জাতীয়

রোহিঙ্গা সংকট: আমরা আশাহত, জাতিসংঘকে প্রধানমন্ত্রী

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধান চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন শুরু না হওয়া এবং সংকট সমাধানে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যকর কিছু করতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আশাহত।’

শুক্রবার (২৮ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টার দিকে নিউইর্য়কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনের ভাষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তচ্যূত ও অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশার স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে গত বছর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আমি পাঁচ-দফা প্রস্তাব পেশ করেছিলাম।’

‘আমরা আশাহত হয়েছি, কেননা আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্থায়ী ও টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ। প্রথম থেকেই আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।’

‘তবে, মিয়ানমার মৌখিকভাবে সব সময়ই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে বলে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তারা কোনো কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের যে চুক্তি হয়েছে আমরা তারও আশু বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতা দেখতে চাই। আমরা দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।’

তিনি বলেন, ‘যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব হয়েছে মিয়ানমারে তাই এর সমাধানও হতে হবে মিয়ানমারে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের যে বিবরণ জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাতে আমরা হতভম্ব।’

‘আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার ও অবিচারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশাকে আমরা যেমন অগ্রাহ্য করতে পারি না, তেমনি পারি না নিশ্চুপ থাকতে।’

‘বিশ্বব্যাপী বিপুলসংখ্যক নিপীড়িত ও রোহিঙ্গাদের মতো নিজ গৃহ থেকে বিতাড়িত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আমার হৃদয়কে ব্যথিত করে। এ জাতীয় ঘটনাকে অগ্রাহ্য করে শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য ও টেকসই সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।’

শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের কষ্টকর জীবনযাপনের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে অবস্থানরত ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমরা সাধ্যমতো তাদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, শিশুদের যত্নের ব্যবস্থা করেছি।

এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসি-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার সহানুভূতি এবং সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান তিনি।

সবার সহযোগিতা চেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, মাতৃভূমিতে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত সাময়িকভাবে রোহিঙ্গাদের জন্য মানসম্মত ও স্বাস্থ্যসম্মত বসবাসের পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রেখে আমরা নতুন আবাসন নির্মাণের কাজ শুরু করেছি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। একইসঙ্গে রোহিঙ্গারা যাতে দ্রুত তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারে তার জন্যও আমি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা চাচ্ছি।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়া এবং বিদেশে অবস্থানের কারণে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর আমাকেও দীর্ঘ ছয় বছর দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি। আমরা দু’বোন শরণার্থী হিসেবে বিদেশে অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাই আপনজন হারানো এবং শরণার্থী হিসেবে পরদেশে থাকার কষ্ট আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারি।

বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদসহ সব অপরাধের বিরুদ্ধে

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা পুনরুল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও সফলতার কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদসহ সব সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থবিরোধী কোনো কার্যক্রম বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমরা পরিচালিত হতে দিব না। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আমাদের ‘ জিরো টলারেন্স’ নীতি অব্যাহত থাকবে।

তিনি বলেন, সহিংস উগ্রবাদ, মানবপাচার ও মাদক প্রতিরোধে আমাদের সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করার নীতি বিশেষ সুফল বয়ে এনেছে।

শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশি সদস্যদের অবদানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অধীনে ৫৪টি মিশনে এক লাখ ৫৮ হাজার ৬১০ জন শান্তিরক্ষী পাঠানোর মাধ্যমে বিশ্বশান্তি রক্ষায় বিশেষ অবদান রেখেছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের ১৪৫ জন শান্তিরক্ষী জীবনদান করেছেন।

তিনি বলেন, বর্তমানে ১০টি মিশনে ১৪৪ জন নারী শান্তিরক্ষীসহ বাংলাদেশের মোট সাত হাজারের অধিক শান্তিরক্ষী নিযুক্ত রয়েছেন। আমাদের শান্তিরক্ষীরা তাদের পেশাদারিত্ব, সাহস ও সাফল্যের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।

ফিলিস্থিনে অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনে আমরা মর্মাহত

ফিলিস্থিন সমস্যার দ্রুত সমাধান দাবি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভ্রাতৃপ্রতীম ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন আজও অব্যাহত রয়েছে যা আমাদের মর্মাহত করে। এ সমস্যার আশু নিষ্পত্তি প্রয়োজন।

তিনি বলেন, ওআইসি-র পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে আমরা ওআইসি-র মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাব।

শেখ হাসিনা বলেন, মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে তিনটি মৌলিক উপাদান বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, তা হলো- শান্তি, মানবতা ও উন্নয়ন। তাই মানব সমাজের কল্যাণে আমাদের মানবতার পক্ষে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।

বাংলাদেশ বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে আমি নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছি। গত সাড়ে নয় বছরে আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশ বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে।

তিনি বলেন, যে বাংলাদেশকে বলা হত দুর্যোগ, বন্যা-খরা-হাড্ডিসার মানুষের দেশ, তা এখন বিশ্বশান্তি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ তার দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশিদের ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের পথচলা এখনও শেষ হয়নি। এ পথচলা ততদিন চলবে, যতদিন না আমরা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা এবং শোষণমুক্ত সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারব।

প্রধানমন্ত্রী অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেনিটেশন, বনায়ন, যোগযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটালাইজেশন-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও সফলতার কথা তুলে ধরেন। (বাংলা নিউজ)


বার্তা কক্ষ
সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৮

Share