Home / বিশেষ সংবাদ / হিন্দু বিধবা নারী টপির করুণ গল্প
হিন্দু বিধবা নারী টপির করুণ গল্প

হিন্দু বিধবা নারী টপির করুণ গল্প

এককালে স্বামীর মৃত্যুর পর কম বয়সী বিধবাদের সহমরণে যেতে হতো। না হয় পাঠিয়ে দেয়া হত বাপের বাড়িতে। তবে সেখানেও সাধারণভাবে স্থান ছিল না। সিঁথির সিঁদুর মুছে, দেহের সব অলঙ্কার খুলে ফেলে, চুল কেটে, সাদা থান পরে, এক বেলা নিরামিষ খেয়ে অনশনক্লিষ্ট অবস্থায় বৈধব্য পালন করতে হতো। বিধবাদের পুনর্বিবাহ কল্পনা করাও ছিল পাপ। তবে সময় বদলেছে। রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে।
১৮৫৬ সালে হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইন পাস হলেও এখনও রয়ে গেছে নারীর প্রতি রক্ষণশীল সেই দৃষ্টিভঙ্গি। এমনই একজন বিধবা নারী মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বিজলী গ্রামের মুক্তেশ্বর দেবনাথের মেয়ে টপি দেবনাথ।
এক বুক আশা নিয়ে সত্যেন্দ্র দেবনাথের গলায় মালা পরিয়ে স্বামীর আসনে বসান। স্বপ্ন ছিল স্বামীর সেবা করেই পার করবেন বাকী জীবন। কিন্তু হায় পোড়া কপাল! সুখ আর সইলো না। পাঁচ বছর পরই স্বামী মরিয়া বাঁচিলেন আর তাকে ভাসাইলেন অথৈ সাগরে।
তবুও হার মানেননি টপি দেবনাথ। সুখের আশায় দ্বিতীয় বিয়েও করেন। কিন্তু গ্রামের মোড়লদের চক্ষুশূল হয়ে যান তিনি। এরপর নেমে আসে একের পর এক অত্যাচারের বোঝা।
দ্বিতীয় বিয়ের কারণে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে একঘরে করে রাখা হয়েছে তাকে। তাতেই ক্ষান্ত হয়নি তারা। টপির স্বামীকেও ভয়ভীতি দেখিয়ে গ্রাম ছাড়া করেছে। এমনকি তাকে ও তার ছোট ছেলেকেও দেয়া হয় না সার্বজনীন পূজা পার্বনে অংশ নিতে। নিরুপায় হয়ে তিনি আইনী নোটিশ পাঠিয়েছেন গ্রামের মোড়লদের বিরুদ্ধে।
টপি দেবনাথের পরিবার জানায়, জুড়ি উজেলার দীঘলবাগ গ্রামের সত্যেন্দ্র দেবনাথের সঙ্গে টপির বিয়ে হয়। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় এক ছেলে রেখে স্বামী মারা যান।
শ্বশুড়বাড়ির অত্যাচার সহ্য করে কিছুদিন থাকলেও ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিকাশ মিত্রকে বিয়ে করে বাবার বাড়িতে উঠেন টপি। কিন্তু বিধিবাম সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ থাকায় নিজের কাকাতো ভাই ও গ্রাম্য মোড়লদের আপত্তির মুখে পড়েন তিনি ও তার বাবার বাড়ির লোকজন।
টপির মা প্রণতী রানী দেবনাথ বাংলামেইলের জানান, সমাজকে না জানিয়ে ও বিধবা অবস্থায় বিয়ে করায় টপি ও তাদের পরিবারকে একঘরে করে রাখা হয়। ভয়ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয় দ্বিতীয় স্বামীকে। আর তাকে চাপ দেয়া হয় শাখা সিঁদুর ফেলে দিতে। বন্ধ করে দেয়া হয় সামাজিক আচার অনুষ্ঠান ও পূজাপার্বনে যাতায়াতও। এ অবস্থায় মানসিকভাবে তারা ভেঙে পড়েছেন। অন্যদিকে বিপাকে পড়েছেন টপির একমাত্র ভাই প্রাণেশ দেবনাথ। বোনকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার জন্য মোড়লদের চাপও রয়েছে তার ওপর।
টপি দেবনাথ জানান, গত পাঁচ বছর ধরে বখাটেদের টিটকারী সহ্য করে দর্জির কাজ করে কোনো রকমে জীবনযাপন করছেন তিনি। তবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনিও। তার ছেলে সুমিত দেবনাথ বড় হচ্ছে। সে এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।
একঘরে থাকার কারণে তার ছোট ছেলের সঙ্গে গ্রামের লোকজন খুব একটা কথা বলে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে তার ভাইয়ের জন্য বিয়ের কোনো প্রস্তাবও আসবে না। এ অবস্থায় নিরুপায় হয়ে তিনি গ্রাম্য মোড়ল বিশ্বজিৎ দেবনাথ, রঞ্জিত শর্মা, হীরা লালা দেবনাথ ও কাকাতো ভাই অধির দেবনাথের বিরুদ্ধে মানবাধিকার কমিশনের মাধ্যমে আইনী নোটিশ পাঠিয়েছেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট কিশোরী পদ দেব শ্যামল বাংলামেইলকে জানান, মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে গ্রাম্য মোড়লদের কাছে বিষয়টি জনতে চাইলে তারা টপি ও তার পরিবারকে দোষারোপ করেন। গ্রাম্য শালিসে না যাওয়ায় তাদের সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে নিষিদ্ধ করা হয় বলে স্বীকার করেন তারা। তবে মানবাধিকার কমিশন তাদের চাপ দিয়েছে বিষয়টি দ্রুত সমাধানের জন্য। যদি সমাধান না হয় তাহলে কমিশন টপির হয়ে গ্রামের মোড়লদের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চালিয়ে যাবে বলেও জানান তিনি।
তবে গ্রামের প্রধান মোড়ল বিশ্বজিৎ দেবনাথ জানান, তারা টপিকে একঘরে করেননি। গ্রামের কাউকে না জানিয়ে বিধবা অবস্থায় বিয়ে করায় তাকে পঞ্চায়েতের শরণাপন্ন হতে বলা হয়। কিন্তু তারা না গেলে সাবেক এক ইউপি সদস্য (বর্তমানে প্রয়াত) নির্দেশ দেন, আমরা যেন তাদের সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে না ডাকি। (সূত্র-বাংলামেইল)