Home / সারাদেশ / যে কারণে স্থগিত ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানো কর্মসূচি
Child eat vitamin a

যে কারণে স্থগিত ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানো কর্মসূচি

সময় ঘোষণার এক সপ্তাহের মাথায় স্থগিত করা হয়েছে দেশজুড়ে অনুষ্ঠিতব্য ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন। ক্যাম্পেইন সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুলের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা, ক্যাপসুলোর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভাব, ক্যাপসুলে ছত্রাকের বিস্তার ও শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি— এই চার কারণ বিবেচনায় নিয়ে ক্যাম্পেইনটি স্থগিত করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান কিশোরগঞ্জে ভিটামিন এ প্লাস ক্যাপসুলের নমুনা পর্যবেক্ষণের সময় বলেছেন, ‘ক্যাপসুলের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন স্থগিত করা হয়েছে।’

প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘আদালতে মামলা করে ভারতীয় ওই অখ্যাত কোম্পানি নিম্নমানের ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাপসুল কিনতে আমাদের বাধ্য করেছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ক্যাপসুলের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।’

ডা. মুরাদ হাসান বলেন, ‘‘ভারতীয় ওই কোম্পানির কোনো সুনাম নেই। মামলা করে তারা আমাদের ‘এ’ ক্যাপসুল কিনতে বাধ্য করেছে। লাল ক্যাপসুল নিয়ে কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। কেনো এ রকম হলো পরীক্ষার পর তা বলা যাবে। তবে দেশীয় কোম্পানি থেকে কেনা সবুজ রঙের ট্যাবলেটে কোনো সমস্যা নেই।’

স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সরবরাহ করা এসব ক্যাপসুল কৌটায় একটার সঙ্গে আরেকটার সঙ্গে লেগে আছে। আলাদা করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হয়েছে, পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পেইন শুরুর তারিখ ঘোষণা করা হবে। ক্যাপসুলের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এরইমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠন করা কমিটিকে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বলছেন, ক্যাম্পেইনের বিষয়টি হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আরও আগে কেন ক্যাপসুলগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো না, সে বিষয়েও প্রশ্ন তুলছেন তারা।

প্রসঙ্গত, এবার ২ কোটি ২০ লাখ শিশুকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কথা ছিল। জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচির আওতায় দেশজুড়ে ৬ থেকে ১১মাস বয়সী ২৫ লাখ শিশু এবং ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের নীল ও লাল রঙের ক্যাপসুল খাওয়ানোর কথা ছিল।

বৃহস্পতিবার (১৭ জানুয়ারি) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করার থাকলেও ক্যাপসুল নিয়ে অভিযোগ ওঠার কারণে সে সংবাদ সম্মেলন বাতিল করে মন্ত্রণালয়। এর আগে গত বুধবার (১৬ জানুয়ারি) প্রথম সারাবাংলা ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন স্থগিত হওয়ার সংবাদ প্রকাশ করে।

সেদিন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডা. মো. ইউনুস বলেন, ‘আমাদের প্রায় আড়াই কোটি বাচ্চাকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। এটা বাচ্চাদের জীবনের একটা বিষয়, তাই এ বিষয়ে কোনো রিস্ক আমরা নিতে পারি না। মাঠ পর্যায়ে তিন-চার জায়গা থেকে অভিযোগ এসেছে, লাল ক্যাপসুলগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে গেছে। ফলে ওষুধের মান নিয়ে সন্দেহ জন্ম নিয়েছে।’

এমনিতেই বিভিন্ন ভিটামিন ক্যাপসুল নিয়ে বাবা-মায়েদের মধ্যে ভীতি কাজ করে, এবারে সে কার্যক্রম স্থগিত করাতে মানুষের মধ্যে সে ভীতি আরও বেড়ে যাবে এবং ভীতি দূর করতে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান কোনো উদ্যোগ নেবে কি না, জানতে চাইলে শুক্রবার (১৮ জানুয়ারি) ডা. মো. ইউনুস বলেন, ‘মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। কর্মসূচি স্থগিত হওয়ার বিষয়টি তারা যেমন জানেন, তেমনি জানেন কী কারণে স্থগিত করা হয়েছে। কোনো শিশুর জীবনের যেন ক্ষতি না হয় সে জন্যই এ সিদ্ধান্ত-তাই আমার মনে হয় না বাবা-মায়েরা আতঙ্কে থাকবেন।’

সেদিন পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মূলত লাল রঙের ক্যাপসুলগুলোতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেগুলোতে ছত্রাক দেখা দিয়েছে এবং একটির সঙ্গে আরেকটি লেগে ছিল। যার কারণে মাঠ পর্যায় থেকে কর্মীরা অভিযোগ জানায়। দেশের থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা থেকে এ অভিযোগ জানানোর কারণেই মূলত কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।’

এর আগে ১৪ জানুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অ্যাডভোকেসি সভায় ঘোষণা দেওয়া হয়, আগামী ১৯ জানুয়ারি সারাদেশে ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন শুরু হবে।

ওই সভায় সভাপতির বক্তব্যে ডিএসসিসি‘র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শেখ সালাহউদ্দিন বলেন, সাধারণত বছরে দুইবার জুন ও ডিসেম্বর মাসে ভিটামিন-এ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয়। তবে নির্বাচনের কারণে গত বছর ডিসেম্বর মাসের ক্যাম্পেইন ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে পরিচালনা করা হবে।

সভায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ৬ থেকে ১১ মাস বয়সী প্রায় ৪৭ হাজার শিশু এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী সোয়া ৩ লাখ শিশুকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যৌথভাবে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করবে দুই সিটি করপোরেশন ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান।

ঢাকা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে মোট ৮ লাখ শিশু ভিটামিন এ ক্যাপসুলের ঘাটতিতে রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কনসালটেন্ট ও ঢাকা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. ফয়জুল কবির রুমি জানান, ‘২১ হাজার মানুষের ওপর চালানো এক তাদের শেষ গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের শতকরা ২৩ শতাংশ মানুষের শরীরে স্বাভাবিক মাত্রায় ভিটামিন এ রয়েছে। স্বল্প অভাবে ভুগছে ৫৬ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু, মাঝারি অভাবে ভুগছে ২০ শতাংশ এবং মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ শিশু। অর্থাৎ দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ৮ লাখ শিশু ভিটামিন এ জনিত মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।’ তবে বর্তমানে মারাত্মক ঝুঁকির সংখ্যা কিছুটা কমে এসেছে বলেও জানান তিনি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৬ সালে এই ক্যাপসুল কেনার কাজ শুরু হয়। তখন প্রথমে একটি দেশি ওষুধ কোম্পানিকে ক্যাপসুল সরবরাহের কাজ দেওয়া হলে একটি বিদেশি কোম্পানি আদালতে হয় সরবরাহ কার্যাদেশের বিরুদ্ধে। আদালত পরে সে বিদেশি কোম্পানিকে সরবাহের কাজ দেওয়ার নির্দেশ দিলে ভারতীয় অ্যাজটেক নামের একটি প্রতিষ্টান এ ক্যাপসুল সরবরাহ করে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কনসালটেন্ট ও ঢাকা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. ফয়জুল কবির রুমি বলেন, ‘ভিটামিন এ যে শুধু অপুষ্টিজনতি অন্ধত্ব থেকে শিশুদের রক্ষা করে তাই নয়, ভিটামিন এ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ডায়রিয়ার ব্যাপ্তিকাল ও জটিলতা কমায় এবং শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি কমায়।’

হঠাৎ করে তারিখ স্থগিত করার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে এটা স্থগিত করা ঠিক হয়নি । এই তারিখ তো নিশ্চয় অনেক আগেই নির্ধারণ করা ছিল। ক্যাপসুলগুলো আগে থেকেই দেখে একটা জায়গায় পৌঁছার কথা। বিষয়টিতো এরকম না যে ওষুধগুলো কালকেই সাপ্লাই হয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা শিশু হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, এমনিতেই আমাদের এসব ক্যাপসুল খাওয়ানো, টিকা দেওয়া নিয়ে বাবা-মায়েদের মধ্যে ভয় কাজ করে। এখন এই স্থগিত করা আরও ভীতির সঞ্চার করবে। যদিও ক্যাপসুল না খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত অনেক বড় সিদ্ধান্ত, কোনো শিশু যদি এই ক্যাপসুল খেয়ে মৃত্যুবরণ করত সেটা আরও ভয়াবহ বিষয় হতো। সে হিসেবে এটা মন্দের থেকে ভালো।

এর আগে ২০১২ সালে একবার ভিটামিন এ ক্যাপসুল নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়, যদিও তখন ক্যাপসুলের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি।

বার্তা কক্ষ
১৯ জানুয়ারি,২০১৯

Leave a Reply