বাড়ীর গরু দরজার ঘাস খায় না। এই প্রবাদটি বিশ্বের অন্য কোন দেশের বেলায় প্রযোজ্য না হলেও বাংলাদেশের জন্য শতভাগ প্রযোজ্য।
জনৈক ভদ্রলোক তার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে খাবার টেবিলে শ্যালকের স্ত্রীকে বললেন “ভাবী আচারটাতো খুব মজার”। জবাবে ভাবী বললেন, ” কেন তোমার বাড়ীতে নেই”? ভদ্রলোক: কোথা থেকে থাকবে, আপনি কি দিয়েছেন আমাকে? ভাবী: না দেব কেন? আমিতো তোমার বাড়ী থেকেই নিয়েছি।
জনৈক সাংবাদিক কেনিয়াতে গিয়ে পি পি এইচ ম্যানেজমেন্ট এ মুগ্ধ হয়ে বলল, বাহ্ দারুনতো! এ্যানি মুলিঞ্জ অবাক হয়ে বলল, কেন তোমাদের ওখানে করে না? সাংবাদিক: কি করে করবে, তুমি কি শিখিয়েছ ওদের? মুলিঞ্জ: বল কি? আমি কেন ওদের শিখাব? আমিইতো শিখেছি তোমাদের ডাক্তারদের কাছে। সাংবাদিক হা।
কনডম কাহিনী: আমি তখন সায়েবা ম্যাডামের সহকারী অধ্যাপক। একদিন সায়েবা ম্যাডাম বললেন, ” আচ্ছা কনডমের ভিতরে পানি ঢুকালে কনডম কতখানি এক্সপ্যান্ড করবে? ফ্লাসব্যাকে মনে পরল গ্রামে বাচ্চারা ফ্যামিলি প্লানিং এর ফ্রী কনডম দিয়ে বেলুন বেলুন খেলত। ফুঁ দিয়ে যে ফুলাত তা মনে হোত ভালই রেজিস্ট্যান্ট। ম্যাডামকে বললাম সেই উদাহরন। সাথে সাথেই প্রাকটিক্যালি দেখা যে কতখানি পানিতে কনডম কতটা রেজিস্ট্যান্ট থাকে। ফেটে না যায়। তথৈবচ।
কেন এই প্রচেষ্টা?
প্রসবোত্তর রক্তক্ষরনরোধে জরায়ুর সাইনাসগুলোকে প্রেসার দিয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করা হোত Bakri ballon, Sengstaken- Blackmore oesophsgeal catheter, urological Rush ballon নামে কতগুলো বেলুনসদৃশ ডিভাইস, যেগুলো ব্যয়বহুল। তাই তারই অল্টারনেটিভ হিসেবে এই প্রচেষ্টা। যা অতিশয় স্বল্পখরচে ব্যবহারযোগ্য।
শুরু হোল ট্রায়াল। ম্যাডামের আইডিয়া নিয়ে রিসার্চের সব কাজ করলাম শুধু একটি ইউনিট এ। ২৭টি কেস সাকসেসফুলি করার পরে পেপার লিখলাম। নানান সওয়াল জবাবের পরে মেডসকেপ জেনারেল মেডিসিনকে কনভিন্সড করতে সমর্থ হলাম। ২০০৩ সালে পাবলিশড হোল। Use of condom in the control of massive postpartum hemorrhage. Medscape General Medicine 2003; 5(3):38. গুগলে টাইটেল লিখে সার্চ দিলেই চলে আসে। মেডসকেপে এটি একটি ফ্রী আর্টিকেল। রিসার্চ গেটে আমার বহুল পঠিত আর্টিকেলের মধ্যে এটি অন্যতম। পড়ে দেখবেন।
২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশে হাজার লক্ষ প্রসূতি এই উদ্ভাবনীর ফলাফল পেয়ে আসছেন।
কোন কিছুর রিকগনিশনে আমাদের যথেষ্ঠ কার্পন্য আছে বলেই বেশিজন জানে না। সব স্টুডেন্টরা জানে, কিন্তু প্রবর্তক এর নাম জানে না। কেননা যিনি পড়ান তিনি ভুলেও বলেননা এ কাহিনী। অথচ এটি বহির্বিশ্বেও সমাদৃত। তারই উদাহরন কেনিয়া। এটি Sayeba’s method বলেও পরিচিত।
কনডম ক্যাথেটার মেইল ইনকন্টিনেন্সে এ ব্যবহার হয়। এক্সটারনাল ক্যাথেটার। দু’টো জিনিশ এক নয়। আরও পড়ুন- ঘাসের চাষ শিখতে বিদেশ যাবেন ৩২ কর্মকর্তা
কে এই ডা. সায়েবা
সায়েবা আক্তার (জন্ম ১৯৫৩) একজন বাংলাদেশী স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা সার্জনসের একজন নির্বাহী সদস্য এবং এর আগে বাংলাদেশের অবস্টেট্রিক অ্যান্ড গাইনোকোলজি সোসাইটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা এবং গাইবান্ধায় দুটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যা সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করে।
তিনি ‘সায়েবা’স মেথড’ (সায়েবার পদ্ধতি) নামে ‘অত্যন্ত অল্প খরচে প্রসূতির রক্তক্ষরণ বন্ধের উপায়’ (ইউবিটি) সম্পর্কিত একটি বিকল্প পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন যা মাতৃমৃত্যুহার কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০২০ সালে একুশে পদক প্রদান করে।
সায়েবা ১৯৫৩ সালে চট্টগ্রামে এম এ মালেক ও মাহমুদা খাতুনের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিকেল ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বলেছিলেন যে চিকিত্সা প্রশিক্ষণ চলাকালীন তিনি যে ডাক্তারদের যেসব চিকিৎসকদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তাদের কাছ থেকেই তিনি যুবতী মায়েদের সহায়তা করার জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
সায়েবা ২০০০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান হিসাবে কর্মরত থাকাবস্থায় তিনি ‘অত্যন্ত অল্প খরচে প্রসূতির রক্তক্ষরণ বন্ধের উপায়’ (ইউবিটি) সম্পর্কিত একটি বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করেন এবং সফল হন।তিনি যখন ইউবিটি তৈরি করেছিলেন, তখন বাংলাদেশে প্রায় ৪০% মাতৃমৃত্যু প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণের কারণে ঘটতো। রক্তক্ষরণ রোধে তার এই বিকল্প পদ্ধতিটির মূল্য ৫০০ টাকারও কম। ২০০৩ সালের পর থেকে এই পদ্ধতির উপর তার গবেষণা পত্রটি বিশ্বের বিভিন্ন মেডিকেল সাময়িকীতে স্থান পায়। ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ জার্নাল অব অবসটেট্রিকস অ্যান্ড গাইনোকোলজিতে তার গবেষণাটিকে ‘সায়েবা’স মেথড’ (সায়েবার পদ্ধতি) নামে উল্লেখ করে, এর উপর একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১১ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজ অব অবসটেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্ট থেকে তার উদ্ভাবনের জন্য সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেন।
সায়েবা’স মেথড অনুসারে, প্রসূতির জরায়ুতে ক্যাথেটার দিয়ে বেলুনের মাধ্যমে বাতাস প্রবাহিত করে সাধারণত রক্ত বন্ধ করা যায়। তার উদ্ভাবিত এই বিকল্প পদ্ধতি বেশ কিছু দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী নারীদের স্বাস্থ্যের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে ও মাতৃমৃত্যহার কমাতে সহায্য করেছে। এই পদ্ধতিটি সায়েবার পদ্ধতি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির চিকিৎসক এবং মিডওয়াইফদের (সেবিকা) শেখানো হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রসূতি ফিস্টুলা সাধারণত শারীরিকভাবে শিশুর জন্মের জন্য প্রস্তুত নয় এমন কিশোরী নারীদের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। শারীরিকভাবে অপ্রস্তুত হওয়ার পাশাপাশি কিশোরী নারীরা সাহায্যের জন্য জিজ্ঞাসা করার সময় সামাজিক কলঙ্কে ভোগেন। এছাড়া এ বিষয়টি পরিচালনা করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ২০০৫ সালে সায়েবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে একটি জাতীয় কেন্দ্র চালু করেন যেখানে তিনি ফিস্টুলা চিকিৎসা করতে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেন। তিনি ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা ফিস্টুলা হাসপাতালে গবেষণা করে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের সহযোগিতায় ‘ইন্ড ফিস্টুলা‘ (ফিস্টুলা রোগের পরিসমাপ্তি) ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। প্রোগ্রামটি এক মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে শুরু হয়েছিল এবং এটি ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক থেকে অর্থায়ন পেয়েছিলো। ২০০৫ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে কেন্দ্রটি প্রায় চার শতাধিক রোগীর চিকিত্সা করেছিল এবং একইসাথে এখানে রোগীদের স্বাধীনভাবে আয়ের জন্য বিভিন্ন উত্পাদনমূলক কর্মকাণ্ড শেখানো হয়েছিলো যাতে তারা হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার পরে স্বাধীনভাবে চলতে পারেন। ২০১২ সালে সায়েবার মাধ্যমে এমএএমএমের ফিস্টুলা এবং মহিলা স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (এমএফডব্লুওএইচ), আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
২০০৮ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রসূতি ও গাইনোকোলজি সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি তখন থেকেই আন্তর্জাতিক স্ত্রীরোগ ও প্রসেসট্রিক্স ফেডারেশনের (এফআইজিও) সাথে জড়িত ছিলেন, যৌনাঙ্গে ট্রমা কমিটিতে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা একসাথে ফিস্টুলা সার্জারি প্রশিক্ষণ উদ্যোগ এবং বৈশ্বিক সক্ষমতা ভিত্তিক ফিস্টুলা সার্জারি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল তৈরি করে। বাংলাদেশের চিকিৎসক ও সার্জনদের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আখতার বাংলাদেশে স্ত্রীরোগ প্রবণতা হ্রাস করতে বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করেছেন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার বিয়ের আইনি বয়স বাড়িয়ে ১৮ করে। ২০১২ সালে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, সায়েবা এবং এফআইজি যৌথভাবে আফ্রিকা ও এশিয়ায় ৫০ জনেরও বেশি সার্জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলো যারা ৭ হাজার ৫শ’র বেশি এ ধরনের চিকিৎসা কার্যক্রমে অংশ নেন।
সম্প্রতি সায়েবা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাথে কাজ করেছেন। রোহিঙ্গা নারী ও মেয়েদের স্বাস্থ্যবিধি, পরিবার পরিকল্পনা এবং মাতৃস্বাস্থ্যের বিষয়ে অসচেতনতা ও সীমিত প্রবেশাধিকার রয়েছে।
সায়েবা অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার (২০১৮), মহিলা সুপার অ্যাচিভার অ্যাওয়ার্ড, মাদার তেরেসা পুরস্কার এবং লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কয়েকটি পুরষ্কার এবং সম্মান অর্জন করেছেন। তিনি রয়েল কলেজ অব অবেস্টেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টস, ভারতে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য কলেজ, পাকিস্তানের চিকিত্সক ও সার্জন কলেজ এবং ইন্ডিয়ান অবস্টেট্রিক অ্যান্ড গাইনোকোলজির সম্মানিত ফেলো। চিকিৎসায় বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০২০ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক প্রদান করে
লিখেছেন : অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম, ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ