Home / ফিচার / নারীর অগ্রযাত্রায় বন্ধ হোক বৈষম্য ও অবহেলা
Sabitri-rani-ghosh

নারীর অগ্রযাত্রায় বন্ধ হোক বৈষম্য ও অবহেলা

নারী, কখনো জয়া- কখনো জননী, কখনো বোন- কখনো কন্যা। তবে সবশেষে নারী হলো মায়ের জাতি। যে সমগ্র মানবজাতিকে গর্বে ধারণ করে। এই যে মায়ের গর্ভ থেকে আমাদের জন্ম সে মায়ের জাতিকে যদি সম্মান না দেয়া হয় তাহলে সেটি হয় কলঙ্কজনক।

‘এ পৃথিবীর যা কিছু মহান চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় নারী ও পুরুষকে এভাবেই এঁকেছেন। আবার একই কবিতায় তিনি বলছেন ‘কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী’।

একজন শিক্ষিত, সৎ ও নৈতিক গুণাবলি সম্পন্ন নারীর হাত ধরেই পরবর্তী প্রজন্মের সফলতা আসে। কারণ নারী একজন পুরুষের পাশে থেকে তাকে সফলতার লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথকে মসৃণ ও সহ করে দেয়। এই পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মেই নারী জাতিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কোন সমাজ ও রাষ্ট্র কতটা সভ্য বা উদার তা নির্ভর করে সেখানকার নারীদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থানের উপর।

উন্নত বিশ্বের চেয়ে আমাদের মতো স্বল্পউন্নত দেশে নারীরা এখনো অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কারণ একজন নারীর চারদিক থাকে বৈষম্যের শত প্রাচীর ঘেরা। তার মানে এই নয় যে এদেশে নারীরা এগিয়ে যায়নি। বিশ্বের অনেক স্বল্পন্নত দেশের চেয়ে আমাদের দেশের নারীরা দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে একথা সত্য। তবে এখনো কিন্তু এই দেশে নারীরা পদে পদে নানান বৈশম্যের শিকার হচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে আমরা প্রথমত একটি কন্যাশিশুর প্রতি তাকাতে পারি। কন্যা শিশু জন্মদিলে এখনো আমাদের পরিবারগুলো ওই মায়ের প্রতি বাকা দৃষ্টিতে তাকায়। যেনো ওই মা দশ মাস দশদিন কষ্ট সয়ে একটি বোঝা ভুমিষ্ট করেছে। এখনো আমাদের দেশে ছেলে শিশুকে বলা হয় ‘বংশের প্রদীপ’। অথচ এই প্রদীপটি জন্ম নিলো কার থেকে সিটি ভাবি না। মা না হলে প্রদীপ কোথা থেকে আসবে সেটিও ওই বোকা সম্প্রদায় ভাবে না।

এখনো আমাদের এ অঞ্চলে কন্যা শিশুদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, বয়োঃসন্ধিকাল, বিকাশ প্রক্রিয়া কর্মক্ষেত্র ও জীবনধারার মূল্যায়ন; নানান ভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে তাদের মেধা ও মনন আবদ্ধ থাকছে সীমাবদ্ধ গ-িতেই। বর্তমান সময়ে ক’জন নারী তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাচ্ছে। গ্রামীণ জনপদে দৃষ্টি রাখলে এর এক ভয়াবহ চিত্র চোখে ভেসে ওঠে। সেখানে জন্মনেয়া নারীরা আধৌ কি তাদের প্রাপ্ত অধিকার কিংবা পরিবেশ পেয়ে থাকে? তারা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকারটি পর্যন্ত সঠিকভাবে পায় না। আর এ কন্যা শিশুরাই একটা সময় সমাজে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

গ্রামের কন্যাশিশুদের পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ হচ্ছে অভিভাবকদের অনাগ্রহ। এখানকার বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের কন্যাশিশুর শিক্ষার ব্যাপারে থাকেন অসচেতন। শিক্ষার সুযোগ পাওয়া যে একটি মেয়ের জীবনের জন্য অতি প্রয়োজনীয়, তা গ্রামের অধিকাংশ পিতামাতাই বোঝেন না। তবে গ্রামাঞ্চলে এখনো যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ভয়ানত তা হলো বাল্যবিয়ে। এখনো গ্রামের অধিকাংশ কিশোরী বাল্য বিয়ে শিকার হচ্ছে। বর্তমানেও বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে বাল্যবিবাহের হার শতকরা ৪৯ শতাংশ। অথচ সরকার বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে নানান প্রদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

পরিসংখ্যান বলছে প্রাইমারী বা মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির দিক দিয়ে কন্যা শিশুরা এগিয়ে। অথচ উচ্চ মাধ্যমিকের দিকে যেতে যেতে ক্রমশ তা কমতে থাকে। এ চিত্রটি গ্রামের পাশাপাশি শহরেও অনেকটাই সমান অবস্থানে রয়েছে। এর প্রধান কারণ হতে পারে বিয়ের পাশাপাশি পুরুষের তুলনায় নারীদের সেই অর্থে কর্মসংস্থান গড়ে না ওঠা। তাই সরকারের পাশাপাশি সামগ্রীকভাবেও নারীদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতে হবে।

আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কতোটা প্রয়োজন তা উপলব্ধি করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর নারীর উন্নয়নের নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বর্তমানে তার কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও নারী ক্ষমতায়নে অগ্রণী ভূমিকার রেখে যাচ্ছেন। তাঁর এই ভূমিকা এবং উদ্যোগ আন্তর্জাতিক পরিম-লেও বেশ প্রশংসিত হয়েছে। এজন্যে তিনি পুরষ্কারপ্রাপ্তও হয়েছেন।

আগামী ১১ অক্টোবর বিশ্ব কন্যাশিশু দিবস। গোটা বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ১১ অক্টোবর এই দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটিকে মেয়েদের দিনও বলা হয়। ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর তারিখে প্রথমবার এই দিবস পালন করা হয়েছিল। দিবসটির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো, লিংগ বৈষম্য দূর করা।

আমি মনে করি আমাদের দেশে নারীর উন্নয়নে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি আরো পরিবর্তন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার কিংবা সমাজের পাশাপাশি নারীদেরও আরো বেশি করে সচেতন হতে হবে। তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে। বাল্য বিয়ে, সামাজিক কুসংস্কার সহ সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় নারীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও লেখক, সম্পাদক পাক্ষিক চাঁদনগর।
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯