত মিষ্টি আর ছানা জাতীয় আরেকটি মুখরোচক খাবার। খেতে খেতে ঘুরে ফিরেই শরীয়তপুরের রাস্তার কথা। মিষ্টি খাওয়া শেষ। চা খাবো! কই? মন্টু ভাই বল্লেন একটু বসো কফি নয়তো চা আসছে।

শহীদ ভাইতো একলাফে বাইরে। আমি তো বল্লাম না ভাই! এখন না, পরে খামু। আমরা খুশি আপনেরে দেইখা। কিন্তু নাছোড়বান্দা ডাঃ মন্টু ভাই বল্লেন – তাহলে তোমরা যাওয়ার সময় কফি খেয়ে যাবা এই কথা দাও! কি আর করা! ঠিক আছে। বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা সবাই। স্মৃতি না রাখলে কী হয়, ছবি সেলফি তোলা হলো মন্টু ভাইয়ের সাথে। একদম গাড়ি পর্যন্ত উঠা অবদি মন্টু ভাই আমাদের সাথে।

নামতেই লেকটা ঘুরতেই শুনলাম হাসপাতালে ছাদে কাজ করতে গিয়ে ৩ শ্রমিক পড়ে গিয়ে একজন নাই! দু জনের যায় যায় অবস্থা। না ভাই! এখানে আজ আমাদের সাংবাদিকতা স্থবির। আজ আমরা দেখেই যাবো শুনেই যাবো। গাড়ি এবার গোপালগঞ্জ মহাসড়কে। বাহ! কি চমৎকার। চারদিকে পাহাড়ি লতা, ছোট বড় গাছ, পাশে আড়িয়াল খা নদী দৌড়াচ্ছে আমাদের সাথে। হয়তো একটু সামনেই মধুমতি। তারপর গোপালগন্জ পেরিয়ে টুঙ্গিপাড়া। যেখানে শুয়ে আছেন আমার সত্তা, আমার পরিচয়ের মহামানব।যাকে আমি দেখতে যাচ্ছি। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকে ফুল সিক্ত করবো। আর বলবো – ক্ষমা চাই পিতা!

69827120_1205599886315904_6002652550656950272_n

টুঙ্গিপাড়ায় লেখক

আমরা মাদারীপুর শহর ছেড়ে যখন এগুচ্ছি গোপালগঞ্জের দিকে তখন দুপুর ১২ টার একটু বেশী। যে পরিপাটি রাস্তা তাতে অনুমান করছি বেলা ২ টার আগেই পৌছে যাবো টুঙ্গিপাড়ায়।

চোখ ঢুলো ঢুলো। কারণ আজ খুব ভোরে উঠতে হলো। রোজগার রুটিনে ব্যত্যয় ঘটেছে। পাশ থেকে শোভন আর ফারুক ভাইয়ের জোর গলার কথা কানে লাগে, অমনি ঝিমুনি আর থাকে না। এদিক সেদিক তাকাই। চোখে পড়ছে না মানুষজনের চলাচল। আমাদের এখানে যেমন সড়কপাশে বড়সড় গাছ দু পাশে পড়ে সেসব একদম চোখেই পড়ছে না! কিছু দূর পর পরই শুকনো পাট মেলে রেখেছে আর তার খড়ির স্তুপ। এবার মনে মনে বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল।

তিনি ১৯৭২ এর পর সম্ভবত: ১৯৭৩ এর ২৬ মার্চ কিংবা ১৬ ডিসেম্বরের এক সমাবেশে তার বক্তৃতায় বলছিলেন- পাকিস্তানি ঐ দুষ্টরা, বর্বরা আমার সব কিছু ধ্বংশ করে দিয়ে গেছে। যেদিকে তাকাই সেদিকে ধ্বংস্তুপ। তবে ভাইরা তোমরা হতাশ হইও না! আমার পাট আছে, মাছ আছে, চা আছে আছে আরো সম্পদ। সোনালী আঁশ আমাদের অনেক বড় সম্পদ! চিন্তা করো না, সামনে আমাদের সুদিন আসবেই! শুধু তোমরা একটু পরিশ্রম কর। বঙ্গবন্ধুর ঐ ভাষনের সাথে তার এ অন্চলের পাট দেখেই মনে হলো তখন যেন কতো না বেশি পাট এখানে জন্মাতো।

ফারুক ভাই পাশ থেকে বলছে – বিয়াই! দেখছেন নি কতো হাওড়া লতা! আরে হাওড়া লতা মানে? আরে ঐ যে চোডকাল শিং এ কাতা দিলে নাহয় কাটা ছিড়া গেলে দৌঁড় দিয়া যে গাছের পাতা লতা ডলতাম আর রক্ত বন্দ হইয়া যাইতো? এবার হাসি আর রাখতে পারলাম না। বাইরে তাকিয়ে দেখি ঠিকই তো! লতা পাতা অনেক। বল্লাম – এগুলো তো পাহাড়িয়া লতা! একটা ধাক্কা দিয়ে বল্লো- আহারে শুদ্ধ আমার!

এরই মাঝখানে বন্ধুবর যুগান্তরের বিশেষ প্রতিনিধি ও ঢাকাস্থ চাঁদপুর সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি মিজান মালিক ফোন করলেন। বঙ্গবন্ধুর সমাধি পরে যাচ্ছি – ফেইজ বুকে দেখেছেন। বল্লেন, আপনারা প্রেসক্লাব থেকে একটা ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন। সহিসালামতে গিয়ে পৌঁছেন। আপনাদের মঙ্গল কামনা করি।
যাক কথা আর কথা বলতে বলতে গাড়ির জানলা দিয়ে চোখ রাখতেই দেখি জানান দিচ্ছে গোপাল গন্জ জেলা শহরের পাশ কেটে আমরা সেই গন্তব্য মানে জাতির পিতার টুঙ্গিপাড়া উপজেলা সদরের দিকে যাচ্ছি।

সড়ক ভালো হওয়ায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে গেলাম টুঙ্গিপাড়া গ্রামের ঐতিহাসিক শেখ বাড়ির সামনে। এর ১৫/২০ মিনিট আগে জামায়াতে জোহর পড়া শেষ হয়েছ।

বুকটায় একটা ব্যথা যেন অনুভব হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির তথা তাঁর সমাধি পথের ২ নং গেট দিয়ে আমাদের গাড়ি প্রবেশ করলো। বুঝলাম এটি বাড়ির দ্বিতীয় অনেক বড় লম্বা দরজা। আমরা বাড়ির যেটিক বাগ দরজা বলি। বেশ প্রসস্থ পাকা রাস্তা। আস্ত করে গাড়িগুলো ঢুকছে। একসময় সেসব গিয়ে থামলো বঙ্গবন্ধুর বাড়ির মসজিদ ও পুরনো লাল একটি দলান ঘরের কাছে। এরই মধ্যে আমরা সবাই নামলাম।

69529310_470044527168844_1639863061013594112_n

সামনে তাকিয়ে দেখি সুবিশাল সমাধি গেট। গেটের একটু দূরেই সাদা পাথরে নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট গোল করা জাতির পিতার সমাধিস্থল। যে ভবনটির দেয়ালের উপর জাফরি কাটা। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তৎকালিন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ ১৯৯৯ সালের ১৭ মার্চ এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।

আমরা সমাধি স্থলে যাওয়ার আগে অনেকে জোহরের নামাজ আদায় করলেন, কেউ কেউ সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর আদিবাড়িটির আঙিনা ঘুরলেন।
যেখানেই গিয়ে দাঁড়াই! মনে হয় কেউ যেন একজন বজ্রকন্ঠে ডাকছে তো বলছে- তোরা তো বাঙালি নাকি রে! তোরা কী আমার সোনার বাংলার মানুষরে? পদ্মা মেঘনা পাড়ি দিয়ে এলি আমায় দেখতে? আয়! কাছে আয় নির্ভয়ে – (চলবে) ——

জাতির পিতার জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ার পথে-১ম পর্ব

লেখক : ইকবাল হোসেন পাটওয়ারী,
সাবেক সভাপতি, চাঁদপুর প্রেসক্লাব,
চাঁদপুর প্রতিনিধি, দৈনিক সমকাল
প্রকাশক ও সম্পাদক : চাঁদপুর প্রতিদিন