চাঁদপুর

জীবন সংগ্রামে ভ্রাম্যমাণ দর্জি পেশায় চাঁদপুরে অভিরঞ্জনের ৭৫ বছর

বয়স ৯০ ছুঁইছুঁই, পেশার বয়সও ৬ যুগের বেশি পার হয়ে গেছে। তারপরেও পায়ের প্যাডেল চেপে সেলাই করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত নানা ধরনের পোশাকের টুকিটাকি মধ্য থেকে নিম্নবিত্তদের পোশাক জোড়াতালির কাজ।

চোখেমুখে চাহনিতে নেই বাড়তি কোনো অর্থ-বিত্তের চিন্তা। পরিবারের সাথে দু’বেলা পেটপুরে খেয়েদেয়ে সুস্থ থাকলেই সব আশা যেনো পূর্ণ হয়ে যাবে। এর এ আশায় বুকে বেঁধে একই স্থানে এক পেশায় দেখতে দেখতে পার করে ফেলেছেন ৭৫টি বছর।

কিন্তু বৃদ্ধ বয়সের শেষ দিনগুলো ছোট চাহিদায় একটু আরামদায়ক যদি হয়ে যায় তাহলেই যেনো বিশাল প্রাপ্তি।

কথাগুলো চাঁদপুর শহরের ছায়াবানী এলাকার প্রতাপ সাহ রোডের বাসিন্দা অভিরঞ্জন দেবনাথের সাথে কথা বলে কলম-কাগজের সমন্বয়ে উঠে আসা কিছু বাস্তবিক দৃশ্যপট।

বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সেলাই মেশিনের প্যাডেল ছাপতে ছাপতে প্রতিবেদকের সাথে অকপটে জীবনল্প জানিয়েছেন অভিরঞ্জন দেবনাথ। ৮৮ বছর বয়সী দেবনাথ খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারানোর পর সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়।

পরলোক গমনের আগে তার বাবা ইন্দোলাল দেকনাথ কিছুই রেখে যেতে পারেননি। স্ত্রী এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। তাই দুই বেলা দুমুঠো খাবার জোটানোর জন্য ওই সময় থেকে কাজে নামতে হয় অভিরঞ্জনকে। পেশায় তিনি একজন ভ্রাম্যমাণ দর্জি। সেলাই মেশিনের সাথে কখন তার জীবন আটকে যায় তা তিনি নিজেও জানেন না। দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে অভিরঞ্জন ফুটপাতে একটি সেলাই মেশিন নিয়ে কাজ করছেন। চাঁদপুর শহরের পালবাজার ব্রীজ সংলগ্ন আসলেই দেখা মিলবে বৃদ্ধ দর্জী অভিরঞ্জন দেবনাথের।

সদিচ্ছা, সুদৃঢ় সংকল্পই মানুষের জীবনে বয়ে আনে গৌরব আর সাফল্য। পেশার বয়সকে উল্লেখ করতেই যেনো দেবনাথের স্মৃতিগুলো বলার মাঝে এর চিহ্ন উপলব্দি হয়েছে। সদিচ্ছা শক্তির প্রভাবে জীবন চলার কণ্টকাকীর্ণ পথের সব বিষাক্ত কাঁটা নিজ হাতে উপড়ে ফেলে চালিয়ে যাচ্ছেন জীবন সংসার। কিন্তু জীবন সংগ্রামের এ যুদ্ধে শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ।

তুবুও নিজের পেশাকে বন্ধ না করে কারো কাছে হাত পাতেননি। মাথার উপর পলিথিনের ছাউনি আর পুরোনো আমলের সেলাই মেশিন আর বসার টুল নিয়ে ব্যস্তময় জীবন অতিবাহিত করছেন। সারাদিন কাজ করে যেটুকু আয় হয়, তা দিয়ে চলে জীবন-সংসার।

অভিরঞ্জন দেবনাথের ছেলে অর্জুন শহরের একটি স্বর্ণের দোকানে কাজ করে। আর মেয়ে অঞ্জলিকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্ত্রী আর এক সন্তানকে নিয়েই চলছে অভিরঞ্জন দেবনাথের সংসার জীবন। ছেলে কাজ করে যা পারে, তাই সহযোগিতা করে থাকে বলে জানান তিনি।

স্ত্রী সোনালী রানী দেবনাথ সব সময় পাশে থেকে মনে সাহস যুগিয়েছেন বলেই এখনো কাজ করে চলছি বলে অভিরঞ্জন। কয়টা টাকার জন্য অসুস্থ শরীর নিয়ে সারাদিন কাজ করি বলতেই প্রতিবেদকের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়েন বৃদ্ধা অভিরঞ্জন দেবনাথ।

তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েছি। কিন্তু ভাগ্যের চাকা নড়েনি। পালবাজার এলাকায় প্রায় ৭৫ বছর ধরে দর্জীর কাজ করে আসছি। একটু সৎ ভাবে ভালো থাকার চেষ্টা করেছি। অনেক বয়স হয়েছে, তাই এখন আর আমার কাছে কেউ কাজ করায় না। কোন দিন কাজ থাকলে ১শ’ থেকে দেড়শ টাকা। আর কাজ না থাকলে ৪০-৫০ টাকা নিয়ে বাড়ি যেতে হয়।

অসুস্থতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে আমার পা স্বাভাবিক ভাবে নাড়াতে পারি না। এই শরীর নিয়ে চলাফেরা করতে খুব কষ্ট হয়। এত কষ্টের মধ্যেও দর্জীর কাজ করতে হচ্ছে। বর্তমানে পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দীন ঝাপন করছি। যেখানে থাকি, তাও আবার ভাড়া বাড়ি। এত কষ্টের মধ্যেকি আর জীবন চলে। আমি সরকারি ভাবে কোন সহযোগিতা পাইনা। বয়স্ক ভাতা কিংবা কোন আর্থিক সাহায্য কেউ কোন দিন করেনি। আমাকে যদি চাঁদপুরের প্রশাসন কোন ভাবে সহযোগিতা করে হয়তো আরেকটু ভালো থাকতে পারতাম।’

বৃদ্ধা অসুস্থ অভিরঞ্জন দেবনাথের মত হাজারো মানুষ রয়েছে এ সমাজে। যারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সৎভাবে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। একমাত্র কাজেই জীবন চলার পথকে সহজ-সাবলীর করতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহারণ অভিরঞ্জন। তিনি আজ সমাজের কাছে বৃদ্ধ তবে বোঝা নন, বরং একজন আলোকিত মানুষ। শিক্ষা দিচ্ছেন অভীষ্ট সাফল্যে পৌঁছতে হলে সদিচ্ছা পোষণ করেই শত বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হয়।

প্রতিবেদক : শরীফুল ইসলাম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

Share