Home / চাঁদপুর / ইলিশ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ
Abdul-Ghon

ইলিশ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ

ইলিশ এ দেশের জাতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ। তাই এর রক্ষণাবেক্ষণ বা সংরক্ষণ করা দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য । মধ্যপ্রাচ্যের তৈল সমৃদ্ধ দেশগুলোর মত ইলিশকে আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বলা চলে। পৃথিবীর অন্যতম পুষ্টিকর ও সুস্বাদু মাছ হলো এ ইলিশ। ইলিশের জীবনবৈচিত্র্য খুবই তাৎপার্যপূর্ণ ।

ইলিশ শুধু ডিম ছাড়ার সময় হলেই মেঘনাসহ অন্যান্য আমাদের দেশের নদী-নদীর মিঠাপানিতে প্রবেশ করে । যে অবস্থানে ইলিশ বিচারণ করে তার নাম হলো অভয়াশ্রম। আমাদের দেশে এখন ৬টি অভয়াশ্রম রয়েছে। চাঁদপুরের উত্তরে ষাট নল হতে চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ৮০ কি.মি এবং চাঁদপুর হতে পশ্চিম দিকে পদ্মার ২০ কি.মি এলাকা চাঁদপুরের অভয়াশ্রমের সীমানা বিস্তৃত।

ইলিশ ডিম ছাড়ার সময় হলেই তারা প্রাকৃতিকভাবে সমুদ্রের লোনা পানি ছেড়ে মিঠাপানির নদ-নদীতে প্রবেশ করে। একটি স্ত্রী জাতীয় ইলিশ মাছ একবার ১৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ পর্যন্ত ডিম ছাড়ার জন্য সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে মিঠাপানিতে আসে।

প্রকৃতিগতভাবে ভবিষ্য বংশধর টিকিয়ে রাখতে এমনটি করে থাকে বোধ হয় ইলিশ ।
মুক্তভাবে বিচরণ করে ডিম ছাড়ার পর পর এগুলো আবার লোনা পানিতে পেট খালি লম্বা লিক লিকে দেহ নিয়ে চলে যায়।

ডিম ছাড়ার পর ইলিশের রেণু মিঠাপানিতে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। হয় জাটকা ,হয় তথাকথিত টেম্পুইলিশ। নির্বোধ জেলারা তা বড় হতে না হতে এক প্রকার রাষ্ঠ্রীয়ভাবে নিষেধ এমন কারেন্ট জাল দিয়ে সেগুলো আবার ধরতে থাকে।

কারেন্ট জালের বৈশিষ্ট হলো সাদা, মসৃন ও চিকন । ইলিশ যখন দ্রুত পানিতে খাবারের তাগিদে ছুটতে থাকে তখন তাদের চোখে জালের রং এর মত পানির রং হওয়ায় বুঝতে পারে না বলেই আটকে যায় কারেন্ট জালে । আটকানোর সাথে সাথেই মারা যায় ।

ওয়ার্ল্ড ফিস সংস্থার এক তথ্যে জানা গেছে,বিশ্বের প্রায় ৮৬% ইলিশ বাংলাদেশে । এর একটির গড় ওজন বর্তমানে ৯৫০ গ্রাম । ২০১৪ সালে এর গড় ওজন ছিল ৫১০ গ্রাম । বর্তমান গবেষকদের মতে,এ বছর ৯৫০ গ্রাম হয়েছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ওজনের গড় ৫শ গ্রাম ।

ইলিশের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করলে পৃথিবীর বিভিন্ন বিদেশ থেকে আমদানি করা এক লিটার অকটেনের মূল্য ৯৮ টাকা, ১ লিটার পেট্রোলের মূল্য ৯৬ টাকা এবং ১ লিটার ডিজেলের মূল্য ৬৮ টাকা করে বিক্রি আমাদের দেশের পেট্রোল পাম্পগুলো ।

সে হিসেবে আমাদের দেশের নদ-নদী থেকে আহরিত একই ওজনের ইলিশের মূল্য ৮শ থেকে ১ হাজার টাকা। তাহলে বুঝতে বাকি নেই যে এটা কতটুকু মূল্যমানের মাছ এবং কতটুকু এর চাহিদা পৃথিবীর সর্বত্র।

পুষ্ঠিগুণ সমৃদ্ধ ও সু-সাধূ বলেই পৃথিবীর সকল দেশে এর চাহিদা রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, চাহিদা বাড়লে দামও বাড়ে।

চাঁদপুরে ২০টি নদীভাঙ্গনগ্রস্থ ইউনিয়ন ও ১১ টি বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে কম হলেও ৩ লাখ লোক স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এ নারী-পুরুষের প্রধান উপজীবিকা হলো মৎস্য আহরণ,কৃষিকাজ করা ও শাক-সবজি উৎপাদন,হাসঁ-মুরগি ও গবাদি পশু প্রতিপালন করা। বছরের নানা ঋতু বৈচিত্র্যের সাথে তাল মিলিয়ে এরা জীবন-জীবিকা চালিয়ে থাকে।

মৎস্য বিভাগের দেয়া এক তথ্যে জানা গেছে-দেশের নদীতীরবর্তী ও নদীবিধৌত এলাকায় ২% অধিবাসী ইলিশ মাছ আহরণে, মজুত ,সরবরাহ ,বাজারজাতকরণ ,আড়ৎদারি ,বরফ ব্যবসা,বরফ মিল শ্রমিক ও মালিক সম্পৃক্ত।

সুতরাং ২% লোক কিনা দেশের ৯৮% নাগরিকের জাতীয় সম্পদ এভাবে নষ্ট করবে- তা কেউ বোধ হয় মেনে নেবে না। কেবল জীবন বাঁচানোর দাবিতে রাতের অন্ধকারে ঐ মৌসুমি তথাকথিত জেলে আমাদের এ সম্পদকে ধ্বংস করবে তা দেয়া যেতে পারে না ।

নদীরতীরবর্তী এলাকার জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এ এবারের মা ইলিশ রক্ষায় একত্রে কাজ করার আহ্বানও জানিয়েছেন চাঁদপুর জেলা প্রশাসক মো.মাসুদুর রহমান খান ।

৫ অক্টোবর জেলার ট্রাস্কফোর্স জুম মিটিংয়ে তিনি তাঁর এ মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। হাইমচর নির্বাহী অফিসার ফেরদৌসী বেগমের সভাপতিত্বে ৬ অক্টোবর ও ১২ অক্টোবর চাঁদপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম নাজিম দেয়ানের এর সভাপতিত্বে সভায় জানা যায় ইলিশ সম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়েছে। এখন সকলকে মা ইলিশ রক্ষা করতে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

মৎস্যমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন,‘এবারে আমাদের ইলিশের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৬ লাখ মে.টন। এজন্য ১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত এ ২২ দিন ইলিশ ধরা,মজুত ও বাজারজাতকরণ বন্ধ থাকবে। এটা মৎস্য বিজ্ঞনিীদের বিজ্ঞানভিত্তিক হিসেব।’

দেশের ৩৬ টি জেলার ১৫৩ টি উপজেলায় ৫ লাখ ২৮ হাজার ৩ শ ৪২ পরিবারকে ২০ কেজি করে চাল দেয়া হবে । এজন্য সরকার ১০ হাজার ৫৬৭ মে.টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে। ইলিশের উৎপাদনকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার সমুদ্রে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করেছেন আরো ৩ হাজার ১ শ ৮৮ বর্গ কি.মি.এলাকা।

তবে জেলে প্রতিনিধিদের কেউ কেউ বলেছেন- প্রকৃত জেলেরা ইলিশ ধরার কাজে এ সময়ে লিপ্ত থাকে না । থাকে এক প্রকার মৌসুমী এবং খণ্ডকালীন জেলে।এরাই সবার অগোচরে ইলিশ জাল নিয়ে নদীতে নেমে পড়ে।

আবার কেউ কেউ বলেছেন-মা ইলিশ সংরক্ষণে সরকারি কিছুটা কৌশল পরিবর্তন আনার প্রয়োজন বলে মনে করেন। কারণ স্পিডবোট নিয়ে যখন কর্মকর্তারা নদীতে অভিযান পরিচালনা করতে বের হন-তখন চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় আসলে সম্ভবত সবাই জেনে যায় যে মৎস্য কর্মকর্তা ও প্রশাসনের লোকজন আসছে ।

আবার ফিরে আসার পরই তারা হয়তো আবার নেমে যায়। এ ধরনের বক্তব্য আমরা বিভিন্নভাবে নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছি।

সরকারি ছুটির দিন এমনটি বেশি দেখা যায়। অপর দিকে সকল সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাগণ এ সময় রাতের অন্ধকারে যেন ঐ মৌসুমি জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনে ফ্রিজিং না করে সে জন্যে চাঁদপুর জেলা ট্রাস্কফোর্সের ঘোষণাও চাই।

স্কুল,কলেজ,মাদ্রাসা,কারিগরি,মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জেম ও প্রাথমিক শিক্ষকগণ এ সময়ের জন্যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারেন অনায়াসেই। একটি দেশের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র থেকে নাগরিক যেমন অধিকার ভোগ করে থাকে ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের প্রতিও নাগরিকদের দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। দেশের
এ প্রাকৃতিক সম্পদ ইলিশের জন্যে তাই হওয়া উচিত।

তাই এখানে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা কী হতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । কোন এলাকায় কোন জেলে রাতের অন্ধকারে জাল-নৌকা নিয়ে বের হয় তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অজানা থাকার নয় ।

খাদ্য সহায়তা পাওয়া বা তথাতথিত মৌসুমি ঔ জেলোরা জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে বের হয় কিনা সেটা বের করা বা চিহ্নিত করা স্থানীয় নদীতীরবর্তী জনপ্রতিনিধিদের পক্ষে খুব কঠিন নয় বলে আমরা বিশ্বাস করি ।

তাই যেনতেনভাবে ইলিশের বিষয়টি বিবেচনা করলে তা আমাদেরই সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। কারণ এটা আমাদের জাতীয় সম্পদ। এ সম্পদ রক্ষা করা আমার, আপনার ও সকলের দায়িত্ব।

লেখক :আবদুল গনি,সাবেক শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী , চাঁদপুর । ১৩ অক্টোবর ২০২০