কংক্রিটের যতগুলো আকাশচুম্বী প্রাসাদপম অট্টালিকা মানুষের দৃষ্টি হরণ করে সে সকল প্রাসাদের প্রতিটি দেয়ালের গাঁথুনিতে যেমনিভাবে ইট, পাথর, সিমেন্ট, বালু, চুন ও সুরকির মিশ্রন ব্যবহার হয়েছে তেমনিভাবে মিশ্রিত হয়েছে শ্রমিকের ঘাম ও রক্ত।
শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রম আমাদেরকে দিয়েছে বিলাসবহুল বাসস্থান। যে খাদ্য তৃপ্তিসহকারে আহার করে আমরা বেঁচে আছি কিংবা পুষ্টি সঞ্চয় করছি সেই প্রতিটি শস্যকণা উৎপাদনে শ্রমিককে কখনো প্রখর রোদে শরীরে পোড়াতে হয়েছে কিংবা নির্ঝর বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে সকাল-সন্ধ্যা।
আমাদের লজ্জা নিবারণ ও সৌন্দরর্য্যমন্ডিত হতে যে পোশাক পরিধান করে আছি তা তৈরিতে কত শত শ্রমিকের হাতে অসংখ্য ফোসকা সৃষ্টি হয়েছে কিংবা সুঁইয়ের গুঁতা লেগেছে তার হিসাব কি কখনো করেছি? আমাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে কিংবা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যারা দিবানিশি নির্ঘুম কাটায় তাদের সুখ-দুঃখের খবর কতটুকু জানি? যাদের কল্যাণে বাসস্থান পেয়েছি, মুখে আহার তুলতে পারছি, লজ্জা নিবারণ করে সভ্য মানুষ সেজেছি-সেই তারা কেমন আছে তা জানা কি আমাদের দায়িত্ব নয়।
তারা আশ্রয় পেয়েছে কিনা, পেট পুরে দু’বেলা আহারের সংস্থান হয়েছে কিনা কিংবা ন্যূণতম বস্ত্র পরিধানের নিশ্চয়তা পেয়ে শীত ও বর্ষার প্রকোপ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারছে কিনা তার খোঁজ-খবর রাখা মানুষ হিসেবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব কিন্তু সে কতটুকু দায়িত্ব পালন করছি? দায়িত্ব পালন তো পরের কথা তাদেরকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতেও যেন আমাদের বিশাল আপত্তি। একজন সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করা মা-বাবার দায়িত্ব। কিন্তু কর্পোরেট দুনিয়ায় মা-বাবার ব্যস্ততা কিংবা কথিত সভ্য সমাজের রীতি সন্তান লালন পালনের দায়ভার দিচ্ছে গৃহপরিচারিকাকে।
যে গৃহপরিচারিকা মায়ের দায়িত্ব নিয়ে একটি শিশুকে লালন পালন করে মানুষ করেছে সেই মানুষের কাছেই যখন গৃহপরিচারিকা ‘বুয়া’ শব্দের চেয়ে সম্মানের কোন সম্বোধন কিংবা মূল্যায়ণ পায় না তখন আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি একথা নিশ্চিত করে বলি কীভাবে?
রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, মজুর-কুলির সাথে খারাপ ব্যবহার করা যেন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। নিম্ন পেশার মানুষের সাথে যারা ভালো ব্যবহার করে বা করতে চায় তাদেরকে সমাজের প্রগতিবিরোধী তকমা দিয়ে অন্যপথে পরিচালিত করার পায়তাঁরা চলছে। শ্রমিক বা মজুরের সন্তান-সন্ততিকেও মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন করতে মানসিকভাবে যেন ব্যাপক অনীহা। সমাজ শুধু ধনাঢ্য এবং শ্রমিকের মধ্যেই বিভাজন করে ক্ষান্ত হয়নি বরং বিভাজন করেছে শ্রমিকের মধ্যেও।
লিঙ্গ বৈষম্যের বাহানায় পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে মূল্যায়ণে এবং পারিশ্রমিকে নারীকে অনেক পিছিয়ে রাখা হয়েছে। রেঁনেসা তথা ইউরোপের নবজাগরণের যুগের পর থেকেই এ শ্রেণী বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। দিন যত গড়াচ্ছে শ্রমিক ও মালিকদের দূরত্বও ততোটা বেড়ে চলছে। সমাজে এমন কুপ্রথার সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে ধনাঢ্যদের একাংশ শ্রমিকদের সাথে এক আসরে খেতে বসাও তাদের জন্য মর্যাদাহানিকর মনে করছে।
স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের সকল পরিমন্ডলে প্রত্যহ মানুষের মধ্যে বিভক্তি বেড়েই চলছে। এ বিভক্তি নির্ধারণ করে দিচ্ছে মালিক ও শ্রমিকের বিপরীতধর্মী সম্পর্ক। একপক্ষ গোটা দুনিয়াকে তাদের সাম্রাজ্য বলে যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছে অন্যপক্ষ বেঁচে থাকার তাগিদে আজ্ঞাবাহীর ভূমিকা পালন করছে। দাসপ্রথা কিংবা সামন্তপ্রথা কাগজ-কলমে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও এর প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব এখনো বিদায় হয়নি বরং দিনে-দিনে তীব্র হয়ে ঝেঁকে বসছে। পৃথিবীর বুকে দাসপ্রথা প্রত্যাবর্তনের হয়ত দ্বিতীয় কোন সুযোজ নাই কিন্তু বিভাজনের তীব্রতা এমনভাবে চলতে থাকলে অন্যকোন মোড়কে দাসপ্রথার মত জঘন্য কোন প্রথার আবির্ভাব হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
সুতরাং শ্রমিক মালিক নির্বিশেষ সবাই যদি নিজেকে এবং অন্যকে সর্বপ্রথম মানুষ হিসাবে পরিচয় দেওয়ার এবং করানোর মানসিকতা তৈরি করে তবে ধরণী থেকে নির্বাসিত শান্তির পরশ আবারও প্রত্যাবর্তন করতে পারে ।
১২৯ বছর পূর্বে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শ্রমিককৃত ত্যাগ স্মরণ করে বিশ্বব্যাপী পালিত হল মহান মে দিবস । শ্রমিকদের প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি ও সংগ্রামের প্রতীকী দিন হিসাবে যথাযোগ্য মরর্য্যাদায় বিগত বছরগুলোর অনুরূপ এবছরের পহেলা মে তারিখেও বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশেই একযোগে দিবসটি পালিত হয়েছে । যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো, এলিয়ানাসহ অন্যান্য বড় বড় শহরের শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী আদায়ের আন্দোলন ও মহান ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বিশ্বের সকল শ্রমিক ও শ্রমিকদের সংগঠন এ দিবসটি পালন করে আসছে। শ্রমিকদের প্রতি বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ স্বরূপ বছরের এ দিনটিকে বাছাই করা হয়েছে। তৎকালীন অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই শ্রমিকদেরকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ণ করা হতো না।
তাদের প্রতি অমানবিক নির্যাতন, তাদেরকে প্রত্যহ ১৪-১৮ ঘন্টা শ্রম দিতে বাধ্য করা, অসুস্থতায়ও ছুটি না দেওয়া, যখন তখন চাকরি থেকে অব্যাহতি, সামান্য পারিশ্রমিক প্রদানসহ বিভিন্নভাবে শ্রমিকদেরকে পেষণ করা হত। দীর্ঘ নির্যাতনের ইতিহাস সহ্য করে অবশেষে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তাদের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে । ১৮৮৬ সালের ১ মে এ আন্দোলনের আন্ষ্ঠুানিক যাত্রা হলেও চরম পরিণতি লাভ করে ৩ ও ৪ মে।
আন্দোলন ও বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে এবং এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন শ্রমিক নিহত ও অসংখ্য সংখ্যক আহত হয়। সেদিন পুলিশ শতাধিক শ্রমিককে গ্রেফতার করে এবং গ্রেফতারকৃতদের মধ্য থেকে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে ৭ জনকে চিহ্নিত করে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যম মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক দ্বিতীয় সম্মেলনে ১লা মে তারিখকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক ঐক্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় অবশ্য রেঁনেসা পরবর্তী শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের এ আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছিল সমাজতন্ত্রবাদের প্রবক্তা কার্ল মার্কস। তিনি তারা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘উধং ঈধঢ়রঃধষ’এ শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব ও উদ্ধৃত্ত্ব মূল্য তত্ত্ব বিষয়ক আলোচনা করে শ্রমিকদের সচেতন করতে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘জগতের সমস্ত শ্রমিক, এক হও! তোমাদের হারাবার কিছুই নেই, শুধু পায়ের শিকল ছাড়া; জয় করে নেবার আছে সমস্ত জগৎ!’ মার্কসের এ মূলমন্ত্রে শ্রমিকরা উজ্জীবিত হয়েছিল ।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে এবং সাংবিধানিক ঘোষণার মাধ্যমে শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র বাধ্য। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে ও বাহিরে কেমন আছে বাংলাদেশের শ্রমিকরা। যাদের অবদানপুষ্ট হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ২৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ অতিক্রম করেছে, যাদের শ্রমে উৎপাদিত তৈরি পোশাক রপ্তানি করে রাষ্ট্র ৮১% বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, যে ৮৫ লাখ শ্রমিক দিনরাত বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে শ্রম বিক্রি করে প্রতি বছর হাজার কোটি ডলার রেমিটেন্স দেশে পাঠাচ্ছে, যে চা শ্রমিকরা অতি স্বল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করে বাংলাদেশকে চা রপ্তানিতে বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে রেখেছে কিংবা জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের মত মৃত্যু ঝুঁকিসম কাজে যারা জড়িত থেকে দেশকে উন্নয়ণের অগ্রযাত্রায় শামিল করতে অহর্নিশ সংগ্রাম করে যাচ্ছে সেই তাদের স্বার্থে এবং প্রয়োজনে কতটুকু উপকার করা হচ্ছে? বিদেশে মানবেতর জীবনযাপন করে অনাহারে-অর্ধাহারে কাটিয়ে শ্রমিকরা শ্রম বিক্রি করে দেশকে স্বনির্ভর করার স্বপ্ন দেখছে অথচ প্রায়ই শুনতে হয় তারা কর্মস্থলে নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছে।
মালিকপক্ষ ঠিকমত বেতন দেয়না কিংবা বিরতিহীনভাবে কাজ করতে বাধ্য করায় অসুস্থতাজনিত কারণে শয্যাশায়ী। এসব অভিযোগ ওঠার পর বিভিন্ন দেশেস্থ বাংলাদেশ দুতাবাসে কর্মরত কর্তাব্যক্তিরা যখন তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে না আসে তখন এ খবর শুনে লজ্জিত হতে হয়। বিদেশে যারা শ্রম বিক্রি করতে গেছে তারা আমাদের কাছে টাকা চায়না বরং তারা আমাদেরকে টাকা দেয়। তাদের বিপদে সামান্যতম সহানুভূতি না দেখানো অত্যন্ত গর্হিত। দেশের প্রায় ৪৫ লাখ নারী-পুরুষ ঘাম ও রক্তেভেজা শ্রমের বিনিময়ে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়নে অবদান রাখছে। তাদের প্রতিটি সুঁইয়ের ফোড় বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণ করে। অথচ তাদের অক্লান্ত শ্রমের বিনিময়ে ন্যূনতম মজুরী থেকেও তারা বঞ্চিত। বিশ্বের প্রায় সকল দেশে যখন শ্রমিকের মজুরী স্থায়ীভাবে নির্ধারিত হয়েছে তখনও বাংলাদেশের শ্রমিককে ন্যায্য মজুরী প্রাপ্তির জন্য রাস্তায় বিক্ষোভ করতে হয়।
মাসের শেষে সামান্য অঙ্কের বেতন পেতেও কখনো কখনো রাস্তায় দাঁড়াতে হয় এবং পুলিশের বুটের নিচে পিষ্ট হতে হয়। পুলিশের বুট যখন শ্রমিকের শরীর থেকে রক্ত ঝরায় তখন সেটা গোটা জাতির মানবাত্মা ও বিবেককে পেষণ করার নামান্তর।
দ্রব্যের চরম দুর্মুল্যের বাজারে আজও চা শ্রমিকরা প্রত্যহ মাত্র ১৫০-২০০ টাকা কিংবা ক্ষেত্র বিশেষ তার থেকেও কম বেতন পায়। জাহাজ শিল্পে যারা কাজ করে তাদের কাজের ধরণ দেখে মনে এটা একধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের শামিল। শ্রমিকদের মুহূর্তের অসাবধানতা জীবন কেড়ে নিতে পারে। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশে এরকম ক্ষেত্রের শ্রমিকদেরকে পরর্য্যাপ্ত নিরাপত্তা ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শিখিয়ে দক্ষ করা হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে তেমনভাবে কেউ ভাবছে না। কোথাও কোথাও শ্রমিকরা তাদের শরীরের সর্বশেষ রক্তবিন্দু উজাড় করেও মালিকপক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারেনা বরং আরও বেশি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তাদের প্রতি মানসিক ও শারীরিক চাপ প্রয়োগ করা হয়। উপরন্তু কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক নিহত কিংবা আহত হলে সামান্য ক্ষতিপূরণ কিংবা সাহায্য দিতেও চলে গড়িমসি। কোথাও কোথাও আর্থিক সাহায্য ও দূরের কথা বরং মৌখিক সহানুভূতিও প্রকাশ করতে কার্পণ্য চলে ।
আমাদের দেশের শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কাজের পরিবেশ নিশ্চিন্তের জন্য আন্দোলন করতে হয় বিদেশীদের! বিভিন্ন সময় কলকারখানায় অগ্নিকান্ড কিংবা ধ্বংসে হাজার হাজার মানুষ মারা যায় । শ্রমিকদের মৃত্যু তেমনিভাবে কাউকে ভাবায় বলে পরিলক্ষিত নয়। ভাব দেখে মনে হয়, ধণবানদের পোষা কুকুর তুল্য মায়াও শ্রমিকের জন্য অবশিষ্ট নেই। রাণা প্লাজা দুর্ঘটনায় ১১’শ ৩৪ জন শ্রমিকের প্রাণ কিংবা তাজরীনসহ অন্যান্য কারখানায় অসংখ্য শ্রমিকেদের অগ্নিদ্বগ্ধ লাশের মায়ায় ক’ফোঁটা নোনাজল কিংবা তেমন কোন আহাজারি দায়িত্বশীল থেকে বাতাসে ভাসেনি। শ্রমিকরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত, শ্রমিকদের সন্তানেরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। রাষ্ট্রের রেওয়াজ হয়েছে, যাদের অফুরন্ত টাকা নাই তাদের জন্য আর যাই রাখুক রাষ্ট্র চিকিৎসা এবং শিক্ষার দ্বার উম্মুক্ত রাখেনি। পুঁজিতন্ত্র সৃষ্ট মানুষের মধ্যে এ কৃত্রিম বিভাজন আশঙ্কাজনকভাবে যেভাবে দিন দিন প্রলম্বিত হচ্ছে তাতে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার মত যে কোন বিষয় যে কোন মুহূর্তেই ঘটতে পারে।
শ্রমিক ও মালিকদের দু’পক্ষেই অত্যন্ত নমনীয়তার মাধ্যমে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হবে কেননা মালিককে মনে রাখতে হবে, যে শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করে তিনি মালিক বণেছেনে সেই শ্রমিকদেরকে সাধ্য ও সম্ভাব্য সকল সুযোগ সুবিধা প্রদান করা আবশ্যক। শ্রমিকদেরকেও মনে রাখতে হবে যে মালিকের কাজ করে জীবিকা অর্জন করছেন তার উন্নতিতে সর্বাত্মক অবদান রাখা। মালিকের সীমাবদ্ধতা ও সাধ্যের প্রতি খেয়াল রেখে যে কোন দাবি পেশ করা উচিত। গতানুগতিক ও অন্ধানুকরণের মাধ্যমে কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে যথেষ্ট যাচাই-বাচাই করে বিবেকের বিচার বিবেচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলে মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্ক গভীর ও মজবুত হবে ।
এ বছর মে দিবসে আমাদের স্লোগান ছিল, ‘মালিক শ্রমিক ঐক্য গড়ি, সোনার বাংলাদেশ গড়ি’। বছরের এই দিনটাতে আমরা শ্রমিকদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। দীর্ঘ একবছর পর আজ শুনলাম শহরের অলিগলিতে মাইকে বাজানো হচ্ছে রথীন্দ্রনাথ রায়ের জনপ্রিয় গান, ‘আমার এ দেশ সব মানুষের। গরিবের নিঃস্বের ফকিরের’। কিন্তু আমরা এ কথা বছরের বাকী দিনগুলোতে কেন বেমালুম ভুলে যাই ? কেন বছরের বাকী ৩৬৪ দিন শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের বিপরীতে অবজ্ঞা ও অবহেলা প্রদর্শন করি।
মনে রাখা উচিত, শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য নির্দলীয় শ্রমিক সংঘ গঠন করা আবশ্যক। যে সংগঠনের দায়িত্বশীলরা সবকিছুর ওপরে শ্রমিকের স্বার্থকে প্রধান্য দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের, বাংলাদেশের শ্রমিকদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রন করে হয় শ্রমিকলীগ নয়ত শ্রমিকদল। এদের কাছে আগে দল পরে শ্রমিক।
কেননা এ সংগঠনের যারা শীর্ষস্থানীয় নেতা তাদের সাথে প্রকৃত শ্রম ও শ্রমিকের কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। আমরা কম বেশি সবাই কাজ করি তাই সবাই শ্রমিক কিন্তু দেশের বর্তমান শ্রমিক সংগঠনগুলোর বেশিরভাগ যারা পরিচালনা করে তারা শ্রমিক পক্ষের স্বার্থের চেয়ে মালিক পক্ষের স্বার্থ রক্ষায় বেশি প্রধান্য দেয়। কেননা এ দেশের রাজনৈতিক ব্যানারের শ্রমিক সংঘের নেতারা যে খুব দ্রুত শ্রমিক থেকে মালিকে রূপ নেয়। সুতরাং শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রকৃত শ্রমিক নেতা এবং এ সকল সংগঠন যে কোন ধরনের রাজনৈতিক ব্যানারমুক্ত হলেই তবে শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা পাবে।
লেখক পরিচিতি : রাজু আহমেদ, কলামিস্ট, raju69mathbaria@gmail.com
Friday, May 01, 2015 09:11:58 PM
এমআরআর/ডিএইচ/2015