প্রবাসী ছেলের সাথে মোবাইল ফোনে বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে ইসলাম

ইসলামিক ডেস্ক

আধুনিক যুগে মোবাইল ফোন বা মুঠোফোন ব্যাপক উপকারী ও সমাদৃত একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এখন সব শ্রেণীর মানুষ মোবাইল ফোননির্ভর হয়ে পড়েছে। মোবাইল ফোনের ভালো-মন্দ দুটি দিক থাকলেও এই ছোট্ট যন্ত্রটি ছাড়া কারো জীবন যেন চলতে চায় না। এর উপকার নানামুখী, তাই সর্বত্রই এর ব্যবহার লক্ষণীয়।

শরিয়তের দিক-নির্দেশনা মোতাবেক সঠিকভাবে এর ব্যবহার হলে নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় নেয়ামত হয়ে উঠতে পারে। বর্তমান সমাজে বিশেষ করে প্রবাসীদের মধ্যে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিয়ে করার প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলেছে। সমাজে এ ধরনের বিয়ের ব্যাপারে পক্ষ-বিপক্ষ মত ও সংশয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। ইসলামের দৃষ্টিতে মোবাইল ফোনে বিবাহের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু এবং প্রবাসীদের জন্য শরিয়তসম্মত বিবাহের রূপরেখা কী?

মোবাইল ফোনে বিয়ে :

মোবাইল ফোনে বিয়ে বলতে বোঝানো হয় আক্বদের অনুষ্ঠানে কোনো কারণে বর-কনের মধ্য থেকে কোনো একজনের উপস্থিতি সম্ভব না হলে উপস্থিত পক্ষের কোনো একজন সাক্ষীদের সামনে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অনুপস্থিত পক্ষকে বিবাহের প্রস্তাব দেওয়া। অনুপস্থিত পক্ষ সাক্ষীদের কাছ থেকে দূরে বহু দূরে অবস্থান করে অপর প্রান্ত থেকে তা কবুল করে নেওয়া। ইসলামের দৃষ্টিতে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সম্পাদিত এ ধরনের বিবাহের হুকুম জানার আগে বর্তমানে ব্যবহৃত মোবাইল ফোনসেট ও যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মৌলিক প্রকারভেদ ও শরিয়ত মোতাবেক বিবাহ জায়েজ হওয়ার শর্তগুলো জেনে নেওয়া জরুরি, যাতে এ ধরনের বিবাহের শরয়ি বিধান বোঝা সহজ হয়।

মোবাইল ফোনের প্রকার :

প্রচলিত মোবাইল ফোনসেট ও যোগাযোগমাধ্যমগুলো সাধারণত চার ধরনের হয়ে থাকে।

যেমন- ১. এমন সেট যার আওয়াজ শুধু ওই লোকই শুনতে পায়, যে রিসিভ করে।

২. লাউড স্পিকারযুক্ত সেট, যার আওয়াজ রিসিভকারী ছাড়াও পাশে অবস্থিত উপস্থিত লোকজনও শুনতে পারে।

৩. 3G Supporter উন্নত মানের সেট, যেগুলো দিয়ে সরাসরি ভিডিও কল করা যায়। যার মধ্যে একে অপরকে সরাসরি দেখতে পারে এবং কথাও শুনতে পারে।

প্রসঙ্গত, আমাদের দেশের মোবাইল কম্পানিগুলোর নেটওয়ার্ক এখনো 3G Support করে না। তবে টেলিকনফারেন্স এবং কম্পিউটারে অনলাইনে সরাসরি ভিডিও কল করা যায়, যা উল্লিখিত তৃতীয় প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। ৪. বহুল প্রচলিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যেগুলোতে লেখা এবং স্থির ছবি দেখা যায়। কোনো ধরনের আওয়াজ শোনা যায় না। যেমন ফেসবুক, টুইটারে চ্যাট করা ইত্যাদি।

বিবাহ সহিহ হওয়ার শর্ত :

শরয়ি দৃষ্টিকোণে বিবাহ সহিহ হওয়ার জন্য কিছু মৌলিক শর্ত রয়েছে। যেগুলোর কোনো একটি শর্তের অনুপস্থিতি শরিয়ত মোতাবেক নিকাহ অশুদ্ধ হয়ে যেতে পারে।

গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মৌলিক শর্ত হচ্ছে-

১. বর-কনের ইজাব কবুল দুজন যোগ্য সাক্ষীর সামনে সম্পাদন হওয়া। ইজাব যেসব সাক্ষীর সামনে হবে কবুল, ঠিক সেই সাক্ষীদের উপস্থিতিতেই হতে হবে।

২. সাক্ষীদ্বয় বর-কনের ইজাব-কবুল সরাসরি শুনতে হবে।

৩. ইজাব ও কবুল একই মজলিসে [বৈঠকে] সম্পাদন হওয়া আবশ্যক।

৪. ইজাব-কবুল উভয় সাক্ষীর একসঙ্গে শুনতে হবে।

পর্যালোচনা :

উল্লিখিত শর্তের আলোকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আলোচিত যোগাযোগমাধ্যমগুলোর কোনো একটিতেও বিবাহ সহিহ হওয়ার প্রথম শর্তটি পাওয়া যায় না। কারণ সাক্ষীদের উপস্থিতি কনের সঙ্গে হলে বরের সঙ্গে নেই আর বরের সঙ্গে হলে কনের সঙ্গে নেই। প্রত্যেকের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন সাক্ষী উপস্থিত থাকলে শরিয়তে তা অগ্রহণযোগ্য।

উল্লিখিত দ্বিতীয় শর্তটি যোগাযোগমাধ্যমের চতুর্থ প্রকার ছাড়া প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকারে পাওয়া গেলেও প্রথম শর্তটি না থাকায় তা-ও অকার্যকর। তৃতীয় শর্তটি উল্লিখিত যোগাযোগমাধ্যমগুলোর কোনোটিতে পাওয়া সম্ভব নয় বিধায় এগুলোতে বিবাহ সম্পাদন শরিয়ত মোতাবেক কোনোভাবেই শুদ্ধ হবে না।

রয়ে গেল চতুর্থ শর্তটি, এটির অস্তিত্ব শুধু দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকারের যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া যায়। তবে এটিও অর্থহীন হয়ে যায় উল্লিখিত প্রথম ও তৃতীয় শর্তটির অনুপস্থিতির কারণে। প্রথম প্রকারের মোবাইল ফোনে সাক্ষীদের পক্ষে পর্যায়ক্রমে ইজাব-কবুল শোনা সম্ভব হলেও সবার পক্ষে একসঙ্গে শোনা অসম্ভব। আর চতুর্থ প্রকারের বিষয়টি স্পষ্ট।

উল্লিখিত পর্যালোচনার দ্বারা এ কথা স্পষ্ট হয়, উল্লিখিত প্রথম তিন প্রকারের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সম্পাদিত বিয়ে শরিয়তের বিধানানুযায়ী অশুদ্ধ এবং নাজায়েয প্রথম ও তৃতীয় শর্তটির অনুপস্থিতির কারণে। আর চতুর্থ প্রকার যোগাযোগমাধ্যমে বিবাহ জায়েজ না হওয়ার কারণ সব কয়টি শর্তের অনুপস্থিতি।

বিকল্প পন্থা :

প্রশ্ন থেকে যায়, প্রবাসী বা যারা বিবাহের আক্বদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে অপারগ, শরিয়ত তাদের জন্য বিবাহের পথ বন্ধ করে দিয়েছে? নাকি বিকল্প কোনো পথ খোলা রেখেছে? অবশ্যই, শরিয়ত তাদের জন্য একটি নয়, একাধিক পথ উন্মুক্ত রেখেছে। যার কাছে যেটি সহজ এবং বোধগম্য সেটি সে অবলম্বন করতে পারবে। গায়েবানা বিয়ের কয়েকটি পদ্ধতি নিচে দেওয়া হলো-
১. বর বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে কনেকে বা কনের নিযুক্ত উকিলকে চিঠি লিখবে। চিঠি কনের বা কনের নিযুক্ত উকিলের হস্তগত হলে শরিয়তসম্মত সাক্ষীদের সামনে ওই চিঠি পাঠ করা হবে। পাঠ শেষে কনে বা নিযুক্ত উকিল ওই মজলিসেই বলবে যে, আমি বা কনের পক্ষে আমি বিবাহ কবুল করলাম। তাহলে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যাবে।

২. কনে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে বরকে বা বরের নিযুক্ত উকিলকে চিঠি লিখবে। চিঠি বরের বা বরের নিযুক্ত উকিলের হস্তগত হলে শরিয়তসম্মত সাক্ষীদের সামনে ওই চিঠি পাঠ করা হবে। পাঠ শেষে বর বা নিযুক্ত উকিল ওই মজলিসেই বলবে যে, আমি বা বরের পক্ষে আমি বিবাহ কবুল করলাম। তাহলে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যাবে।

৩. প্রবাসীরা দেশে অবস্থিত কাউকে নিজের বিবাহের উকিল নিযুক্ত করে তাকে বলে দেবে যে ‘অমুক মেয়ের সঙ্গে তুমি আমার বিবাহ সম্পাদন করে দাও’ এরপর ওই উকিল দুজন শরিয়তসম্মত সাক্ষীর সামনে নিজ মুয়াক্কিলের পক্ষ থেকে সরাসরি কনের সঙ্গে বা কনের পক্ষ থেকে নিযুক্ত উকিলের সঙ্গে ইজাব-কবুল করে নেবে।

৪. অথবা চিঠি বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বর, কনেকে বা কনে, বরকে নিজের বিয়ের উকিল নিযুক্ত করবে। তখন উকিল বর হোক বা কনে শরিয়ত মোতাবেক সাক্ষীদের সামনে বলবে- তোমরা সাক্ষী থাকো আমি আমার মুয়াক্কিল অমুকের বিবাহ আমার সঙ্গে সম্পাদন করলাম। তাহলে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যাবে।

প্রবাসীদের জন্য ওপরে উল্লিখিত চারটি পদ্ধতির যেকোনো একটি অবলম্বন করার অনুমতি রয়েছে। তবে তৃতীয় পদ্ধতিটি আমাদের দেশের সমাজের জন্য মানানসই।

Share