Home / জাতীয় / ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পাস
২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পাস
ফাইল ছবি

২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পাস

বিরোধী দল জাতীয় পার্টির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে নির্দিষ্টকরণ বিল পাসের মধ্য দিয়ে জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের বাজেট পাস হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ২১৪ কোটি ১৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা ব্যয়ের অনুমোদন নিতে নির্দিষ্টকরণ বিল ২০১৭ পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পরে কণ্ঠভোটে সর্বসম্মতিতে তা পাস হয়।

এর আগে মঞ্জুরি দাবির ওপর আলোচনার সুযোগ নিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা নিয়ে অর্থমন্ত্রী ও সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা।

বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) সকালে শুরু হওয়া সংসদ অধিবেশনে প্রথমে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও পরে ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া সভাপতিত্ব করেন।

সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ সরকারি বিরোধী দলের অধিকাংশ সদস্যের উপস্থিতিতে চলা অধিবেশনে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর ৫৯টি মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে ৩৫২টি ছাঁটাই প্রস্তাব আনা হয়।

সরকার ও বিরোধী দলের হুইপের মধ্যে সমঝোতা অনুযায়ী সাতটি মঞ্জুরি দাবি আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়। আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, মো. ফখরুল ইমাম, নূরুল ইসলাম মিলন, সেলিম উদ্দিন ও বেগম রওশন আরা মান্নান এবং স্বতন্ত্র সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজী।

দীর্ঘ প্রায় চার ঘণ্টা আলোচনা শেষে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বাজেট পাস হয়। এর আগে আলোচনা শেষে মঞ্জুরি দাবিগুলো কণ্ঠভোটে গৃহীত হয় সংসদে।

এরপর অর্থমন্ত্রী ‘নির্দিষ্টকরণ বিল ২০১৭’ পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করলে সর্বসম্মতিতে তা পাস হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্য টেবিল চাপড়ে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বাজেট বাস্তবায়নের যাত্রাকে স্বাগত জানান।

বাজেট পাসের পর অর্থমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সন্ধ্যায় আয়োজিত ডিনারে যোগদানের জন্য সব সংসদ সদস্যকে আমন্ত্রণ জানান। এরপর স্পিকার সংসদ অধিবেশন আগামী ৯ জুলাই বিকেল ৫টা পর্যন্ত মূলতবি করেন।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ, সময় এখন আমাদের’ শীর্ষক চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করেন।

প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা গত ৭ জুন শুরু হয়। গতকাল বুধবার সংসদ নেতা ও প্রধামন্ত্রী শেষ হাসিনার বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে সাধারণ আলোচনা শেষ হয়। প্রায় সোয়া ৫৬ ঘণ্টার এ আলোচনায় সরকারি দলের ১৬৫ জন ও বিরোধী দলের ৪২ জন সদস্য অংশ নেন।

এরপর বুধবার সংসদে অর্থবিল ২০১৭ পাস হয়। যে বিলে কর সংক্রান্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ওই বিলে ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবে আবগারি শুল্ক কমানো হয়। একইসঙ্গে নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট/মূসক) আইন কার্যকর আগামী দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়।

নির্দ্দিষ্টকরণ বিল পাসের মাধ্যমে সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ২১৪ কোটি ১৫ লাখ ৯২ হাজার টাকার মধ্যে সংসদের ওপর দায় ১৬৪ কোটি ৫৩ লাখ ৭৩ হাজার ১৮৩ টাকা। এই টাকা অনুমোদনের জন্য কোনো ভোটের প্রয়োজন হয় না। সরাসরি সংসদ এই টাকা অনুমোদন করে। অবশিষ্ট ৩৭০ কোটি ৬৭ লাখ ৬৮ হাজার ৪০৯ টাকা ভোটের মাধ্যমে সংসদে গৃহীত হয়।

সংসদে পাসকৃত বাজেটটি মূলত গ্রস বাজেট। বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও অন্যান্য খাতে বাজেটে সরকারের অর্থ বরাদ্দের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এই অর্থ কখনো ব্যয় হয় না। যা বাজেটের আয় ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে হিসাবে মেলানো হয়। এই বাধ্যবাধকতার কারণে এবারের বাজেটেও এক লাখ ৩৪ হাজার ৯৪২ ১৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা ব্যয় হবে না। ১ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী যে চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপন করেছেন- সেটাই ব্যয় হবে। সেটাই আগামী অর্থবছরের নিট বাজেট।

ব্যাংকিং খাত অত্যন্ত স্পর্শকাতর

অর্থ বিভাগ খাতে ৫৩ হাজার ৮৩৩ কোটি ৮০ লাখ ৭১ হাজার টাকা দাবির বিপরীতে ছাাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় সংসদ সদস্যরা বলেন, অর্থই অনর্থের মূল। অভিযোগ রয়েছে, নানাভাবে টাকা বিদেশে পাচার করা হয়। বেসরকারি ব্যাংক শেষ হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে ব্যাংক কমিশন গঠন করা দরকার, তাহলে ঋণখেলাপিরা টাকা দিতে বাধ্য হবে। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। বেসরকারি ব্যাংকে সব পরিচালক পারিবারিক। এখানে স্বতন্ত্র কোনো পরিচালক নেই। এ কারণে এসব খাতে লুটপাট হচ্ছে। এখানে দুই তৃতীয়াংশ স্বতন্ত্র ব্যাংক পরিচালক থাকা দরকার। তারা বলেন, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। কারণ যারা ব্যাংক লুটপাট করেছেন অর্থমন্ত্রী তাদের চেনেন না।

জবাবে অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, “বর্তমানে যেসব অভিযোগ এসেছে তাতে বলা হয়েছে ব্যাংকগুলো পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ খাতে সুশাসন দুর্লভ। ব্যাংকের পরিচালকদের অবশ্যই দায়িত্ব রয়েছে। এ নিয়ে আইন তৈরি করা হয়েছে। এটা সংসদীয় কমিটি বিবেচনা করছে। কমিটির সুপারিশ পাওয়ার পর সরকারের অভিমত জানানো হবে। ” তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলোকে খামাখা ভর্তুকি দিচ্ছি বলে অনেক অভিযোগ করেছেন। এটা ঠিক নয়। কারণ ব্যাংকিং খাত হচ্ছে খুবই স্পর্শকাতর খাত। ব্যাংকিং খাতের কোনো ধরনের বিপর্যয় সারা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ”

তিনি আরো বলেন, “সরকার ব্যবসা করে কোনোদিনই ভালো করেনি। এ জন্য সরকারকে ব্যবসা থেকে দূরে রাখি। সুশাসন শব্দটির সীমা ব্যাপক। গত আট বছরে সরকার ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের জন্য অত্যন্ত ন্যয়নিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। এরই মধ্যে এর সুফল আপনারা দেখতে পেয়েছেন। ব্যাংকিং খাতে ৫৮টি ব্যাংক কাজ করছে। আশা করি আমাদের দেশেও ব্যাংকিং খাত অনেক অগ্রসর হবে। ”

সড়ক বিভাগ ও সেতু মন্ত্রণালয়

সড়ক বিভাগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের বিরোধিতা করে বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা বলেন, শুধু রাস্তা নির্মাণ করলেই হবে না, জনগণ যাতে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। যানজট নিরসনে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। সড়ক নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অবশ্যই সড়ক নির্মাণের মান বৃদ্ধি করতে হবে।

জবাবে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, “গঠনমূলক সমালোচনা যারা করেন তারা আমার বন্ধু। চাটুকার- মোসাহেবরা আমার শত্রু। কারণ তারা বলবে সব ঠিক আছে। কারোর মনে করা উচিত নয়, আমরা সব ভালো করছি। আমাদেরও ভুল হতে পারে, ভুল হয়। ”

তিনি বলেন, “বিএনপি বাজেটের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। ভাবটা এমন ঈদের পর সরকার পতনের আন্দোলন করবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর গঠনমূলক পদক্ষেপের কারণে পাস হওয়া বাজেট নিয়ে এখন সারা দেশেই আনন্দ-উল্লাস ছড়িয়ে পড়েছে। গত তিন বছরের মধ্যে এবারের ঈদে সড়ক দূর্ঘটনার ঘটনা অনেক কম হয়েছে। ”

মন্ত্রী আরো বলেন, “সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে, শতভাগ দুর্নীতি দূর করতে পারিনি। স্বীকার করছি যানজট রয়েছে। এবারের ঈদে এক কোটি মানুষ গ্রামে-গঞ্জে গেছে। স্পিড কম ছিল, কিন্তু যানজট ছিল না। মন্ত্রী-এমপি-ভিআইপিরা উল্টো পথে গেলেই যানজট হয়। জনগণকে আইন মানতে বলার আগে আমাদের নিজেদের আইন মানতে হবে। আমাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন না হলে যানজট দূর হবে না। আর পদ্মা সেতুর কাজ ৪৬ ভাগ অগ্রগতি হয়েছে। মহাসড়কে ত্রি-হুইলার চালানোর ব্যাপারে কারো উৎসাহিত করা উচিত নয়, এতে প্রাণহানীর ঘটনা বেশি হচ্ছে। ”

স্বাস্থ্যখাত

স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের বিরুদ্ধে ছাঁটাই প্রস্তাব দিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা অভিযোগ করেন, সরকার চিকিৎসক দিলেও তারা এলাকায় থাকেন না। অনেক স্থানেই আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। অনেক জেলায় সিসিইউ, আইসিইউ নেই। বাজেট অপ্রতুলতার কারণে তৃণমুলে অ্যাম্বুলেন্স নেই। জননিরাপত্তা কর্মসূচি মুখ থুবড়ে পড়েছে, ফলে জনসংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। সব উন্নয়ন বৃথা যাবে যদি জন্মনিয়ন্ত্রণ করা না যায়। এটি সর্ববৃহৎ সেবা খাত, তাই এ খাতে বাজেট আরো বাড়াতে হবে।

জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, “চিকিৎসকদের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী দেশের চিকিৎসকার ওপর বিশ্বাস করেন বলেই দেশেই চিকিৎসা নেন। অথচ সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ বিদেশে চিকিৎসা নেন। এটা ঠিক নয়। বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি চান সেটা অর্থমন্ত্রীকে বলুন। বাংলাদেশে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সার্জন রয়েছেন। সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকার পরও কাজ করে যাচ্ছি বলেই বিশ্বের অনেক দেশ থেকে স্বাস্থ্যসেবা অনেক দূর এগিয়ে আছি। এমনকি ভারত, পাকিস্তানের চেয়েও স্বাস্থ্য সেবায় বাংলাদেশ এগিয়ে।

স্থানীয় সরকার বিভাগ

স্থানীয় সরকার বিভাগ খাতে বরাদ্দের বিরুদ্ধে ছাঁটাই প্রস্তাব এনে বিরোধী দল সংসদ সদস্যরা অভিযোগ করেন, দেশের অনেক স্থানেই রাস্তাঘাট ধ্বংসের পথে। দক্ষতার অভাবে অনেক রাস্তা নির্মাণের পরেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আবার দীর্ঘদিনেও ঠিকাদাররা কাজ শেষ করছে না। ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের কোন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় না। দেশ ডিজিটাল হলেও স্থানীয় সরকার বিভাগ এখনো এনালগভাবে চলছে। ঠিকাদাররা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে কাজ নিয়ে সঠিকভাবে করছে না, কাজ না করেই বিল নিয়ে যাচ্ছে। এতে সরকারের ভাবমূর্তিই নষ্ট হচ্ছে। এসব বন্ধ করতে হবে। আর সারা দেশেই সুষম উন্নয়ন করতে হবে।

জবাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “স্থানীয় সরকার উন্নয়নমুখী বিভাগ। নগর ও গ্রামীণ এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয় এই বিভাগের মাধ্যমে। তিন লাখ ২১ হাজার ৪৬২ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করেছে। প্রত্যেকটা গ্রামকে আমরা যোগাযোগের আওতায় আনছি। ”

তিনি বলেন, “সমস্যা রাস্তার নয়, সমস্যা হচ্ছে ট্রাফিকের। ধারণ ক্ষমতার বাইরে লোড পড়লেই রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমান সরকার বিশ্বাস করে, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমেই সারা দেশকে উন্নয়ন-সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে। দেশে এখন স্যানিটারি ব্যবহারের হার ৯৯ ভাগ।’

Leave a Reply