জাতীয়

বিদায়ী বছর যেন প্রবাসী আয়ের

সদ্যবিদায়ী বছর যেন প্রবাসী আয়ের। ২০২০ সালে রেমিটেন্সে এযাবৎকালের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। করোনার প্রথমদিকে খাতটিতে বড় ধাক্কা লাগে। মার্চ ও এপ্রিলে আয় কমে যায়। তবে এরপরই বড় ধরনের উল্লম্ফন শুরু হয়। এখনো সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। আর এতেই নতুন নতুন রেকর্ড হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। ফলে অর্থনীতির সবচেয়ে ভালো সূচক হিসেবেই গত বছর পার করে প্রবাসী আয় খাত।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান বলেন, ৪৯তম বিজয়ের মাসে দেশের রিজার্ভ প্রথমে ৪২ দশমিক ০৯ বিলিয়ন এবং পরে তা ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এটা দেশের ইতিহাসে রেকর্ডের ওপর রেকর্ড সৃষ্টি হলো।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বন্ধ হয় অবৈধ পথে প্রবাসী আয় আসার প্রবণতা। এর প্রভাব পড়ে বৈধ পথে প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতি যখন চাপে পড়ে, ঠিক তখন প্রবাসী আয় বাড়তে থাকার ঘটনা আশা জাগায়। আর আমদানি খরচ কমে যাওয়ার কারণেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রেকর্ড হয়।

২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার ফলে প্রবাসী আয় তখন থেকে বাড়তে শুরু করে। তবে করোনায় হঠাৎ ধাক্কা লাগে প্রবাসী আয়ে। অর্থনীতির সবচেয়ে ভালো সূচকটি থেকেই খারাপ খবর আগে সবার আগে। কারণ প্রবাসী-অধ্যুষিত দেশগুলো ভাইরাসে নাস্তানাবুদ, দীর্ঘদিন ধরে চলে লকডাউন। এর প্রভাবেই মার্চ মাসে প্রবাসী আয় কমে প্রায় ১২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে যেখানে ১৪৫ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় আসে, সেখানে মার্চে তা কমে ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলারে নেমে আসে। যা ২০১৯ সালের একই মাসে ছিল ১৪৫ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। আর করোনা মহামারী আরও প্রকট হলে এপ্রিলে প্রবাসী আয় আরও কমে হয় ১০৮ কোটি ডলার। তবে এরপরই রেমিটেন্স বাড়তে থাকে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির নতুন নতুন রেকর্ড হতে শুরু করে।

মে মাসে রেমিটেন্স আসে ১৫০ কোটি ডলার। যা জুনে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৩ কোটি ডলার। আর ঈদের আগের মাস জুলাইয়ে এক লাফে প্রবাসী আয় ২৬০ কোটি ডলারে ওঠে। একক মাস হিসেবে এই আয় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এরপর আগস্টে ১৯৬ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে ২১৫ কোটি ডলার, অক্টোবরে ২১০ কোটি ডলার ও নভেম্বরে ২০৭ কোটি ডলার আসে। আর ডিসেম্বরের প্রথম ২৯ দিনে আসে ১৯১ কোটি ডলারের রেমিটেন্স। এভাবে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়।

প্রবাসী আয় বৃদ্ধির কারণ নিয়ে দুই ধরনের মত রয়েছে বিশ্লেষকদের। কেউ বলছেন, করোনায় প্রবাসীদের আয় কমে গেলেও নিকট-আত্মীয়দের কাছে তারা ঠিকই টাকা পাঠিয়েছেন। আবার অনেক সাহায্য-সহযোগিতাও এসেছে। আগে অবৈধ পথে (হুন্ডি) বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স এলেও সেটি করোনাকালে বন্ধ হয়ে যায়। এর ওপর প্রবাসী আয় বিতরণ সহজ করে দিয়েছে এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ব্যাংকের উপশাখাগুলো। ফলে বৈধ পথে এখন রেমিটেন্স বেশি আসছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, অবৈধ পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য প্রবাসী আয় বাড়ছে। এটা ধরে রাখতে নতুন নতুন দেশের খোঁজ করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মহামারির কঠিন সময়েও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বেড়েই চলেছে। জুলাই থেকে প্রতি মাসে গড়ে দুই বিলিয়ন ডলার করে রেমিটেন্স আসছে। এতেই ১২ বিলিয়ন ডলার হবে। আর জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে নিলে ২১ বিলিয়ন ডলারের কম হবে না।’

এদিকে মহামারীর বছরেই দেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন ৪৩ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে, যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৫ ডিসেম্বর রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।

দুই সপ্তাহে রিজার্ভে যোগ হয়েছে আরও এক বিলিয়ন ডলার। গত এক বছরে রিজার্ভ বেড়েছে ১১ বিলিয়ন ডলারের মতো। ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর রিজার্ভে ছিল ৩২ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে প্রতি মাসে চার বিলিয়ন ডলার হিসেবে প্রায় সাড়ে দশ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ- এই ৯টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আকুর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের বিল পরিশোধ করতে হবে। তার আগ পর্যন্ত রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলারের ওপরেই থাকবে। কয়েক বছর ধরেই রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। দশ বছর আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরের জুন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছর শেষে সেই রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে গত বছরের অক্টোবরে। চলতি বছরের ৩০ জুন সেই রিজার্ভ বেড়ে ৩৬ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। ৮ অক্টোবর ছাড়ায় ৪০ বিলিয়ন ডলার।

ঢাকা ব্যুরো চীফ,২ জানুয়ারি ২০২০

Share