Home / বিশেষ সংবাদ / ‘মুক্ত হস্তে দান’ এর টাকা নিয়ে প্রতারণার ভয়ানক তথ্য ফাঁস
‘মুক্ত হস্তে দান’ এর টাকা নিয়ে প্রতারণার ভয়ানক তথ্য ফাঁস

‘মুক্ত হস্তে দান’ এর টাকা নিয়ে প্রতারণার ভয়ানক তথ্য ফাঁস

‎Monday, ‎13 ‎July, ‎2015  01:04:57 AM

চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক:

মানবিক কোনও যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে সাহায্য চাইলে এজন্য অপরিচিত মানুষ থেকে বেশিক্ষণ মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেন না।  আপনি যা বিশ্বাস করলেন তাই মেনে নিলেন। কিন্তু যখনি জানতে পারলেন না যা বিশ্বাস করেছেন তা পুরোপুরি সত্য নয়।

ভিডিওতে দেখতে পাবেন মানুষ বিশ্বাস করে মসজিদ-মাদ্রাসায় যে টাকা দেয়, সে টাকা কতটা মসজিদ মাদ্রাসায় যায়।

(ভিডিওটি দেখতে অসুবিধা হলে, ভিডিওটির নিচে পরে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পড়ুন)

ভিডিওটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তালাশ টিমের সৌজন্যে

প্রতিবেদন-

মানুষ হিসেবে শুধু মানবিকতার কারণে বিপদে পড়ার অথবা অন্য কোনো যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে বারবার সাহায্য চাইলে একজন অপরিচিত মানুষ থেকেও বেশিক্ষণ মুখ ফিরিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। মানুষের সরল অনুভূতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুঁজি করে জমজমাট ব্যবসা করছে প্রতারক চক্র। এই প্রতারক চক্র ছড়িয়ে আছে সারা বাংলাদেশে।

এরকম প্রতারক চক্রের মুখোশ খুলে গেছে শুক্রবার প্রচারিত সংবাদ ভিত্তিক বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি-র অপরাধ ও দুর্নীতি অনুসন্ধান বিষয়ক অনুষ্ঠান তালাশ-এ।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাজধানীর দক্ষিণ বেগুন বাড়ির হাতিরঝিল মোড়ে রাস্তার পাশে চেয়ার-টেবিল রেখে হাতে মাইক নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন একজন। টেবিলের সামনে রাখা ব্যানারে লেখা ‘হযরত পন্থিশাহ (র.) কাছেমুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানা’।

সব প্রস্তুতি শেষে রাস্তায় যাতায়াতকারী পরিবহনের যাত্রী ও পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মাইক ব্যবহার করে আকুল আবেদন জানান তিনি। এমন আবেদনে মানুষ কেমন সাড়া দেয় বোঝার জন্য তালাশের ক্যামেরা যখন তাক করে রাখা হচ্ছিল, তখন লোকটি বেশ অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। তার চেহারায় ফুটে ওঠে একটা লুকোচুরি ভাব। শেষ পর্যন্ত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে চেয়ার থেকে ওঠে এসে বলেন, ‘আপনি ক্যামেরাটা নামান। আপনি প্রতিষ্ঠানে চলেন।’

নিজের পরিচয়পত্র বের করে দেখান হুমায়ুন কবির নামের ওই ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘এখানে টাকা তোলার দায়িত্বে আমি একাই। আমার সাথে আর কেউ নাই। আমি বেতন পাই ১২ হাজার টাকা।’

হুমায়ুন কবিরের সাথে কথা বলার পর একটু সামনে এগুতেই দেখা পাওয়া যায় এমনই আরেকজনের। যার নাম হাফেজ বুলবুল। সেও ‘হযরত পন্থিশাহ (র.) কাছেমুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানা’র জন্য টাকা তুলছেন। এটাই তার পেশা।

হাফেজ বুলবুল বলেন, ‘টাকা কালেকশন করি পাঁচ বছর ধরে। এই মাদ্রাসার জন্য তুলি দুই বছর। এর আগে তুলতাম মহাখালীতে। কমিশনে কাজ করি। একশত টাকা ওঠালে প্রতিষ্ঠানে দিতে হয় ৭০ টাকা আর আমি পাই ৩০ টাকা।’

হুমায়ুন কবিরের প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘উনিও কমিশন ভিত্তিতে কাজ করেন।’ বেতন ভিত্তিতে নাকি কমিশন ভিত্তিতে তারা কাজ করেন সংশয় দূর করতে ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, এ কাজ করছেন হুমায়ুন কিংবা হাফেজ বুলবুল ছাড়া আরও অনেকে।

মাদ্রাসা ও এতিমখানা পরিচালনা কমিটির সভাপতি বলেন, ‘ওরা মাদ্রাসায় সব টাকা দেয় না। প্রতিদিন ওরা ২০০-৪০০ টাকা দেয়। ওদের বেতন এরমধ্যেই। ৫০০-১০০০ টাকা তুলে মাদ্রাসায় দেয় এক-দুইশত টাকা। এদের ইনকাম ভাল, তাদের আর অন্য কাজ করা লাগে না।’

এদিকে মহাখালীর রেলগেটে বায়তুল মাহফুজ জামে মসজিদের কাছেই দেখা যায়, কিছু মানুষ অনেক বছর ধরেই এই মসজিদ ও মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য যানবাহনের যাত্রী ও পথাচারীদের কাছ থেকে দানের টাকা আদায় করেন।

টাকা দানকারী এক পথচারী বলেন, ‘দান করলে আখেরাতে ও দুনিয়াতে শান্তি পাওয়া যায়। এজন্যই দান করেছি। তাছাড়া মানসিকভাবে তৃপ্তি পাওয়া যায়।’

সে জায়গায় প্রতিদিন সাত থেকে আটজন দানের টাকা আদায় করেন। মসজিদ ও মাদ্রসার উন্নয়নে যারা এত পরিশ্রম করে কী পান এমন প্রশ্নের জবাবে ‘দান’ আদায়কারীদের একজন বলেন, ‘আমরা চাকরি করি। মাসে সাত হাজার টাকা বেতন এবং প্রতিদিন তিন বেলা খাবার দেয়।’

এমনকি দানের টাকা আদায়কারী ও দানকারীদের অনেকেই জানে না কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য টাকা তুলছেন বা টাকা দিচ্ছেন।
দান আদায়কারীদের আরেকজন বলেন, আমরা এতিমখানার জন্য টাকা তুলছি। এতিমখানার পুরা নাম আমি জানি না। আমি এখানে আজকেই আসছি।’ জানা গেছে, শুধু বড় অংকের টাকা দানকারীদের রশিদ দেয়া হয়।

বনানীর কাকলি ট্র্যাফিক সিগন্যালে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও মসজিদ ও মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য টাকা তোলেন কিছু মানুষ। তাদের নেতৃত্ব দেয় মজিবর রহমান নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘আমার দায়িত্বে সবাইকে নিয়ে মসজিদ-মদ্রাসার উন্নয়নের জন্য টাকা তুলি। আমাদের কিছু বেতন দেয় তা দিয়ে আমরা চলি।’

সেখানকার এক ভিক্ষুক অভিযোগ করে বলেন, ‘এরা এখানে টাকা তুলছে দশ বছর ধরে। এদের মসজিদ নাই।’

সিগন্যালে আটকে পরা গাড়ির যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে মজিবরের দল। কিন্তু তারা সবগুলো গাড়ির যাত্রীদের থেকে টাকা আদায় করতে পারে না। সিগন্যালের বাম পাশের দুই লেন মজিবরের দলের, বাকি এক লেন টোকাইদের, আরেক লেন ভিক্ষুকদের। কারো লেনে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। কেউ নিয়ম ভাঙলে মারামারির ঘটনাও ঘটে।

মজিবরের দলের একজনের নাম মোতালেব। মোতালেব বলেন, ‘আমরা ৪/৫ জন আছি। আমরা যে টাকা ওঠে সব ওখানে দেই। আর আমাদের বেতন দেয় ছয় হাজার টাকা।’

সাধারণ মানুষ থেকে তোলা এসব টাকা আসলে কোথায় যায়, এর উৎস অনুসন্ধানে ছদ্মবেশে তালাশ টিমের একজনকে ঢুকিয়ে দেয়া হয় মজিবরের দলে।

প্রথমে নিতে না চাইলেও পরে অনুরোধের ভিত্তিতে মুজাহিদ ছদ্মনামের ব্যক্তিকে দলে নেয় মজিবর। মুজাহিদকে সব নিয়ম-কানুন বুঝিয়ে দিয়ে তার হাতে একটি রশিদ বই ধরিয়ে দেয়া হয়। নিয়ম হলো প্রতিদিন যে যত টাকাই তুলুক মজিবরকে দিতে হবে ২ শত টাকা।

দেখা যায়, অন্যান্যদের চাইতে কম হলেও মুজাহিদ প্রথম দিনে ৫ শত টাকার মতো তুলতে পারে। রমজানের দ্বিতীয় দিন সকালে শুরু হয় মুজাহিদের দ্বিতীয় দিনের ডিউটি। সেসময় মুজাহিদকে উৎসাহ দিয়ে মজিবর বলেন, ‘খালি গাড়িগুলো মারেন। আজ টাকা তোলার দিন।’ কিন্তু দুপুরে রোজা রেখে কাজ করতে কষ্ট হচ্ছে ভেবে মুজাহিদকে রোজা ভেঙে ফেলার পরামর্শ দিয়ে মজিবর বলেন, ‘মানুষ কি তোমাকে দেখবে? কি জ্বালায় পড়ছি তোমাকে নিয়ে! কাল থেকে রোজা থাকা লাগবে না। আমি শিখিয়ে দিছি এটা আরেকজনের কাছে বলে দিবা? আমাকে সবাই পিটাবে। আমাকে তিন দিন রিমান্ডে দিবে।’

মজিবরের দলের আরেক সদস্য নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এটা হারামি। রমজান মাসে হারাম টাকা খায় ওরা। মসজিদ-মাদ্রাসার নামে এসব ভুয়া। কয়েকদিন পরপর পুলিশ এসে পিটিয়ে তুলে দেয়। পুলিশকে এক-দেড় লাখ টাকা দিয়ে আবার বসে।’

এদিকে মজিবরের দলের টাকা আদায়কারী নাঈম কাজের ফাঁকে মুজাহিদকে উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘তুমি দেড়-দুই শত টাকা জমা দিয়ে তুমি যা পাও, রোড থেকেই নিয়ে যাবে। বাটপার, ভুয়া, চাঁদাবাজ ও ধান্দাবাজ এসব তোমাকে বলবেই। অনেকে অনেক কথা বলবে, বাষট্টি স্তর চামড়া গায়ে লাগিয়ে এ কাজ করতে হবে। তাহলে জমা দিয়েও ১ হাজার টাকা নিয়ে যেতে পারবে। আমার চেয়ে তুমি বড় মৌলভি না। আমরা ধান্দাবাজ।’
মজিবরকে বনানীর ট্র্যাফিক সিগন্যালে উপার্জনের টাকার ভাগ দিতে হয় হকার থেকে শুরু করে মসজিদ-মাদ্রাসা কমিটির সদস্যদের। এরপর ছদ্মবেশী মুজাহিদকে সরিয়ে নিয়ে তালাশ টিম প্রকাশ্যে মজিবরের দলের সদস্যদের মুখোমুখি হয়।

ধরা খেয়ে মজিবরের দলের আবদুল মালেক বলেন, ‘ভুল করেছি। এটা নিজের কাছেও খারাপ লাগে। আমি অনুপায় হয়ে কোনো চাকরি না পেয়ে এ কাজ করি। দেশে আমাদের মতো মানুষদের জন্য কোনো কাজ নাই।’

দলনেতা মজিবরকে ধরা হলে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন মসজিদে ছয় শত টাকা যায়।’ একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে সে নিয়ে যায় মহাখালীর মোহম্মদীয়া জামে মসজিদে। সেখানে সাংবাদিকদের উপস্থিতি দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠেন মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাবেক সদস্য হাবিবুর রহমান। রাগন্বিত হয়ে তিনি বলেন, ‘খয়রাত করে টাকা উঠাই এটা যদি ঝামেলা হয়। যারা ইয়াবা বেঁচে, ফেন্সিডিল বেঁচে, বাবাসহ ধরা খায়, তাদের কী করবেন আপনি?’
এই হাবিবুর রহমানই মজিবরকে টাকা তোলার দায়িত্বে নিযুক্ত করেছেন। সেখানে গিয়ে মজিবর বলেন, ‘সপ্তাহে চার-পাঁচ হাজার টাকা এনে তাদের কাছে জমা দেই।’ সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়ে মসজিদ পরিচালনা কমিটির আরেক সদস্য বলেন, ‘মোটেও না। সপ্তাহে আমি তিন হাজার টাকা করে পাই। মাসে ১২-১৫ হাজার টাকার হিসাব আমাদেরকে দেয় তারা। এখন তারা যদি দুর্নীতি করে দায়ী থাকবে আল্লাহর কাছে।’

মসজিদ বা মাদ্রাসার নামে এভাবে টাকা তোলার ঘটনা কিন্তু থেমে নেই। দিনের পর দিন এই কাজ করছে প্রতারক চক্ররা। আর প্রতারক চক্রের এসব ঘটনার কারণেই হয়তো বছরের পর বছর একই জায়গায় টাকা তুলেও মসজিদ-মাদ্রাসার উন্নয়নের কাজ শেষ হয় না।

চাঁদপুর টাইমস : ডিএইচ/২০১৫।

চাঁদপুর টাইমস প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না