বাঁচান, বাঁচান বলে চিৎকার করছিলেন তামান্না

‎Thursday, ‎April ‎02, ‎2015  03:31:05 PM

রাজশাহী অফিস :

রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরে বুধবার বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমির একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিক্ষানবিশ এক পাইলট নিহত হন।

প্রশিক্ষণ বিমানটি ওড়ার কিছুক্ষণ পর রানওয়েতে ছিটকে পড়ে। ধরে যায় আগুন। এ সময় ‘বাঁচান, বাঁচান’ বলে চিৎকার করছিলেন প্রশিক্ষণার্থী তামান্না রহমান (২২)। ঘটনা দেখার পরও আগুনের তীব্রতায় কাছে ভিড়তে পারেননি দুই ব্যক্তি। চোখের সামনেই আগুনে পুড়ে মারা যান তামান্না।

আহত হয়েছেন বিমানের প্রশিক্ষক পাইলট লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাঈদ কামাল। মারাত্মক দগ্ধ অবস্থায় তাঁকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়েছে।

বুধবার দুপুরে রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরে এই দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন পাশের পাইকপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক ডাবলু ও অটোরিকশাচালক লুৎফর রহমান।

শাহ মখদুম বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সেতাবুর রহমান জানান, বুধবার দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটের দিকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাঈদ কামাল তামান্না রহমানকে প্রশিক্ষণ দিতে রাজশাহী শাহ মখদুম বিমানবন্দর থেকে একটি প্রশিক্ষণ বিমান উড্ডয়ন করেন। উড্ডয়নের তিন মিনিটের মাথায় ১টা ৫৮ মিনিটের দিকে বিমানটি জরুরিভাবে অবতরণ করতে গিয়ে রানওয়ের পাশে ছিটকে পড়ে যায়। এতে বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। বিমানের ভেতর আটকা পড়ে তামান্না রহমান আগুনে পুড়ে মারা যান। পাইলট সাঈদ কামালের শরীরের প্রায় ৫৫ ভাগ পুড়ে গেছে। তাঁকে প্রথমে রাজশাহী সেনানিবাস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয়।

বিমানটি বিধ্বস্তের কারণ এবং উড্ডয়নের পর পরই কেন বিমানটি জরুরি অবতরণ করার প্রয়োজন দেখা দেয়, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি বিমানবন্দর ব্যবস্থাপক।

নিহত তামান্না ঢাকার খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ-২ আবাসিক এলাকার ড. আনিসুর রহমানের মেয়ে। তাঁদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে। ২০১৩ সালে তামান্না পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন। আগামী বছর তাঁর প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার কথা ছিল। আহত সাঈদ কামালের গ্রামের বাড়ি নড়াইলে।

বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি অ্যান্ড জেনারেল এভিয়েশন লিমিটেডের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রানওয়ে থেকে টেক-অফ করার সময় বিমানটির ইঞ্জিনে আগুন লাগে। ইমারজেন্সি ল্যান্ডিয়ের চেষ্টা ব্যর্থ হলে দুই বৈমানিক ইমারজেন্সি এস্কেপের চেষ্টা করেন। এ সময় বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।’

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (সিভিল অ্যাভিয়েশনের) জ্যেষ্ঠ উপপরিদর্শক এনামুল কবির বলেন, ‘প্রশিক্ষণ বিমানটি উড্ডয়নের পর পরই বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে ১৫-২০ হাত দূরে আছড়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে এতে আগুন ধরে যায়।’

এদিকে বিমানবন্দরের পাশের পাইকপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা জানান, বিমানটি রানওয়ের পাশে ছিটকে পড়ে আগুন ধরলে পাশের পাইকপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক ডাবলু ও অটোরিকশা চালক লুৎফর রহমান বিমানবন্দরের দেয়াল টপকে ভেতরে যান। তবে আগুনের তীব্রতার কারণে তারা প্রথমে বিমানটির কাছে পৌঁছাতে পারেননি। সাঈদ কামাল বিমানের জানালার কাঁচ ভেঙে বেরিয়ে এসে গায়ে আগুন নিয়ে ‘আমাকে বাঁচান, বাঁচান’ বলে চিৎকার করছিলেন। ডাবলু তাঁকে মাটিতে গড়াগড়ি করার পরামর্শ দেন। তিনি মাটিতে গড়াগড়ি দিলে আগুনের তেজ কিছুটা কমে যায় এবং ডাবলু কামালের শরীরের আগুন নিভিয়ে ফেলেন।

ডাবলু ও লুৎফর জানান, বিমানের ভেতরে আটক নারী পাইলট ‘বাঁচান, বাঁচান’ বলে চিৎকার করে তাঁদের কাছে ডাকছিলেন। কিন্তু আগুনের কারণে তারা তাঁকে বাঁচাতে পারেননি।

ডাবলু ও লুৎফর জানান, বিমানটিতে আগুন ধরে যাওয়ার প্রায় ২০ মিনিট পর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে যায়। এরপরও পানি দিতে আরো কয়েক মিনিট কেটে যায়। পরে তাঁরা বিমানের আগুন নিভিয়ে ফেলেন এবং পাইলটকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন।

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, আগুনে বিমানটির ককপিট, পাখা, ইঞ্জিন ও মূল কাঠামো পুড়ে আলাদা হয়ে গেছে। বিমানটির সামনের দুই চাকা ছিটকে প্রায় ২০ হাত দূরে পড়ে আছে। বিমানটি যে স্থানে আছড়ে পড়েছে, সেখানে মাটি দেবে গিয়ে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

রাজশাহী ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আনসারুল কবির জানান, বিধ্বস্ত হয়ে বিমানে আগুন ধরার খবর তাঁরা বিমানবন্দর থেকে পাননি। টেলিভিশনে বিমান বিধ্বস্তের খবর পেয়ে তাঁরা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তবে তার আগে বিমাবন্দরের নিজস্ব ফায়ার ইউনিট আগুন নিভিয়ে ফেলে।

তদন্ত কমিটি গঠন : প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের কারণ অনুসন্ধানের জন্য পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের সিনিয়র উপসহকারী প্রকৌশলী এনামুল কবির জানান, বুধবার বিকেলেই হেলিকপ্টারে করে ঢাকা থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত দল রাজশাহীতে এসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিভিল এভিয়েশনের পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন) নাজমুল এনাম। তদন্ত শেষ হলেই দুর্ঘটনার কারণ জানা যাবে বলে জানান তিনি।

মহানগরীর শাহ মখদুম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান জানান, বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমির ওই প্রশিক্ষণ বিমানটিতে প্রশিক্ষণার্থী তামান্না রহমান ও প্রশিক্ষক সাঈদ কামাল ছিলেন। বিমানটি আকাশ থেকে মাটিতে নামার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে আগুন ধরে যায়। সাইদ কামালকে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা সিএমএইচে পাঠানো হয়েছে। নিহত তামান্না রহমানের মরদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

Share