হিমোফিলিয়ায় সচেতনতার বিকল্প নেই

হিমোফিলিয়া একটি এক্স ক্রোমোজোম বাহিত বংশগত রক্তরোগ। লিঙ্গ নির্ধারক ক্রমোজোম জোড়ার দুটিই এক্স হওয়ায় নারীরা এর বাহক। তবে এতে আক্রান্ত হয় পুরুষরা। রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক উপাদানের মধ্যে বিশেষ দুটি উপাদান ফ্যাক্টর এইট ও ফ্যাক্টর নাইন-এর ঘাটতির কারণে যথাক্রমে হিমোফিলিয়া-এ এবং হিমোফিলিয়া-বি রোগ হয়। মূলত হিমোফিলিয়া হচ্ছে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় ত্রুটি তথা অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ জাতীয় রোগ।

মোট হিমোফিলিয়া রোগীর ৮৫ শতাংশই হিমোফিলিয়া-এ-তে আক্রান্ত হয়। বংশগত রোগ হওয়ায় একজন হিমোফিলিয়া রোগীর নানা, মামা কিংবা খালাত ভাইদের কারও কারও এই রোগ হতে পারে।

দেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে একজন হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত। সে হিসেবে বাংলাদেশে মোট হিমোফিলিয়া রোগী থাকার কথা ১৬ হাজারের বেশি। কিন্তু সব রোগী রোগ নির্ণয়ের সুবিধার আওতায় না আসায় ঘোষিত রোগী তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার।

হিমোফিলিয়াকে ‘রাজকীয়’ রোগ বলা হয়। কারণ ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়া এর বাহক ছিলেন। তার থেকে তার নিজ ছেলে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও রাজকন্যাদের মাধ্যমে রাশিয়া, জার্মানি, বেলজিয়ামের রাজপরিবারে এটা ছড়িয়ে পড়ে।

তবে যথাযথ চিকিৎসা পেলে হিমোফিলিয়া রোগীরা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন। তবে সঠিক চিকিৎসা না পেলে পরিণতি পুরোপুরি পঙ্গুত্ব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত্যুও হতে পারে। কিন্তু এই ‘যথাযথ’ চিকিৎসা প্রায়োগিক ক্ষেত্রে জটিল ও আর্থিকভাবে এতটা ব্যয়বহুল যে, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে তা অসম্ভব। আর এ জন্যই হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রোগীদের স্বার্থে রোগীরাই গঠন করেছেন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব হিমোফিলিয়া। আর দেশে দেশে গড়ে উঠেছে ন্যাশনাল মেম্বার অর্গানাইজেশন।

হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রোগীদের সাধারণত কোনো আঘাতে বা কেটে গেলে সেখান থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না বা বিলম্বিত হয়। এর লক্ষণ হলো, শিশুর জন্মের পর নাভি থেকে রক্ত যাওয়া, এরপর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কনুই, হাঁটু, পায়ের গোড়ালি ফুলে যাওয়া, কোনো কারণে আঘাত পাওয়া জায়গায় কালশিটে দাগ পড়ে। দাঁত পড়ার সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণও এর লক্ষণ।

মনে রাখা দরকার, শুধু যে শরীরে কোথাও কেটে গেলেই রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না এমন নয়। এসব রোগীর অর্ধেকেরই বেশি মারাত্মক হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত, যাদের কোনোরকম দৃশ্যমান আঘাত ছাড়াই অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশির ভেতরে রক্তক্ষরণ হতে পারে বছরে ৩০-৩৫ বার। এর অনিবার্য পরিণতি পঙ্গুত্ব। ৫ থেকে ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক, শ্বাসনালি বা পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ হতে পারে, যা মৃত্যুর কারণও হতে পারে।

হিমোফিলিয়া রোগের চিকিৎসার মূল হচ্ছে ফ্যাক্টর এইট এবং ফ্যাক্টর নাইনের যে ঘাটতি থাকে, সেটা পূরণ করা। এর চিকিৎসা মূলত দুটি। রক্তক্ষরণের দ্রুততম সময়ে ফ্যাক্টর ইনজেকশন দিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা। একে বলা হয় অন ডিমান্ড বা প্রয়োজন সাপেক্ষে চিকিৎসা। আরেকটি হলো, মারাত্মক হিমোফিলিয়া রোগীদের একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় ফ্যাক্টর ইনজেকশন সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন করে একটানা দিয়ে যাওয়া, যাতে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা ৯০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। একে বলা হয় প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা। দুটি চিকিৎসা পদ্ধতিই অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সেই সঙ্গে দরকার হয় ফিজিওথেরাপি।

তাই হিমোফিলিয়ায় সতর্ক থাকা এবং সাবধানতাই একমাত্র পথ। এসব রোগীর শরীরে আঘাত লাগতে পারে যেসব কাজে, সেখানে সতর্কতা অবলম্বন করা, কোনো অস্ত্রোপচারের আগে রক্তের ফ্যাক্টরের মাত্রা চেক করা, মাংসপেশিতে ইনজেকশন না দেয়া এবং যেকোনো ব্যথানাশক ওষুধ না খাওয়া উত্তম। পরিবারে কেউ হিমোফিলিয়া রোগী থাকলে সাবধান হতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক ডা. অখিল রঞ্জন, বিশ্বাসবিভাগীয় প্রধান, হেমাটোলজি এবং বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

২০ এপ্রিল ২০২৩
এজি

Share