Home / ফিচার / শনিবারের শনির দশা : সহনীয় মাত্রার অসহনীয় যন্ত্রণা!
Hai rommo

শনিবারের শনির দশা : সহনীয় মাত্রার অসহনীয় যন্ত্রণা!

শনিবারের শনির দশা উপ-শিরোনামে সহনীয় মাত্রার অসহনীয় যন্ত্রণা নামে একটি রম্য রচনা লিখেছেন উপ-সচিব মোহাম্মদ আবদুল হাই।
চাঁদপুর টাইমস পাঠকদের জন্যে তা তুলে ধরা হলো।

এ মূহুর্তে সারা জাতি সহনীয় মাত্রায় অসহনীয় পর্যায়ে আছে । পেঁয়াজের ঝাঁঝে এখন আর কারো অসহনীয়ভাবে অসহ্য রকম চোখে পানি পড়ে না। কারণ দেশি ধান্না পেয়াজের ঝাঁঝ ১৩০ টাকা বলে মিসরীয় লাস্যময়ী রমনী পেঁয়াজ ৮০ টাকা দামে দামে কেনা সহনীয় ছিলো আমার জন্য। কিন্তু রান্নার পর গিন্নির অসহনীয় ঝাড়ি খেয়ে বুঝলাম দেখতে লাস্যময়ী হলেও স্বাদেগন্ধে মিসরীয় পেঁয়াজ ফেরাউন-নমরুদের বংশধর বলে অপাংক্তেয়! বউয়ের অসহনীয় ঝাড়ি না খেয়ে অসহনীয় দামে দেশি পেঁয়াজ কিনে অনেক শান্তি। ঘরে শান্তি- আমার মনেও শান্তি! কেবল অশান্তি পকেটে।

তো সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বর্তমানে নসিহত( অজুহাত) হলো তারা নাকি সহনীয় মাত্রায় কিছু একটা জিনিস খেতে পারে যদিও অনেকে এর ধারে কাছেই নেই(!?) । কিন্তু বাজারে গেলে কোন দোকানদার আর সহনীয় থাকে না । তারা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়।

এক দোকানদারকে বললাম, দামটা একটু সহনীয় মাত্রায় রাখেন । স্যার; আপনেতো সরকারি চাকরি করে সহনীয় মাত্রায় খেতে পারেন কিন্তু আমরা পারি না। আমরা অসহনীয় দামে কিনি অসহনীয় দামে বেচি । না কিনলে সামনে হাটেন! তওবা, তওবা ! বলে কী ? সরাসরি মুখের উপর। চুপিসারে সামনে চলে গেলাম। সরকারি চাকরিজীবি আর ব্যবসায়ীদের জন্য যা হোক সহনীয় মাত্রায় ইনকামের সুযোগ আছে(নাই!) । কিন্তু আমজনতার কি যে অসহনীয় হাল ! তারা পুরাই চরম অসহনীয় পর্যায়ে । বাজারে জিনিসের দামের অসহনীয় যন্ত্রণা আর সংসারের অসহনীয় বিবিধ খরচে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত এখন।

বাদ দেন আমজনতা !! আজ নিজের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা আমজনতাকে শুধাবো। না শুনলে জোর করে অসহনীয় মাত্রায় শুধাবো। শুনলে সহনীয় মাত্রায় এককেজি দেশি পেঁয়াজ পাঠিয়ে দিবেন (সূত্র মোতাবেক!? বুজছেনতো ?)।

দুই ঘন্টা অসহনীয় যানজটের ভয়ে তিন ঘন্টা আগে প্রতিদিন ঘুম হতে উঠে যথাসময়ে অফিসে উপস্থিত হয়ে রাতে বাসায় ফিরে শরীরের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তাই সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার সকালেও নাক ঢেকে একটু ঘুমের ঘাটতি পূরণের খায়েসে যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন তখন কার যেন অসহনীয় চিৎকারে ঘুমের তেরোটা বেজে গেল !

চিৎকারটা ছিলো এরকম, “অসহ্য! সকাল আটটা বাজে। তিনার উঠার খবর নাই! সারাদিন টেং টেং করে রাত নয়টায় বাসায় আসে । ঘরে বাজার সদাই আছে কিনা খোঁজ খবর নাই । উঠো! বাজারে যাও ! লিস্ট করে দিছি” । বললাম,: একটু আদর করে সহনীয় মাত্রায় বললে তো পারো!” জবাব এলো” হুম ঢং কতো ! সহনীয় মাত্রায় আদর! বুঝছি তোমাদের এখন সহনীয় মাত্রার রোগে আছর করছে-তাই না? কোন সহনীয় মাত্রা-টাত্রা চলবে না! জলদি বাজারে যাও। জুমার নামাজ পরে খেতে চাইলে দশটার মধ্যে বাজার নিয়ে আসবা।”

কি আর করা । গিন্নির অসহনীয় ভালোবাসার লিস্ট নিয়ে বাজারে গেলাম । কি কি কিনলাম তা না বলাই ভালো । তবে শুক্রবারে গরুর মাংস আর সালাদ যে আমার আজন্ম প্রিয় তা না বলে পারছিনা । তাই সালাদের জন্য ক্ষীরা, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, লেটুসপাতা,লাল টমেটো, পেঁয়াজ, গাজর, পুদিনা পাতা, সরিষার তেল ও লবন নিশ্চিত করা হলো । অবস্য সালাদ স্পেশালিস্ট হিসেবে সংসারে আমার আলাদা একটা সম্মান আছে । ইচ্ছা করলে যাচাই করে দেখতে পারেন।

কেনা কাটা শেষে দেখি পকেটের অসহনীয় যন্ত্রণা। জিনিস কিনতে কিনতে পকেটের একটু একটু লুজ মোশন হয়ে এখন খালি! তিরিশ টাকা রিক্সা ভাড়া বাসায় এসে গেটের দারোয়ান হতে হাওলাত করে দিলাম যা পরে পঞ্চাশ টাকা নোট দিয়ে অতিরিক্ত বিশ টাকা খুশি মনে দারোয়ানকে চা খেতে গচ্ছা দিলাম।

দুপুর এগারোটায় বাসায় এসে গিন্নিকে সব বুঝিয়ে দিলাম। বললাম, গরুর মাংসটা ভালো করে রান্না করবা । ঝোল টানা টানা হবে। যেমন যৌবন কালে তোমার চোখের মতো! আমি নামাজ পড়ে এসে সালাদ বানাবো ।

মসজিদে গিয়েও সত্যি কথা শান্তি নাই। মন বাসায় আর গরুর মাংস ও সালাদের মধ্যে! দুই রাকাত ফরজ শেষে ইমামের সাথে জীবিত-মৃত, ইহকালে-পরকালে চৌদ্দ গোষ্ঠীসহ সবার জন্য জান্নাতুল ফেরদাউসের দোয়া করে সোজা বাসায় পৌঁছে গেলাম। অত্যুৎসাহে সালাদ বানানোর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া দেখে গিন্নি বললো ” লাভ নাই” । বললাম ” লাভ (ভালোবাসা) পরে, আগে খানাপিনা”। উত্তর আসলো ” কোন লাভ নাই , গরুর মাংস রাঁধিনি। দেরি করে বাজার আনছো, দেখে মনে হয় বুড়া গরুর মাংস! তাই আলু ভর্তা আর ডাল । খেয়ে নাও , বহুৎ কাজ আছে”।

হায়রে কপাল ! মাংস ছাড়াও শীতের এতো সবজি কিনলাম । রাঁধলো না ! কিল্লাই যে, গ্রামের ছেলে হড়ালেকা করে চাকরি নিয়ে শহরে আইলাম! মার রান্নার কথা মনে পড়ে গেল। ছোটকালে নিজেদের ক্ষেতে কত ধরণের সবজি চাষ করতাম । সকালে এক খাচি বিভিন্ন সবজি জমি হতে এনে দিতাম ।

একটা কই বা টাগি মাছ দিয়ে তেল মেরে কি যে মজার রান্না করতো মা! রান্নার সময় চুলার পাশে বসে থাকার স্মৃতি ও সুখ এখনকার কোন পাঁচ তারকা হোটেলে পাওয়া যায় কিনা সন্দিহান আমি । মা রান্নার পর পরই থালায় ঢেলে যে কয়েক চামচ তরকারি দিতো তা ছিল অমৃত । কেবল স্মৃতিতে ভাস্বর ব্যক্তি এটা উপলব্ধি করতে পারবে । বর্তমান শহরে প্রজম্মের কাছে এটি হলো “মম, আমি চিকেন ছাড়া কিছু খায়না” উক্তির মতো । যাকগে সে সব কথা। শৈশব স্মৃতি কেবল দু:খ বাড়ায়! কারণ আমি যে নারকেল চোর !(নিজের গাছের!)।

ডাল আর আলু ভর্তা সাথে পুরোনো তরকারি দিয়ে খেয়ে নিলাম । খেয়ে আবারো শুয়ে পড়লাম। শীতকালে দুপুরের ঘুম কি যে আরামের! গভীর ঘুমে যখন আচ্ছন্ন, তখনই ঘুমের আঠারোটা বাজিয়ে ডাক পড়লো ” উঠেন মশাই; বলছিনা কাজ আছে ! ৩০০ ফিট যাবো”। চোখ মুছতে মুছতে বললাম,” কি হয়েছে! আমি আমিতো সাড়ে পাঁচ ফিট আর আধা ফিট। তিনশো ফিট কোথায় পেলে?” । তোমার মাথা। উঠো ; পূর্বাচল ৩০০ ফিটে যাবো । সপ্তাহে একদিন অন্তত: দুইজনে বাইরে খাবো । তাছাড়া একটু ঘুরাফিরা হবে- রিক্রিয়েশনও হবে”।

হুম, এবার বুঝলাম, সাধের গরুর মাংস কেন বুড়া হলো ! অনেকেই জানেন, আমি স্ত্রৈণ! তাই , ক্লিন শেভ করে, সেন্ট মেরে বউয়ের নির্দেশিত অলংকার (পোশাক) পরে বিকেল চারটায় যাত্রা দিলাম । বউও আমার সাথে কালার ম্যাচিং করে করে ড্রেসআপ করেছে। বর্তমানে ঢাকা শহরে উবারে চড়া কি যে শান্তি! নামীদামি অনেক গাড়ি এখন উবারে।

ভাগ্য ভালো, একটা এলিয়ন গাড়িতে উবারে যাত্রা শুরু হলো । হালকা আলাপচারিতা কিংবা ফেসবুকে যার যার মতো পোস্ট দেখা, লাইক কমেন্টস চলছে । সেগুনবাগিচা হতে রামপুরা ব্রীজে যেতে অন্ধকার! জ্যাম আর কাকে বলে ! বউয়ের মেজাজ গরম। সামনে অন্ধকার, কুল কিনারা নেই । এক সময় বউ বললো আর যাবো না । নামো । হাতির ঝিলে ঘুরবো। তোমাদের মতো আমলাদের কারণেই রাস্তায় এতো জ্যাম। বুঝলাম না জ্যামের সাথে আমলার কী সম্পর্ক!! ব্যস, খুশি মনে নেমে গেলাম। দুইজনে হেঁটে হেঁটে হাতিরঝিল ঘুরলাম, চটপটি-ফুসকা খেলাম; বাদাম, চিপসসহ আরো হাবিজাবি অনেক কিছু খেলাম। রাতের হাতিরঝিলের মৌহনীয় সৌন্দর্য উপভোগ করে বাসায় আসলাম। এতো সুন্দর করে হাতিরঝিল বানানোর জন্য সরকার বাহাদুরকে আমজনতার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।

যাক, রাত দশটায় বাসায় ফিরে না খেয়ে ফ্রেশ হয়ে টিভি দেখতে দেখতে আর ফেসবুকে উঁকিঝুঁকি মারতে মারতে ঘুমিয়ে গেলাম। অন্তত এবার আরামসে ঘুমোতে পারবো । বউ এটা নিশ্চিত করলো। রাতে আর ডিস্টার্ব করবে না। মহাসুখে ঘুমিয়ে গেলাম।

কিন্তু বিধি বাম! রাত তিনটা বাজে । কেউ ঢাকেনি । নিজের পেট মোচড় দিয়ে ডাক দিলো! উঠে বাথরুমে গেলাম। লিকুইড বজ্য নিষ্কাশন ! প্রথম দিকে সহনীয় মাত্রায় ছিলো । তাই বউকে ডাকিনি । কিন্তু রাত পাঁচটার মধ্যে বিষয়টি অসহনীয় মাত্রায় চলে গেল ! এখন আমার অসহনীয় ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা! আর পারি না!

গিন্নি স্বয়ং এমবিবিএস ডাক্তার। তাকে উঠালাম । কিছু বলার আগেই বলে বসলো” পঁচা চটপটি খাইয়ে বউকে ঠকিয়ে আর টাকা বাঁচাবানি বলো?? তার মানে সে এতক্ষণ বাথরুমে গমনাগমন সব দেখেছে ! বললাম, সরি ! এখন থেকে যা তোমার পছন্দ তাই খাবো । বললো, টেবিলে ওরস্যালাইন আছে । সাথে একটা ফ্ল্যাজিল ট্যাবলেট খেয়ে নিও । ভালো হয়ে যাবে যদি তোমার নিয়্যত ভালো থাকে!

আহারে কপাল ! হায়রে কপাল ! একদিকে পেটে অসহনীয় মাত্রায় যন্ত্রণা, আরেকদিকে বউয়ের অসহনীয় খোঁচা। কেউ আর আমার প্রতি সহনশীল হলো না! আমি সংসারে সহনশীল মাত্রার বুঝি আর দেখা পাবো না?

লেখক- প্রাক্তন এডিসি ও ডিডিএলজি, চাঁদপুর।
বর্তমানে ডেপুটি প্রজেক্ট ডাইরেক্টর(স্মার্ট কার্ড),
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, ঢাকা

: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১:০০ এএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার
ডিএইচ