বিশ্ব কুদস দিবস যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

পবিত্র নগরী বায়তুল মুকাদ্দাস হচ্ছে মক্কা মু’আজ্জামা ও মদিনা মুনাওয়ারার পর ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান, যেখানে অবস্থিত ইসলামের প্রথম কেবলা মসজিদুল আকসা। কুদস অর্থ পবিত্র। আর ‘আল কুদস’ বলতে বোঝায় ফিলিস্তিনের পবিত্র নগরী বায়তুল মোকাদ্দাসকে, যা জেরুজালেম নামেও পরিচিত।

অগণিত নবী-রাসূলের স্মৃতিধন্য পুণ্যভূমি এটি। এ শহরেই রয়েছে মুসলমানদের প্রথম কিবলা মসজিদুল আকসা। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র মেরাজ শুরু হয়েছিল এখান থেকেই।

বায়তুল মুকাদ্দাস দুনিয়ার অন্য অনেক ভূখণ্ডের মতো কোনো সাধারণ ভূখণ্ড নয়। বায়তুল মুকাদ্দাস ও তার আশপাশের এলাকা তথা সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ড বহু নবী-রাসূলের (আ.) স্মৃতিবিজড়িত এবং কোরআন মজিদে এ পুরো ভূখণ্ডকে ‘আরদে মুকাদ্দাস’ বা ‘পবিত্র ভূমি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সুতরাং মসজিদুল আকসা, বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন- এ পবিত্র নামগুলো মুসলমানদের ঈমান ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই মসজিদুল আকসা, বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনের প্রতি ভালোবাসা প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত।

১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের ক্রুসেডার খ্রিস্টানরা সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে নেয়ার পর বায়তুল মুকাদ্দাসের বিভিন্ন ইসলামী স্থাপনায় পরিবর্তন আনে। এরপর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে সালাহ উদ্দীন আইয়ুবি বায়তুল মুকাদ্দাস শহরকে আবারও মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন।

তবে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানকার মুসলমানদের ওপর বিপদ নামতে শুরু করে। বিংশ শতাব্দীর ৪০ এর দশকে ইহুদিবাদী ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনের ভূমি ও পবিত্র কুদস দখলের পর একটি কঠিন সময়কাল অতিবাহিত হয়েছে এবং সেখানকার রাজনৈতিক জীবনে অনেক উত্থান পতন হয়েছে। ইসরাইলে দখলদার সরকার গঠনের পর আরব বিশ্বের পক্ষে কয়েকটি দেশ (মিশর, সিরিয়া ও জর্ডান) এই শাসন ব্যবস্থার মোকাবিলা করতে শুরু করে।

কিন্তু ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধ ও ১৯৭৩ সালের রমজানের যুদ্ধে ইসরাইলের কাছে আরবদেশগুলোর হতাশাজনক পরাজয়ের পর কুদস শরীফ ও ফিলিস্তিনের মুক্তির বিষয়টি অস্পষ্টতা ও অচলবস্থার মধ্যে পড়ে। মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে অধিকৃত ফিলিস্তিন ও এর নিপীড়িত ও বাস্তচ্যুত জনগণের অবস্থা আগের চেয়ে আরও কঠিন হয়ে পড়ে। মিশর ছাড়াও আরও কয়েকটি আরব ও ইসলামি দেশের মধ্যে ইহুদিবাদী ইসরাইলকে মোকাবিলার নীতিতে পরিবর্তন আসে এবং তারা ইসরাইলের সাথে আপোষকামী নীতি গ্রহণ করে।

এ পরিস্থিতি ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসলামি বিশ্ব ও মুসলিম জাতিগুলোর ঐক্য ও সংহতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসলামি সরকারগুলোর মধ্যে বিভেদ ও বিভক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

প্রকৃতপক্ষে এই পরিস্থিতি ও সময়টুকুতে ইসরাইলই ময়দানে বেপরোয়া ভাবে আবির্ভূত হয় এবং তারা নিজেদের অস্তিত্বকে বৈধতা দেয়ার নিমিত্তে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক আগ্রাসনের সূচনা করে।

কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয় ফিলিস্তিন ইস্যুর পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে এবং ইরানের বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী দখলদার ইহুদীবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পতাকা উড্ডীন করেন এবং কুদস শরীফ ও ফিলিস্তিনের ইসলামি ও পবিত্র ভূমির মুক্তির বিস্মৃত লক্ষ্য ও আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করেন।

ইমাম খোমেনীর পক্ষ থেকে রমজান মাসের শেষ দশকের শুক্রবারকে আল কুদস দিবস নামকরণ ছিলো একটি বৃহৎ বুদ্ধিবৃক্তিক ও গঠনমুলক রাজনৈতিক উদ্যোগ যা ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের পথকে পাল্টে দেয় এবং এই পথটিকে আলোকিত ও মসৃন করে তোলে।

এ উদ্যোগ ও নামকরণ কয়েকটি দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বের সমস্ত মুসলিম এমনকি বিশ্বের অন্যান্য মুক্তিকামী জাতির জন্যও এর সুস্পষ্ট বার্তা রয়েছে।

পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে ‘বিশ্ব কুদস দিবস’ হিসেবে নামকরণের গুরুত্ব ও এর বার্তা বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা যেতে পারে। যারমধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক্ এখানে উল্লেখ করা হলো-

প্রথমত: বিশ্ব কুদস দিবসের সর্বাগ্রে যে বার্তা ও অর্জন তা হল পবিত্র কুদস ও ফিলিস্তিনের ভূমির বিষয়টি বিশ্ব জনমতের ইস্যু ও সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে এবং এটি আর ভুলে যাওয়ার নয়। আর এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থেকে বিশ্বের জনমতকে বিচ্যুত করার জন্য ইহুদিবাদী ইসরাইল ও তার মদদদাতা পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

তাই ফিলিস্তিনের দখলকৃত অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ঘটনা ও তেলআবিবের কর্মকর্তাদের অপরাধযজ্ঞের বিষয়টি পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এড়িয়ে গেলেও স্বাধীন গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে দৃষ্টি রেখেছে।

দ্বিতীয়ত: বিশ্ব কুদস দিবস নামকরণের আগ পর্যন্ত ফিলিস্তিন ইস্যুটি ছিল সরকারি সম্পর্কের কাঠামোর মধ্যে, তাও আবার কয়েকটি প্রভাবশালী আরব রাষ্ট্র কেন্দ্রিক। কিন্তু বিশ্ব কুদস দিবস ফিলিস্তিন ইস্যুকে একটি সরকারি ফাইলবন্দি বিষয় থেকে জনগণের ইস্যুতে পরিণত করেছে ও জাতিগুলোকে একত্রিত করেছে।

এ অর্জন কিছু আরব ও ইসলামি সরকারের আপোষ প্রক্রিয়াকে প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে এবং ফিলিস্তিন সংকট নিরসনের বিষয়টি সরকারগুলো থেকে জাতিসমূহের প্রধান দাবিতে পরিণত হয়েছে।

তৃতীয়ত: আজ ফিলিস্তিন ইস্যু ও কুদস শরীফের ভাগ্য কেবলমাত্র একটি ফিলিস্তিনি এমনকি একটি আরবীয় ইস্যু নয়, এটি সমগ্র ইসলামি বিশ্বের ও সমস্ত মুসলমানের বিষয়।

এ ভাবনা থেকে ফিলিস্তিনি আদর্শ ও এর মুক্তি আন্দোলনকে ঘিরে ইসলামি বিশ্বের সকল সক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধাকে একত্রিত করা সম্ভব এবং এই প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে দখলদারিত্বের অবসান এবং ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে পরিণতি লাভ করতে পারে।

চতুর্থত: বিশ্ব কুদস দিবসের আন্দোলন ফিলিস্তিনের ইসলামি দিকগুলো ছাড়াও এর অন্যান্য মানবিক ও আইনগত দিকগুলোও উত্থাপন এবং বিশ্ব জনমতের কাছে তা অনুসরণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাথমিক দৃষ্টিতে বিশ্বের কোনো কোনো জাতির জন্য ফিলিস্তিন ইস্যুটি কেবল একটি আরবীয় বা ইসলামি সমস্যা ছিলো।

কিন্তু কুদস দিবসের বৈশ্বিক আন্দোলন একে একটি সর্বজনীন ইস্যুতে পরিণত করেছে এবং এর মানবিক ও আইনগত দিকগুলোও তুলে ধরছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আজ বিশ্বের কোনো কোনো অমুসলিম জাতিও ফিলিস্তিন সমস্যা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের কঠিন পরিণতির বিষয়টি উপলব্ধি করছে এবং মানবিক ও আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে ফিলিস্তিনের মজলুম জনগণকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

নিঃসন্দেহে এই ভূখণ্ডের দখলদাররা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রাথমিক মানবাধিকার হরণ করেছে এবং তাদের খোদা প্রদত্ত স্বাধীনতা ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এ কারণে মুসলিম ও অমুসলিম জাতি নির্বিশেষ বিশ্বের সকল মানুষ ফিলিস্তিনি জনগণের ন্বাধীনতা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে এবং এটি বিশ্ব কুদ্স দিবস আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ও অর্জন।

পঞ্চমত: বিশ্ব কুদস দিবসের নামকরণ ও এর বড় অর্জন সম্পর্কে চূড়ান্ত ও শেষ কথা হলো এই রাজনৈতিক উদ্যোগ ফিলিস্তিনি জাতি এবং বিশ্বের অন্যান্য ইসলামি ও স্বাধীনতাকামী জাতির মুক্তি সংগ্রামের পথে একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে এবং তাদেরকে ফিলিস্তিনের নিপীড়িত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দখলদার ইহুদিবাদীদের হাত থেকে এই পবিত্র ভূমিকে মুক্ত করতে আশাবাদী করেছে।

ফিলিস্তিন সমস্যার শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও তাদের সহযোগীরা কখনও সরাসরি, কখনও জাতিসংঘের মাধ্যমে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ‘শান্তি শান্তি’ খেলা খেলেছে। আর চক্রান্তকারী ইহুদিরা নতুন নতুন নীলনকশা নিয়ে মাঠে নেমেছে।

তাই আজ সময় এসেছে বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। বিশ্বের সব মানবতাবাদী মানুষকে এ সংগ্রামে সর্বাত্মক সমর্থন জানাতে হবে।

কারণ ফিলিস্তিনের ইস্যু কেবল মুসলমানদের ইস্যু নয়, এটি একটি মানবতাবাদী ইস্যু। ইসরাইল ফিলিস্তিন ইস্যুকে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়।

এ কারণেই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনি (র.) এটিকে বিশ্ব মানবতার সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে মসজিদুল আকসাসহ সমগ্র ফিলিস্তিনের মুক্তির লক্ষ্যে রমজান মাসের শেষ শুক্রবার ‘বিশ্ব কুদস দিবস’ ঘোষণা করেন।

মুসলিম বিশ্ব এ দিনকে কুদস দিবস হিসেবে পালন করতে থাকে। এই দিনে বিশ্বজুড়ে জনগণের এই ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ফিলিস্তিনিদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত রাখার এবং ইসরাইলের প্রতি বিশ্ব মুসলমানের ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।

চাঁদপুর টাইমস
১৯ এপ্রিল ২০২৩

Share