ডাক নাম মিস পলি। শরীরে পুরোপুরি নারী না হয়ে উঠলেও তিরিশ বছর বয়সী তৃতীয় লিঙ্গের পলি এখন মনেপ্রাণে নারী।
নানান চড়াই-উৎরায় পেরিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছেন তিনি। তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। চেষ্টা করছেন কমিউনিটির লোকজনকে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসতে।
পলির বাড়ি নগরীর কোর্ট মোল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তার বাবার নাম হারুন অর রশিদ। মায়ের নাম জরিনা বেগম। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় পলি। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন পলাশ আহমেদ। কিন্তু শৈশব থেকেই নিজেকে মেয়ে হিসেবেই ভাবতেন পলি। আর এজন্য বাল্যকাল থেকেই তার মাকে বাঁকা কথা শুনতে হয়েছে।
তার ভাষ্য, শৈশবেই তিনি নিজের ভেতরে নারী সত্ত্বা আবিষ্কার করেন। যখন তার বয়স ছয় কিংবা সাত, তখন থেকেই নিজেকে নারী ভাবতে শুরু করেন তিনি। ওই সময় থেকেই লুকিয়ে মেয়েদের সাজ ও পোশাক পরতেন। এড়িয়ে চলতেন ছেলেদের। এ নিয়ে বাবা-মায়ের বকুনি এমনকি মারও খেতে হয়েছে।
বাবা-মা চেয়েছিলেন ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। ভর্তি করিয়েছিলেন নগরীর দারুশসালাম আলীয়া মাদরাসায়। সেখানে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখাও করেছেন তিনি। কিন্তু শিক্ষক-সহপাঠিদের বাঁকা দৃষ্টিতে বাধ্য হন মাদরাসা ছাড়তে।
এনিয়ে ওই সময় পরিবারও পড়ে যায় চরম বিপাকে। চারদিকে শুরু হয় কানাঘুষা। বাবা পড়াতে আগ্রহী ছিলেন না একেবারেই। কিন্তু একমাত্র মায়ের জোরে বাবা ভর্তি করেন কাশিয়াডাঙা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ২০০৬ সালে পাস করেন এসএসসি। ততদিনে নিজেকে আবিষ্কার করেন নারী হিসেবে। কিন্তু তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার। শিকার হতে হয় নির্যাতনের।
শেষে বাড়িতে থেকে পালিয়ে ঢাকার মিরপুর-১২ এক আত্মীয় বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। সেখানে ছিলেন ৩ মাস ১৪ দিন। এরপর মায়ের অসুস্থতার খবরে ফিরে আসেন বাড়িতে। বাড়িতে ঠাঁই হলেও দৃশ্যপট বদলায়নি। এরই মাঝে নগরীর কোর্ট কলেজে ভর্তি হন এইচএসসিতে। তখনই যুক্ত হন তৃতীয় লিঙ্গের জনগণকে নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনাকারী দিনের আলো হিজড়া সংঘে। প্রতিষ্ঠানটির কোর গ্রুপ ফ্যাসিলিটেটর হিসেবে চাকরি হয়ে যায়।
এরপর সমাজ ও পরিবারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। একই এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে শুরু করেন আলাদা বসবাস। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর সেই বাড়িতে ছিলেন তিনি। পুরো সময়জুড়েই তিনি তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। তাদের সমাজের মূল ধারায় ফেরাতে কাজ করেছেন। এরই অংশ হিসেবে ২০১৬ সালে কাজ শুরু করেছেন হস্তশিল্প নিয়ে। এতে কাজ করছেন তৃতীয় লিঙ্গের লোকজন ছাড়াও সমাজের অবহেলিত ও অনগ্রসর নারীরা। এখন তার কর্মী রয়েছেন সাড়ে ৩০০ জন। হস্তশিল্প বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছেন অন্তত সাড়ে ৭০০ জনকে। এদের অনেকেই আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
তিনি জানান, মাত্র ৮ হাজার টাকা নিয়ে পলি এ উদ্যোগ শুরু করেন। এখন তার মূলধন ১০ লাখ টাকা। প্রতি মাসে এ থেকে তার আয় ৪০ হাজার টাকা। এছাড়া রয়েছে ছোট দুগ্ধ খামার। সেখান থেকে বছরে আয় হয় এক লাখ টাকার মতো।
সময় বদলে গেছে। পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলেছে। নিজ অবস্থানে সফলতাও পেয়েছেন তিনি। ভাড়া বাড়ি ছেড়ে গিয়ে উঠেছেন বাবার বাড়িতে। ছোটভাই রাসেল আহমেদ বাবার পরিবহন ব্যবসা দেখাশোনা করেন। তার আলাদা সংসার। ছোটবোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে।
এখন বাবা ও মাকে সঙ্গে নিয়ে আলাদা সংসার গড়েছেন পলি। তিনিই এখন বাবা-মায়ের মেয়ে। মেয়ে হিসেবে পরিবার এমনকি আত্মীয়-স্বজনও দেখেন তিনি। সবার ভরসার কেন্দ্র হয়ে উঠেছেন তিনি।
নারী হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন পলি। ২০১৭ সালে জেলায় শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোগে জীবন শুরু ক্যাটাগরিতে এ সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। ২০১৮ সালে জাতীয় পর্যায়ে ওয়ার্ল্ড অব দ্য ওমেন ওয়ার্ড অর্জন করেছেন। এছাড়া গত বছর অর্জন করেছেন হিউমেনিটেরিয়ান অ্যাওয়ার্ড।
সমাজিক স্বীকৃতি পাওয়া নতুন উদ্যোমে কাজ করে যাচ্ছেন জয়িতা পলি। দায়িত্ব পালন করছেন রাজশাহী ভিত্তিক দিনের আলো হিজড়া সংঘের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে। এর বাইরেও নানান সামাজিক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন তিনি। বাকি জীবন মানুষের সেবায় এভাবেই নিজেকে বিলিয়ে দিতে চান পলি।(জাগো নিউজ)
বার্তা কক্ষ,৮ মার্চ ২০২০
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur