সম্প্রতি অধঃস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের জন্য সাক্ষী ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’র খসড়া প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট। ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ ব্যাপারে অধঃস্তন আদালতে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাসহ অন্যান্য সংশ্লীষ্টদের মতামত দিতে আহ্বান করা হয়েছে।
উক্ত আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন মাদকবিরোধী অভিযানে চাঁদপুর জেলা পর্যায়ে ১৮ বার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী পুলিশ উপ-পরিদর্শক (এসআই) খন্দকার মোঃ ইসমাইল হোসেন। এরইমধ্যে অস্ত্র উদ্ধার, মামলার রহস্য উধঘাটনে পেয়েছেন আইজিপি পদক।
চাঁদপুরে মাদকবিরোধী অভিযানে সফল নেতৃত্ব দেয়ায় সাধারণ মানুষ ও সোস্যাল মিডিয়া ব্যাপক আলোচিত এ কর্মকর্তা, এক বার্তায় লিখেছেন মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট অপরাধের বিচার সুনিশ্চিত করতে সাক্ষীর সুবিধা প্রদানে যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা সময়ের দাবিও বটে।
আমার চলার পথের অভিজ্ঞতা থেকে সাক্ষীগণ যে সমস্যাগুলির সম্মুখিন হন তা উল্লেখ করলাম। আশা করি সবাই প্রস্তাবনাগুলো শেয়ারের মাধ্যমে মহামান্য আদালতের নজরে আনবেন।
‘সাক্ষী হওয়ার চাইতে আসামি হওয়া অনেক ভালো’
আমাদের দেশে শতভাগ মানুষ সাক্ষী হতে ভয় পায়। প্রবাদ আছে ‘সাক্ষী হওয়ার চাইতে আসামি হওয়া অনেক ভালো’। কোনো ব্যক্তি মামলার সাক্ষী হওয়ার পরপরই আসামীপক্ষ কর্তৃক ভয় ভীতি প্রদর্শন, আক্রমন, মামলায় জড়িয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানি শুরু হয়ে যায়। আবার যদি আসামীপক্ষ প্রভাবশালী হয়, তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই।
কর্মজীবনের একটি ঘটনাকে এখানে উদাহারণ হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। ২০০৬ সালে চট্রগ্রাম লোহাগড়া থানায় বনবিভাগের গাছ স্থানীয় হারুন চুরি করে নেয়ার সময় তার গাছগুলো জব্দ করা হয়। জব্দকৃত গাছ স্থানীয় লেদু মেম্বারের জিম্মায় রাখে।
পরবর্তীতে হারুণ তার দলবলসহ জোরপূর্বক গাছগুলো লেদু মেম্বারের কাছ থেকে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় লেদু মেম্বার তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
২০১৩ সালে অভিযুক্ত হারুণ অপর এক গাছ চুরির ঘটনায় প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হন। এ হামলায় মামলা করতে গিয়ে পূর্বের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিরপরাধ লেদু মেম্বার ও তার পরিবারের ৫ সদস্যকে জড়িয়ে মামলা করে।
ওই মামলাটির তদন্তে ভার আমার ওপর অর্পিত হলে, তদন্ত শেষে লেদু মেম্বার ও তার পরিবার ঘটনায় জড়িত না থাকায় অব্যহতি দিয়ে অভিযোগপত্র দাখিল করি। ৫ জনকে অব্যহতি দেয়ায় হারুণের অভিযোগের ভিওিতে আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার রুজু করা হয়।
সমন জারিতে যাতায়াত খরচের উৎস নেই
বিজ্ঞ আদালত থেকে সাক্ষীর নামে সমন ইস্যু হলে থানার একজন কনস্টেবলের মাধ্যমে জারি করা হয়। গ্রামে একটা সমন জারি করতে হলে ন্যুনতম ১ শ’ টাকা অঞ্চলভেদে সর্বোচ্চ ৫শ’ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। প্রতিদিন ওই কনস্টেবলকে কমপক্ষে ৫/৭টা সমন জারি করতে হয়। তাহলে সম্ভাব্য খরচ দাঁড়ায় হাজার থেকে ১৫ শ’ টাকা। এ টাকা প্রদানে পুলিশের কোনো উৎস্য নেই, অপ্রিয় হলেও সত্যি বেশির ভাগ সাক্ষীরাই এ টাকাটা দিয়ে থাকেন। আবার ব্যাতিক্রম ঘটনাও ঘটে সাক্ষীর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে অনেক দালাল বড় ধরনের অংকও হাতিয়ে নেয়। বাকিটা নাই বা বললাম? আর এই ধরনের ঘটনাগুলো নিয়ে এলাকায় মুখরোচক আলোচনার ঝড় উঠায় স্বাক্ষ্য প্রদানে ভীতির সৃষ্টি হয়। সমন জারি ক্ষেত্রে থানায় একটি মোটর সাইকেল ও পর্যাপ্ত জ্বালানি তেল দিলে ভালো হবে।
আগ্রহ সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে সাক্ষীর যাতায়াত ভাতা প্রদান
সাক্ষ্য প্রদানকারীর আসা-যাওয়ার খরচ জেলা প্রশাসকের দফতর থেকে প্রদান করা নিয়ম থাকলেও সহজভাবে এ অর্থ সাক্ষীর পাওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সাক্ষীর আসা-যাওয়ার খরচ সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে তাৎক্ষণিক প্রদান করা হলে সাক্ষ্য প্রদানে ৫০% আগ্রহ বাড়বে।
সাক্ষীর উপস্থিত/অনুপস্থিত বিড়ম্বনা
অনেক সময় সাক্ষী আদালতে উপস্থিত হলেও গুটি কয়েক অসাধু বিজ্ঞ পিপি ও এপিপি আসামির পক্ষপাত হয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ ছাড়াই সাক্ষীদের ফেরৎ পাঠিয়ে দেন। অথচ আদালতের নথিতে সাক্ষী থাকে অনুপস্থিত। এভাবে একাধিকবার আসা-যাওয়া করলেও নথিতে অনুপস্থিত থাকায় আদালত থেকে সাক্ষীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। এ বিড়ম্বনায় অধিকাংশরাই সত্য সাক্ষ্য দিতেও অনিহা চলে আসে। এ বিষয়ে সমাধানের জন্যে মামলার নথিতে সাক্ষীর উপস্থিতি বিষয়টি উল্লেখসহ তার উপস্থিতির সনদ প্রদান জরুরি।
সাক্ষ্য দেয়ার নিয়ম কানুন না জানা
সাক্ষী আদালতে যাওয়ার পর নির্দিষ্ট আদালতটা খুঁজে পেতে অনেক বেগ পেতে হয়। একইভাবে দির্ঘদিন পরে হওয়ায় মামলার অনেক বিষয় স্মৃতিতে থাকে না। সাক্ষীকে এই বিষয় সহায়তা করার জন্য প্রত্যেক জেলায় আদালতের ভিতরে সাক্ষী সহায়ক ডেস্ক করে তথায় মামলার ঘটনার বিষয় প্রাথমিক ধারণা প্রদান এবং সাক্ষ্য প্রদানকালে প্রতিপক্ষের উকিলের প্রশ্নের জবাব কিভাবে দিতে হবে এবং তার জেরাকালীন তির্যক বাক্যে ভীত না হয়, সে বিষয় ব্রিফিং দিতে চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা অথবা যাকে উপযুক্ত মনে হয় তাকে নিয়োগ দিলে ভালো হয়।
সাক্ষী নিরাপত্তা বিধান
সাক্ষী সুরক্ষা আইন করা আমাদের দেশের জন্য খুবই জরুরি। কারণ, বেশির ভাগ সাক্ষীরা ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়। আইন প্রযোগকারী সংস্থার নিকট গিয়ে অনেকক্ষেত্রে সাহায়্য পায় না বরং যাওয়াটাই তার অর্থদন্ড। সুরক্ষা আইনে সাক্ষী যখনই পুলিশের নিকট সাহায্য চাইবে তাৎক্ষণিক পুলিশ সাহায্য করতে বাধ্য থাকবে। অন্যথায় কঠিন শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে। আবার সাক্ষী সুযোগ পেয়ে যদি কাউকে হয়রানি করতে চায় তা প্রমানিত হলে সমকঠিন শাস্তি তার জন্যও প্রযোজ্য হবে। সাক্ষী যদি মনে করে পুলিশ তাকে যথাযথ সহযোগিতা করছে না তাহলে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ জেলা জজ একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তা নিরুপণ করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে।
সিটিজেন চার্টার
একজন সাক্ষী কি কি সুবিধা পাবে তাহা প্রত্যেক জেলা জজ আদালতের গেটে ও ভিতরে, প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদের সিটিজেন চার্টারে সংযোজন করলে ভালো হবে।
মুখোশ পড়ে সাক্ষ্য দেয়ার নেতিবাচক দিক
প্রস্তাবনায় উঠে আসা মুখোশ পরে বা অস্বচছ কাচের গ্লাসের ভিতরে থেকে সাক্ষ্য প্রদানের ব্যবস্থা করলেও সাক্ষীর পরিচয় কিন্তু গোপন রাখা সম্ভব নয় । বরং এতে একজনের সাক্ষী অন্যজনকে দিয়ে দেয়ার প্রবণতা ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে। এতে ন্যায় বিচার বিঘিœত হওয়ার সম্ভবনা অনেকাংশেই বিদ্যমান।
আদালতের অবস্থান না জানা
উদাহারণ স্বরুপ, সাক্ষীর প্রতি ইস্যুকৃত সমনে লেখা থাকে বিজ্ঞ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১ম আদালত, চাঁদপুর। কিন্তু আদালতটি জেলা শহরের কোন জায়গায় অবস্থিত নির্দিষ্ট স্থানের নাম উল্লেখ না থাকায় আদালতের অবস্থান খুঁজে বের করতে সাক্ষীর অনেক বেগ পেতে হয়। যদি সাক্ষীর নিজ জেলার বাইরে কিংবা বড় শহরে হলে আদালত খুঁজে বের করতেই সাক্ষ্য প্রদানের নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সমনে আদালতের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা উল্লেখ করলে ভালো হতো।
এটা আমার ব্যাক্তিগত মতামত যা আমার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরেছি।
প্রসঙ্গত, অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের জন্য সাক্ষী ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’র খসড়া প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট। সর্বোচ্চ আদালতের ওয়েবসাইটে ১৯ পৃষ্ঠার এ খসড়াটি প্রকাশ করা হয়। ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ ব্যাপারে মতামত দিতে অধঃস্তন আদালতে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাসহ অন্য অংশীজনকে আহ্বান করা হয়েছে।
সুপ্রিমকোর্ট যেদিন থেকে নির্দেশ দেবেন সেদিন থেকে এটি কার্যকর হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপির অর্থায়নে এ নীতিমালার খসড়াটি পস্তুত করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য সাক্ষ্য ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করে মামলার জট, সময় ও ব্যয় কমানো এবং সাক্ষীদের বারবার উপস্থিতি রোধ করা।
লেখক- উপ-পুলিশ পরিদর্শক, চাঁদপুর
: : আপডেট, বাংলাদেশ ৪: ০৩ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বৃহস্পতিবার
ডিএইচ
লেখকের আরো কিছু লেখা-