Home / সারাদেশ / বিউটি হত্যায় জন্মদাতা বাবার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি
Beauty-murder

বিউটি হত্যায় জন্মদাতা বাবার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি

বহুল আলোচিত হবিগঞ্জের বিউটি আক্তার হত্যা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছে। এ লোমহর্ষক ঘটনার সাথে জড়িত বিউটির বাবা ছায়েদ আলী শনিবার পাঁচ ঘন্টা ধরে অবকাশকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের কাছে বিউটি হত্যার পুরো কাহিনী বর্ণনা করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন।

এ নিয়ে বিউটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিউটির বাবা ছায়েদ মিয়া, ছায়েদ মিয়ার বন্ধু ও কাজিন ময়না মিয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন।

হত্যাকাণ্ডের পর যার ফাঁসির জন্য দেশ উত্তাল ছিল সেই প্রেমিক বাবুল মিয়া শুধু বিউটি আক্তারের সাথে প্রেমের কথা স্বীকার করেন এবং একসাথে বসবাস ও একসাথে চাকরি করার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছেন। যার বসতঘর থেকে বিউটি আক্তারকে নিয়ে আসা হয়েছিল বিউটি আক্তারের সেই নানি ফাতেমা আক্তার ১৬৪(১) ধারায় স্বাক্ষী হিসাবে জবানবন্দী দিয়েছেন আদালতে।

একইভাবে সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দী দিয়েছেন ঘাতক ময়না মিয়ার স্ত্রী আসমা আক্তার। বাড়িতে নেই বিউটি আক্তারের মা হুসনে আরা ও ভাই সাদেক মিয়া। একটি সূত্র জানিয়েছে, তারা বেশ কয়েক দিন যাবত আইন শৃংখলা বাহিনীর হেফাজতে আছেন। তবে এ কথা স্বীকার করেননি মামলার আইও শায়েস্তাগঞ্জ থানার ওসি মানিকুল ইসলাম।

প্রেম থেকে পলায়ন :
বাবুল মিয়া ও বিউটি আক্তারের বাড়ি একই গ্রামে শায়েস্তাগঞ্জ থানার ব্রাহ্মনডুরায়। বাবুল মিয়া বিবাহিত হলেও তাদের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। আর্থিকভাবে অনেকটা স্বচ্ছল বাবুল মিয়ার সাথে গত ২১ জানুয়ারি পালিয়ে যান বিউটি আক্তার। বিউটি আক্তার পালিয়ে যাওয়ার পর তাকে ফিরিয়ে আনার তেমন কোনো উদ্যোগও নেননি ছায়েদ মিয়া। সবকিছু ভালোভাবেই চলছিল। বাবুল মিয়ার সাথে পালিয়ে যাওয়ার পর বিউটি আক্তার চাকরি নেন তাদের গ্রামের পাশেই গড়ে উঠা একটি কোম্পানিতে। প্রতিদিন পরিবারের লোকজনের চোখের সামনেই বিউটি আক্তার বাবুল মিয়ার আলাদা বসতঘর থেকে কোম্পানিতে যাওয়া আসা করে। হঠাৎ করেই কোম্পানি থেকে বিউটি আক্তারকে নিয়ে আসেন তার বাবা মা। বিউটি আক্তারের ভাষায় “আমি আসামি বাবুল মিয়ার সাথে পালিয়ে যাওয়ার পর একটি কোম্পানীতে চাকুরী শুরু করি। ঐ কোম্পানী হতে আমার আব্বা আম্মা আমাকে নিয়ে আসে। আমি ঘটনার তারিখ হতে নিজের ইচ্ছায় আসামী বাবুল মিয়ার সাথে ১৮ দিন ছিলাম”। পরে মামলা দায়ের করা হয়।

ইউপি নির্বাচনে বন্ধুর স্ত্রীর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে নিজ মেয়েকে হত্যা : বিউটি আক্তারের পিতা ছায়েদ মিয়া এবং একই গ্রামের ময়না মিয়া ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গত ডিসেম্বর মাসে হবিগঞ্জের ৭৮তম ইউনিয়ন হিসেবে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ব্রাহ্মনডুরা ইউনিয়নে। সেই নির্বাচনে মহিলা মেম্বার প্রার্থী ছিলেন ছায়েদ মিয়ার বন্ধু ময়না মিয়ার স্ত্রী আসমা খাতুন। তিনি নির্বাচনে পরাজিত হন। নির্বাচনে বিজয়ী হন বিউটি আক্তার ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি বাবুল মিয়ার মা কলম চান বিবি। সেই থেকে বিরোধ শুরু।

বিউটি আক্তার বাবুল মিয়ার সাথে পালিয়ে যাওয়ার পর কলম চান বিবির পরিবারকে একটি বড় শিক্ষা দেয়ার জন্য বিভিন্ন ফন্দি আটতে থাকেন ময়না ও ছায়েদ মিয়া। এরই অংশ হিসাবে প্রথমে বাবুল মিয়ার বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন ছায়েদ মিয়া। পরিকল্পিতভাবে সেই মামলার অন্যতম স্বাক্ষী হিসাবে রাখা হয় ময়না মিয়াকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে দায়েরকৃত অপহরণ ও ধর্ষণ মামলাটি তখনো আদালত থেকে থানায় পৌছেনি। এরই মধ্যে বাবুল মিয়ার বিরুদ্ধে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে ফৌজদারী কার্যবিধির ১০৭ ধারায় জানমালের নিরাপত্তা চেয়ে আরো একটি মামলা দায়ের করেন ছায়েদ মিয়া।

এসব মামলা পরিকল্পিত একটি হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য ক্ষেত্র তৈরী করাই উদ্দেশ্যে ছিল বলে মনে করছেন অনেকেই। ওই ২টি মামলার গুরুত্ব কমিয়ে দেন বিউটি আক্তার নিজেই। তিনি গত ১২ মার্চ তারিখে ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতে বাবার আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নিজ ইচ্ছায় তিনি বাবুল মিয়ার সাথে পালিয়ে যান এবং তারা একসাথে বসবাস করেন। বিউটি আক্তারের জবানবন্দী ফলে বাবা ছায়েদ মিয়া ও বাবার বন্ধু ময়না মিয়ার পরিকল্পনা অনেকটা ভণ্ডুল হয়ে যায়। শুরু হয় নতুন কৌশল। এবার বিউটি আক্তারকে খুন করে বাবুল মিয়া ও কলম চান বিবিকে ফাঁসানোর ষঢ়যন্ত্র করেন তারা।

ঘাতকদের হাতে নিজ মেয়েকে তুলে দেয় ছায়েদ মিয়া : বাবুল মিয়া, তার মা কলম চান এবং প্রতিবেশী সাথী আক্তারকে আসামি করে বাবার মামলা দায়ের করার বিষয়টি পছন্দ ছিল না বিউটি আক্তারের। বাবুল মিয়ার সাথে বিউটি আক্তারের গভীর প্রেমের কারণে বাবা-মার সাথে বিউটি আক্তারের প্রায়ই বচসা হতো বলে জানা গেছে। আবারো বাবুল মিয়ার সাথে বিউটি আক্তার চলে যেতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই লাখাই উপজেলার গুণই গ্রামে বিউটি আক্তারের নানার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অবশেষে সেখান থেকে বিউটি আক্তারকে নিজ বাড়িতে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে আসেন ছায়েদ মিয়া।

বিউটির নানী ফাতেমা আক্তারও স্বীকার করেছেন, তার বাড়ি থেকে ছায়েদ আলীই বিউটিকে নিয়ে আসেন। পথিমধ্যেই অপেক্ষা করছিল ঘাতকরা। ঘাতক ছায়েদ আলীরই বন্ধু ময়না মিয়া। ময়না মিয়াদের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে চলে আসেন ছায়েদ মিয়া। পরের ঘটনা সবুজ শ্যামল ঘাসের উপর বিউটি আক্তারের ক্ষতবিক্ষত লাশ। স্বাধীনতা মাসের ১৭ মার্চ তারিখের সেই লাশের ছবি দেখে হতবাক দেশ। লাল রংয়ের জামা কাপড় পরা বিউটির লাশটি ছিল সবুজের মধ্যে লাল বৃত্তের মতো। বিষয়টি প্রথমে একটি সাধারণ হত্যাকাণ্ড হিসাবেই দেখা হয়েছিল। মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয় দেশে বিদেশে।

ঢাকায় সাংস্কৃতিক কর্মীরাও মানববন্ধন করেন বিউটি আক্তার হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি বাবুল মিয়ার ফাঁসির দাবিতে। প্রতিদিন টিভি মিডিয়ায় স্বাক্ষাতকার দিতে থাকেন ছায়েদ মিয়া, তার স্ত্রী হুসনে আরা এবং ছায়েদ মিয়ার বন্ধু ময়না মিয়া। তুমুল প্রতিবাদের মুখে সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গ্রেফতার করা হয় বাবুল মিয়াকে। সে বিউটির সাথে প্রেমের কথা স্বীকার করলেও হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তবে কিছু আলামত দেন আইন শৃংখলা বাহিনীকে, যাতে খুব সহজে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে পারে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের ২০ দিনের মাথায় প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে বিউটি আক্তার হত্যাকাণ্ডের সাথে জন্মদাতা পিতা মাতা ও তাদের বন্ধুরা জড়িত।

কার কাছে কে নিরাপদ : ২০০৩ সালের ঘটনা। হবিগঞ্জের রেললাইনে পাওয়া যায় অষ্টাদশী এক কিশোরীর ক্ষতবিক্ষত লাশ। সেই লাশ ছিল সদর উপজেলার গোপায়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইছাক মিয়ার কন্যার। তখনো ঝড় উঠেছিল সর্বত্র।

কয়েক দিনের মাথায় প্রমাণিত হয় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের মেয়েকে খুন করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান ইছাক মিয়া নিজেই। সেই মেয়ে খুনের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় ইছাক চেয়ারম্যানের। জামিনে মুক্তি পাওয়ার কিছু দিনের মাথায় ইছাক মিয়া খুন হন বাড়ির সীম সীমানা-সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের আঘাতে।

রংপুরের এডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক। নিখোঁজ হওয়ার পর সেই ধরপাকড়। অবশেষে প্রমাণিত হয়েছে স্ত্রীর কাছেই প্রাণ দিতে হয়েছে স্বামী রথীশ ভৌমিককে। হবিগঞ্জের আলোচিত বিউটি হত্যা। হত্যাকাণ্ডের ২০ দিনের মধ্যে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে বিউটি হত্যাকাণ্ডের সাথে বাবা নিজেই জড়িত। এসব ঘটনার পর সর্বত্র একই প্রশ্ন আসলে কার কাছে কে নিরাপদ?