Home / শীর্ষ সংবাদ / সনদ জালিয়াতিতে চাকরিরত ফরিদগঞ্জ এআর পাইলটের প্রধান শিক্ষক নিয়ে তোলপাড়!
kazol-ar-pilot

সনদ জালিয়াতিতে চাকরিরত ফরিদগঞ্জ এআর পাইলটের প্রধান শিক্ষক নিয়ে তোলপাড়!

১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ও সম্প্রতি জাতীয়করণ হওয়া ফরিদগঞ্জ এআর পাইলট মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়টি বিধিসম্মত ভাবে বহু প্রধান শিক্ষক দায়িত্ব গ্রহণ করলেও গত ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সম্পূর্ণ বিধি বহির্ভূত ভাবে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক রফিকুল আমিন কাজল।

নিয়মিত ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা না মেনে, নিজ সনদপত্রের তথ্য জালিয়াতি করে, শিক্ষা বিভাগের চোখে ধুলো দিয়ে নিজে শুধু স্কুলটির প্রধান শিক্ষকই হননি, হয়েছেন জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে ফরিদগঞ্জ উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষকও!

এ বিষয়ে গত ২৯ জুলাই শিক্ষা অফিসার বরারবর স্কুলের নির্বাচিত ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মোশারফ হোসেন নান্নু স্বাক্ষরিত ২৮ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগপত্র প্রেরণ করা হয় জেলা । যেখানে প্রয়োজনীয় নথিপত্রসহ তুলে ধরা হয় রফিকুল আমিন কাজলের বিধি বহির্ভূত প্রধান শিক্ষক হওয়ার তথ্যাদি।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালায় গত ৪-৭-১৯৯৩ তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষে মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের পরিচালক মোঃ যোবাদুল হকের স্বাক্ষরিত পরিপত্রের ২য় অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে নিয়মিত ম্যানেজিং কমিটির পূর্ব সিদ্ধান্ত থাকতে হবে এবং শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্তে কোরাম থাকতে হবে’।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, এ নীতিমালা উপেক্ষা করে ২০১৩ সালে রফিকুল আমিন যোগদানের সময় কোনো নিয়মিত ম্যানেজিং কমিটি ছিলো না। তিনি উক্ত বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পূর্বে একটি স্বতঃস্ফূর্ত অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচন সম্পন্ন হয়। রহস্যজনকভাবে বোর্ড কর্তৃক কমিটির অনুমোদন স্থগিত হয়ে যায়। নির্বাচিত ওই অভিভাবক প্রতিনিধিগণ ২১-০৩-২০১১ তারিখে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। (রিট পিটিশন নং ১৭৫১)। ঐ রিট এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। রিট নিষ্পত্তি হওয়ার পূর্বেই এডহক কমিটির সিদ্ধান্তের উপর ভর করে প্রধান শিক্ষক হন রফিকুল আমিন।

প্রধান শিক্ষক রফিকুল আমিন একেক সময় তার সনদপত্রের একেক রকম তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি ফরিদগঞ্জ গৃদকালিন্দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন ৮-২-২০১১ তারিখে তার স্বাক্ষরিত শিক্ষক বিবরণী সংযোজনী-খ তে নিজের (প্রধান শিক্ষকের) শিক্ষাগত যোগ্যতা কলামে উল্লেখ করেন, এসএসসি ২য় বিভাগ, এইচএসসি ২য় বিভাগ এবং বিএসসি ২য় বিভাগ।

অথচ বর্তমান প্রতিষ্ঠান ফরিদগঞ্জ এ. আর. পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় সরকারি হওয়া সংক্রান্ত এক তথ্য প্রতিবেদনে চলতি বছরের ৪-৫-২০১৯ তারিখে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল আমিন এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক হাসিনা আক্তারের স্বাক্ষরিত পত্রে প্রধান শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা কলামে উল্লেখ করা হয়, এসএসসি ৩য় বিভাগ, এইচএসসি ৩য় বিভাগ এবং বিএসসি ২য় বিভাগ! সেমতে উক্ত নথিপত্রের সাথে উল্লেখিত বিবরণ অনুযায়ী সনদপত্রের কপিও প্রেরণ করা হয়।

নিজ স্বাক্ষরিত দুটি তথ্য বিবরণীতে দুরকম তথ্য কী করে সংযোজিত হয় তা নিয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে তার সহকর্মীদের মধ্যে।

এ বিষয়ে রফিকুল আমিনের শিক্ষাজীবনের একাধিক বন্ধু জানান, এসএসসি ও এইচএসসিতে রফিকুল আমিন ৩য় বিভাগ পেয়েছেন এ তথ্যটিই সঠিক। যা তিনি সম্প্রতি স্কুলের সরকারিকরণ তথ্যে উল্লেখ করে স্বাক্ষর করেছেন। যদি তা-ই সঠিক হয়, তবে রফিকুল আমিনের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ অবৈধ বলে অভিযোগপত্রে দাবি করেছেন মোশারফ হোসেন নান্নু।

২০০১ সালের ৭ ফেব্রুয়অরি তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মোঃ সাবের হোসেনের স্বাক্ষরিত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগকৃত শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সংক্রান্ত পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘২৪-৮-২০০০ তারিখের পূর্বে যে সব তৃতীয় শ্রেণি সনদপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়মনীতি পরিপন্থী উপায়ে অথবা অবৈধ উপায়ে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছেন পরীক্ষা করে তাদেরকে পরবর্তীকালে এমপিও তালিকা হতে বাদ দেয়া হবে।’

অথচ ২৪-৮-২০০০ তারিখের পূর্বে ২৫-৫-১৯৯৮ তারিখে নিজের সনদের ৩য় বিভাগের তথ্য গোপন করে ২য় বিভাগের ভুয়া সনদপত্র পেশ করে গৃদকালিন্দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হন রফিকুল আমিন কাজল। যা সরাসরি সনদ জালিয়াতি এবং শিক্ষা বিভাগের সাথে প্রতারণার সামিল বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন বিদ্যালয়ের নির্বাচিত ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মোশারফ হোসেন নান্নু,

এছাড়াও ৯-৬-২০০৯ তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ আতাউর রহমানের স্বাক্ষরিত পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘২৪-১০-১৯৯৫ তারিখের পূর্বে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারি অংশের বেতন ভাতাদি প্রদান ও জনবল কাঠামো নীতিমালা ছিলো না। তাই এ তারিখের পূর্ব পর্যন্ত শিক্ষা সনদে তৃতীয় বিভাগের চাকরি পাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীগণ যথাযথ বেতন ভাতাদি পাবেন। কিন্তু উক্ত তারিখের পর নীতিমালা আলোকে শিক্ষা সনদে তৃতীয় বিভাগধারী কোনো নিয়োগ বিধিসম্মত হবে না এবং তারা বেতন ভাতাদি প্রাপ্যের ক্ষেত্রেও বিবেচ্য হবে না।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন পরিপত্র যখন ১৯৯৮ সালে বাধা হয়ে দাড়ায় তখনই তৃতীয় বিভাগের সনদ আড়াল করে ২য় বিভাগের ভুয়া সনদ তৈরি করে গৃদকালিন্দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন রফিকুল আমিন।

২৪-১০-১৯৯৫ তারিখের জনবল কাঠামোতে এবং ১৬-০১-১৯৯৬ তারিখের সংশোধিত সার্কুলারে প্রধান শিক্ষক নিয়োগের অভিজ্ঞতায় উল্লেখ করা হয়, সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে কমপক্ষে ৩ বছরের অভিজ্ঞতা সহ শিক্ষকতায় নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যালয়ে এমপিওভুক্তির তারিখ থেকে ১৫ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এ নীতিমালাও ভঙ্গ করেছেন রফিকুল আমিন।

২৫-০৫-১৯৯৮ তারিখে গৃদকালিন্দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। তার প্রথম এমপিও হয় ০১-০৪-১৯৮৭ তারিখে। অর্থাৎ প্রথম এমপিও থেকে প্রধান শিক্ষক হওয়া পর্যন্ত তার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছিলো ১১ বছর ৪ মাস ১ দিন। ১৫ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নীতিমালাও ভঙ্গ হয়েছে তার পূর্বের প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে।

বর্তমান প্রতিষ্ঠান ফরিদগঞ্জ এ. আর. পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি যোগদান করেন ১৩-০২-২০১৩ তারিখে। এর পূর্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ সংশোধিত সার্কুলার ছিলো ৩০-০৯-২০১২ তারিখে। সে সার্কুলারে পূর্বের শিক্ষাগত যোগ্যতা সংশোধন করে উল্লেখ করা হয় শিক্ষা জীবনে একটি তৃতীয় শ্রেণী/সমমান গ্রহণযোগ্য হবে। অথচ এই নীতিমালার ৫ মাসের মাথায় শিক্ষা জীবনে ২টি তৃতীয় বিভাগ নিয়ে (এসএসসি ও এইচএসসি) এডহক কমিটির কাঁধে ভর করে বিধিবহির্ভূত ভাবে প্রধান শিক্ষক হন রফিকুল আমিন কাজল।

বর্তমান প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের নিমিত্তে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তর বরাবর গত ০৪-০৫-২০১৯ তারিখে রফিকুল আমিনের স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনের মন্তব্য কলামে তিনি উল্লেখ করেছেন সহকারী শিক্ষক হিসেবে ০১-০১-১৯৮৭ তারিখে প্রথম যোগদান করেন কাওনিয়া শহীদ হাবিব উচ্চ বিদ্যালয়ে। উক্ত বিদ্যালয়েই তার প্রথম এমপিও হয় ০১-০৪-১৯৮৭ তারিখে।

অনুসন্ধানে দেখা যায় তার ভিন্ন চিত্র। মূলত জুলাই ১৯৮৭ থেকে জুলাই ১৯৯৮ পর্যন্ত তিনি চাকরি করেন ফরিদগঞ্জ কালির বাজার মিজানুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে তার ইনডেঙ্ নং ছিলো ১২৭৩১৮, ইআইআইএন কোড নং ছিলো ১০৩৫৮০, এমপিও কোড ছিলো ০৭০২১৩১৩০১। একটি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১১ বছর চাকরি করা সত্ত্বেও কালির বাজার মিজানুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম সকল বিবরণীপত্রে গোপন করেছেন তিনি।

সকল কাগজ-পত্রাদির তথ্য উপাত্ত হতে জানা যায়, রফিকুল আমিন গৃদকালিন্দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে চাকরি করেছেন। অথচ বর্তমান কর্মস্থল ফরিদগঞ্জ এ. আর. পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে নিজ স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে শিক্ষক আত্মীকরণের নিমিত্তে মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, তিনি গৃদকালিন্দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ‘সরকারী প্রধান শিক্ষক’ পদে চাকরি করেছেন! যা স্পষ্টই জালিয়াতি মর্মে প্রতীয়মান।

এখানেই শেষ নয়। মন্ত্রণালয় বরাবর প্রেরিত তথ্যে গৃদকালিন্দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ১ম যোগদানের তারিখ তিনি উল্লেখ করেছেন ০১-১০-১৯৯৮ আর শিক্ষক বিবরণী সংযোজনী-খ ফরমে তিনি উল্লেখ করেছেন গৃদকালিন্দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম যোগদান ২৫-০৫-১৯৯৮! কোন্টি সঠিক তথ্য? আর কেনইবা ভুল তথ্যের অবতারণা করলেন তাও তদন্তের দাবি রাখে।

স্কুল সরকারিকরণ সংক্রান্ত একাধিক পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘কোন স্কুল সরকারিকরণ সংক্রান্ত তথ্যে ফরমে ভুল তথ্য প্রদান করলে ঐ সকল স্কুলের সরকারিকরণ বিলম্ব এমনকি বাতিলও হতে পারে।’ তবে কি বর্তমান প্রতিষ্ঠানের সরকারিকরণ বিলম্ব বা বাতিল করার জন্যই তথ্য জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন রফিকুল আমিন? সে প্রশ্ন স্কুলের শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যেও।

কোন শিক্ষক স্কুল পরিবর্তন করলেও যে স্কুলে কর্মরত ছিলেন সে স্কুলে তার এমপিও কপি সংরক্ষিত থাকার বিধান রয়েছে। কিন্তু কালির বাজার মিজানুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায় রহস্যজনক ভাবে রফিকুল আমিন কাজলের এমপিও কপি সে বিদ্যালয়ে সংরক্ষিত নেই! এবং ঐ স্কুল থেকে আসার পর পরবর্তী কোন নথিপত্রে তিনি স্কুলটির নাম উল্লেখও করেননি!

নিজের সনদপত্রের তথ্য জালিয়াতি করে এবং তথ্য গোপন করে তিনি শুধু প্রধান শিক্ষকই হননি, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে মনগড়া শিক্ষাগত যোগ্যতা বসিয়ে উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হওয়ার আবেদন করেছেন উপজেলা শিক্ষা অফিসে। উপজেলা শিক্ষা অফিস তার সনদের কোন কপি যাচাই বাছাই না করে শিক্ষা সনদের উল্লেখিত শ্রেণির উপর ভিত্তি করে উচ্চ পয়েন্ট দিয়ে রফিকুল আমিনকে ঘোষণা করেছিলো উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে।

গত ২৩-০৬-২০১৬ তারিখে রফিকুল আমিন বর্তমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও সমমানের অপর একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় গৃদকালিন্দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন! এবং সভাপতি থাকাকালীন উক্ত বিদ্যালয়ে একজন প্রধান শিক্ষকও নিয়োগ দেন তিনি। একই বছর তিনি মনতলা উচ্চ বিদ্যালয়েরও সভাপতি হয়েছিলেন। একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কী করে একই উপজেলার সমমানের একাধিক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হন তা নিয়ে সৃষ্টি হয় বিতর্কের। সে বিতর্কের জট ভাঙ্গতে খোঁজ নেওয়া হয় সভাপতি হওয়া সংক্রান্ত কাগজপত্রের।

রফিকুল আমিন কাজলের পূর্বের কর্মরত প্রতিষ্ঠান গৃদকালিন্দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সভাপতি থাকা সংক্রান্ত নথিপত্র যাচাই করে দেখা যায় সেখানেও তথ্য জালিয়াতি করেছেন তিনি। নিজে প্রধান শিক্ষক হিসেবে সরকারের বেতনভুক্ত পেশায় নিয়োজিত থাকা সত্ত্বেও সভাপতি ফরমে নিজের পেশা দিয়েছেন বিজনেস ম্যান (ব্যবসায়ী)। অর্থাৎ তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক থাকার তথ্য গোপন করেছেন। আর বোর্ড কর্তৃক ব্যবসায়ী রফিকুল আমিনকে অপর দু’টি বিদ্যালয়ের সভাপতি করা হয়। যা কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বোর্ডের সাথে প্রতারণার শামিল।

রফিকুল আমিনের দু’রকম সনদপত্রের তথ্যে বহু আগে থেকেই গুঞ্জন চলছিলো ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরে। বিশেষ করে তার শিক্ষা জীবনে দু’টি তৃতীয় শ্রেণি রয়েছে এমনটি লোকমুখে থাকলেও তিনি কখনও ২য় শ্রেণি কখনও তৃতীয় শ্রেণি বলে নথিপত্রে উল্লেখ করেছেন। ২০-০৩-২০০৫ ও ০৮-০২-২০১১ তারিখে শিক্ষক বিবরণী সংযোজনী-খ ফরমে তৎকালীন জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, চাঁদপুরের প্রতিস্বাক্ষরও রয়েছে। যে ফরমে তিনি নিজের শিক্ষাজীবনের ২য় শ্রেণির ভুয়া সনদ সংযুক্ত করেছিলেন।

এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার, চাঁদপুরের বরাবর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সনদপত্র ও নানা তথ্য জালিয়াতি করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ লাভের সুষ্পষ্ট কারণহেতু যথাযথ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করা হয়। যার অনুলিপি জেলা প্রশাসক, চাঁদপুর, দুর্নীতি দমন কমিশন, মাউশি অধিদপ্তর, সংসদ সদস্য, চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) সহ প্রয়োজনীয় দপ্তরে প্রেরণ করা হয়।

এরইমধ্যে গত ০৬- আগস্ট তারিখে চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য মুহাম্মদ শফিকুর রহমান জেলা শিক্ষা অফিস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসকে পুরো ব্যাপারটি তদন্ত করে কম সময়ের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করার জন্য ব্যবস্থা নিতে লিখিত নির্দেশ দেন।

অভিযোগের বিষয়ে কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোঃ আব্দুস সালাম জানান, সনদপত্র জালিয়াতি করে এবং দু’রকম তথ্য প্রদান করে প্রধান শিক্ষক হওয়ার বিষয়টি মাউশি ডিজি বরাবর অভিযোগ করলে তারা দ্রুত এর ব্যবস্থা নিবেন। ইতঃমধ্য প্রতিষ্ঠান সরকারি হয়েছে কিন্তু কোনো শিক্ষক সরকারি হননি। তাই শিক্ষক আত্মীকরণের পূর্বেই এ অভিযোগ ডিজি বরাবর পৌঁছানো উচিত। তবে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন সমমানের অপর এক বা একাধিক স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি থাকার কোনো বিধান নেই। এ ক্ষেত্রে তিনি তথ্য গোপন করে সভাপতি হলে তা বোর্ডের সাথে স্পষ্ট প্রতারণা করেছেন। যদি আমাদের কাছে অভিযোগটি পৌঁছে আমরা অতিদ্রুত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ করবো।

মাধমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুল মান্নান বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক ও বিব্রতকর। অতীতে অনেকেই নকল সনদপত্রের জন্য পদচ্যুত হয়েছেন। অভিযোগটি এখনও আমাদের হাতে এসে পৌঁছেনি। ডিজি বরাবর আবেদন এসে পৌঁছলে আমরা তড়িৎগতিতে ব্যবস্থা নিবো।

জেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ শফিউদ্দিন বলেন, ‘এ সংক্রান্ত অভিযোগপত্র আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। অভিযোগটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ডিজি ও কমিল্লা আঞ্চলিক অফিসেও পাঠানো হয়েছে। যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি চূড়ান্ত সরকারি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে, তাই এ বিষয়ে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যথাযথ তদন্ত করে যা সিদ্ধান্ত দিবেন আমি সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। তবে আমি মনে করি যে কোনো তথ্য জালিয়াতিই অন্যায় এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড় পাবেন না।’

এ অভিযোগ প্রমানিত হলে স্কুল সরকারিকরণে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘স্কুল সরকারিকরণে কোনো সমস্যাই হবে না। তা নিয়ে কারও আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। অভিযোগ প্রমানিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি যথাযথ সাজা পাবেন।’

এ বিষয়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলা ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা মমতা আফরিন বলেন, আমাদের ইউএনও মহোদয় ছুটিতে আছেন। আমি এসিল্যান্ড হিসেবে ভারপ্রাপ্ত ইউএনওর দায়িত্ব পালন করছি। এমপি মহোদয় আমাকে নির্দেশ দেওয়ার পর আমি এ বিষয়ে প্রাথমিক তদন্ত করার জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বরাবর প্রেরণ করি এবং বিষয়টি অতীব গুরুত্বের সাথে দেখতে বলি। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এ বিষয়ে তদন্ত করতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। কারন হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক র‌্যাংকিংয়ে উনার উপরে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশ সরাসরি নিষেধ করে দেওয়ায় আমি বিব্রত বোধ করি। বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো। তবে উপরের নির্দেশ পেলে এ অভিযোগের বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সাথে দেখবো। দুর্নীতি ও তথ্য জালিয়াতিকে কোনো ভাবেই প্রশ্রয় দিবে না ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বলেন, আমরা রফিকুল আমিন স্যারের পাঠানো তথ্যের উপর বিশ্বাস করেই জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক করেছিলাম। বর্তমান অভিযোগ নিয়ে এমপি মহোদয় এবং ইউএনও স্যার আমাদের বিষয়টি তদন্তের জন্য বলেছেন। যেহেতু স্কুলটি সরকারি হয়ে গেছে তাই শিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা উপরের নির্দেশের অপেক্ষায় আছি। নির্দেশ পেলেই কাজ শুরু করবো।’

অভিযোগকারী স্কুলের নির্বাচিত ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মোশারফ হোসেন নান্নু বলেন, ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরস্থ একটি স্কুলে এমন দুর্নীতিবাজ ও তথ্য জালিয়াতি করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ব্যক্তি প্রধান শিক্ষকের মত দায়িত্বশীল চেয়ারে বসে থাকবে তা আমরা অভিভাবকগণ মানতে পারিনি বলেই স্কুলের অভিভাবকদের পক্ষে এ অভিযোগ জমা দিয়েছি। আমি মনে করি, যে ব্যক্তি সনদপত্র জালিয়াতি করে অবৈধ ভাবে চাকরি পেতে পারে, সে ব্যক্তি স্কুলের অর্থনৈতিক হিসাব জালিয়াতি করেও লাখ লাখ টাকা ইতমধ্যে আত্মসাৎ করেছেন।’

কি কি খাতে জালিয়াতে করেছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকে অদ্যাবধি স্কুলের আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাব হয়নি। আমরা কমিটিতে যারা ছিলাম তারা বহুবার বলেও উনার কাছ থেকে আয় ব্যয়ের হিসাব পাইনি। ধর্মীয় লেবাসধারী এমন জালিয়াত, দুর্নীতিবাজের অনতিবিলম্বে বিচার হোক এমনটাই দাবী করছি।’

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ফরিদগঞ্জ এ. আর. পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল আমিন কাজল বলেন, সকল অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। সকল নিয়ম নীতি ঠিক রেখেই চাকুরি করছি।

ফরিদগঞ্জ করেসপন্ডেন্ট, ২৩ আগস্ট ২০১৯